স্মরণ
ডা. মনসুর খলিল, স্মৃতিতে অম্লান
এনাটমির কিংবদন্তি শিক্ষক ছিলেন, অনেকটা নিভৃতেই তিনি চলে গেলেন ডিসেম্বরের ২৪ তারিখে (২০১৫)। দুটো শার্ট, দুটো প্যান্ট, ব্যস এভাবেই যার বছরের পর বছর কেটে গেছে, যে রুমে থাকতেন সেটায় একটা চৌকি, একেবারেই সস্তা দরের একটা চেয়ার একটা টেবিল যেগুলো হোস্টেলে ছাত্ররা কেনে সেই রকম। টেবিলজুড়ে বই, বিছানার এক পাশজুড়েও বই, পাশে একটু ঘুমানোর জায়গা। এ রকম প্রচারবিমুখ, মিতচারী, অকৃতদার এবং নির্বিশেষে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের একজন বাবাকে স্মরণ না করলে দুনিয়ার কি আসে যায়! কিন্তু, তাদের সন্তানদের অনেক কিছু আসে যায়।
বলছি, অধ্যাপক ডা. মনসুর খলিলের কথা। আমাদের বাবার কথা। বিয়ে থা করেননি, তাই সংসার নেই, একা একা থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন, সমাজ-সামাজিকতায় খুব একটা মানিয়ে ওঠার চেষ্টা করতেন না।
ছাত্রছাত্রীরাই ছিল তাঁর সন্তান, তাদের ঘিরেই তাঁর সব চিন্তা ভাবনা- তারা কীভাবে আরো ভালোভাবে জ্ঞানার্জন করবে, কীভাবে পড়াশোনা সহজ করে নিতে পারবে।
নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রদের জন্য নিজেই নীলক্ষেতে থেকে বই কিনে উপহার দিতেন। প্রত্যেক ছাত্রই তাঁকে বাবার মতো দেখত, বাবা বলেই সম্বোধন করত।
মাসে যে বেতন পেতেন তার থেকে নিজের চলার জন্য যা লাগে তা রেখে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। মা মারা যাওয়ার পর সেই টাকা দান করে দিতেন এতিমখানায়। মৃত্যুর পর ব্যাংক ব্যালেন্স ছিল মাত্র দুই হাজার টাকা।
কিশোরগঞ্জ মেডিকেলের প্রিন্সিপাল থাকাকালীন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন গত বছর ২৪ ডিসেম্বর। উনার এ প্রয়াণ ছিল মেডিকেল প্রফেশনের এক অপূরণীয় ক্ষতি।
অধ্যাপক ডা. মনসুর খলিল ১৯৬১ সালের ৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ডা. মিরাজ আহমেদ ছিলেন সামরিক অফিসার, যিনি পরবর্তী সময়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ।
দুই ভাই এক বোনের মধ্যে ডা. মনসুর খলিল মেঝ, বড় ভাই অধ্যাপক ডা. মহসিন খলিল ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের এনাটমি বিভাগের প্রধান। বোন সবার ছোট।
একদম ছোটবেলা থেকেই অধ্যাপক ডা. মনসুর খলিল ছিলেন তুখোড় মেধার অধিকারী। তাঁর বড় ভাই ডা. মহসিন খলিল যখন ক্লাস ওয়ানে পড়াশোনা করতেন, ডা. মনসুর খলিল নার্সারিতে আসাধারণ রেজাল্টের জন্য ডাবল প্রমোশন পেয়ে বড় ভাইয়ের সহপাঠী হয়ে যান।
এরপর ক্লাস ওয়ানে পুনরায় অতুলনীয় রেজাল্টের কারণে তাঁকে উপরের ক্লাসে ডাবল প্রমোশন দেওয়া হয়, তবে ভাইয়ের সাথে থেকে যাবেন বলে তিনি আর ডাবল প্রমোশন নেননি।
মায়ের কোলে স্যারের ছোটবেলার ছবি
১৯৭৬ সালে ডা. মনসুর খলিল কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় চার বিষয়ে লেটার মার্কসসহ প্রথম বিভাগ অর্জন করেন, অর্জিত মার্কস ছিল ৭৪% , আর সম্মিলিত মেধা তালিকায় তিনি অর্জন করেন ১৫তম স্থান।
১৯৭৮ সালে ঢাকা বোর্ডের অধীনে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় ঠিক একই রেজাল্টের পুনরাবৃত্তি, চার বিষয়ে স্টার মার্কসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ এবং ৮২.২% মার্কস পেয়ে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১৫তম স্থান।
এরপর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা। চান্স পেলেন ঢাকা মেডিকেলে, কিন্তু বড় ভাই ডা. মহসিন খলিল চান্স পান ময়মনসিংহ মেডিকেলে, ভাইয়ের সাথে থাকার অভিপ্রায়ে মাইগ্রেশন করে চলে আসেন ময়মনসিংহ মেডিকেলে।
মেডিকেলেও তাঁর মেধার স্বাক্ষর রাখতে থাকেন, অভূতপূর্ব পারফরমেন্সের কারণে পুরো মেডিকেলে সবাই তাঁকে এক নামে চেনে।
যার ফলাফল—প্রথম পেশাগত পরীক্ষায় ঢাকা ভার্সিটির অধীনে প্রথম স্থান অধিকার করেন, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পেশাগত পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান এবং চতুর্থ অর্থাৎ শেষ পেশাগত পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে তাঁর অসাধারণ মেধার পরিচয় রাখেন। মেডিকেলে যতগুলো সাবজেক্ট পড়ানো হয় তারমধ্যে শুধু কমিউনিটি মেডিসিন বাদে বাকি সব সাবজেক্টে অনার্স মার্কস (৭৫%) অর্জন করে ১৯৮৪ সালে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন।
এখানেই থেমে থাকেননি অধ্যাপক ডা. মনসুর খলিল, ১৯৮৬ সালে অষ্টম বিসিএস পরীক্ষায় স্বাস্থ্য ক্যাডারে অংশগ্রহণ করেন এবং পুরো বাংলাদেশে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
শরিয়তপুরের জাজিরা থানায় দুই বছর মেডিকেল অফিসার হিসেবে এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয়তার সাথে দায়িত্ব পালন সম্পন্ন করে এনাটমিতে স্নাতকোত্তর কোর্সের জন্য প্রেষণে যান ১৯৯০ সালে। তৎকালীন আইপিজিএমআরের অধীনে এমফিল এনাটমিতে পাস করেন ৭৫% মার্কসহ এবং ঠিক যেন গৎবাধা নিয়মে এখানেও প্রথম স্থান অধিকার করেন।
এখানে বলে নিই, এনাটমি হচ্ছে বেসিক সায়েন্স, মূলত মেডিকেলে শিক্ষকতা হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার জন্যই এমফিল করেছেন উনি, যদিও বাবা ডা. মিরাজ আহমেদের ইচ্ছে ছিল তাঁর তুখোড় মেধাবী ছেলেটা অনেক বড় সার্জন হবে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হৃদরোগ বিভাগে ভর্তি থাকা অবস্থায় জীবনের শেষ ছবি
যাই হোক, এমফিল শেষে বগুড়া মেডিকেলে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে জয়েন করেন। কিন্তু এক মেডিকেলে বেশিদিন মন টিকত না তাঁর, যার ফলে বিভিন্ন মেডিকেলে পোস্টিং নেন। একে একে খুলনা মেডিকেল, চট্টগ্রাম মেডিকেল, সিলেট মেডিকেলে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ময়মনসিংহ মেডিকেলে দ্বিতীয়বারের মতো পোস্টিং নেন ২০০৪ সালে। জীবিনের শেষ সময়ে নতুন হওয়া কিশোরগঞ্জ মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
কিশোরগঞ্জ মেডিকেলকে মেডিকেল কলেজ হিসেবে পুরোপুরি দাঁড় করানোর পেছনে বলতে গেলে পুরো কৃতিত্বই তাঁর। ভবন প্রতিষ্ঠা, লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা সব বিভাগে যথাযথ শিক্ষক নিয়োগে একাই দৌড়েছেন, ফার্স্ট ইয়ারের ছোট্ট ছেলেমেয়েগুলো যেন কোনোভাবেই বঞ্চিত না হয় সেই চিন্তাই মাথায় ছিল সব সময় ।
ক্যারিয়ার জীবনের আরো অর্জন রয়েছে তাঁর। এনাটমিতেই পিএইচডি অর্জনের জন্য তিনি পাড়ি জমান জাপানে, ওসাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি অর্জন করেন ১৯৯৯ সালে, সেখানেও রেকর্ড সংখক মার্কস অর্জন করে স্পেশাল রিকমেন্ডেশন পান, তাঁকে গবেষণার কাজে জাপানে থেকে যেতে বলা হয়, বেশ উচ্চ পারিশ্রমিকেই, কিন্তু তিনি রাজি হননি। পয়সা আর আর সম্মানের লিপ্সা কখনো তাঁকে টানেনি। চলে আসেন দেশে।
জ্ঞানের নেশা ছিল তাঁর। এরপর ২০০১ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেটেরিনারি এনাটমিতে কম্পেয়ারেটিভ এনাটমিতে এম এস কোর্সে প্রবেশ করেন। সাফল্য যেন তাঁর পৈত্রিক সম্পত্তি, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হন এবং তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র এনাটমিস্ট যিনি মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মধ্যকার তুলনা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।
এরপর ২০০৪ সালে সিলেট মেডিকেল কলেজ থেকে ফরেনসিক মেডিসিনে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৫ সালে অর্জন করেন ফরেনসিক মেডিসিনে এমসিপিএস ডিগ্রি।
এ ছাড়া তাঁর দখল ছিল আটটি ভাষায়। মেডিকেল সোসাইটিতে তাঁর নাম জানে না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অথচ তিনি ক্লিনিশিয়ান ছিলেন না, রোগীদের সমাজে ক্লিনিশিয়ান ডাক্তাররা পরিচিতি পেলেও বেসিক সায়েন্সের তিনিই এমন একজন ব্যতিক্রম যাঁর নাম সবাই জানে।
এত মেধা সত্ত্বেও এত অর্জন সত্ত্বেও তিনি ছিলেন একেবারেই প্রচারবিমুখ , শিক্ষক হিসেবে তাঁর সব ধ্যান জ্ঞান ছিল মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে।
ক্লাস আওয়ার শেষেও বিকেলে এবং রাতে স্টুডেন্টদেরকে নিয়ে পড়াতেন নিজ উদ্যোগে, তবে এটাকে প্রচলিত প্রাইভেট পড়ানোর সাথে তুলনা দিলে এটা হবে বিনে পয়সায় প্রাইভেট পড়ানো। আর দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য থাকত আলাদা যত্ন ।
প্রত্যেক ছাত্রের ফোন নম্বর রাখতেন, নিয়মিত ফোনে পড়াশোনার খোঁজ নিতেন, একজন বাবার মতোই। তিনি নিজেও বলতেন, ‘এই মেডিকেল তোমাদের মা, আর আমি তোমাদের বাবা।’
তাঁর প্রয়াণের পর দুটো স্মরণসভা হয়েছে, একটা ময়মনসিংহ মেডিকেলে আরেকটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর কোনো স্মরণসভায় এত প্রাণের টান এত আবেগের সঞ্চার হয়েছে কি না জানি না, চোখের পানি মোছেনি এমন কাউকে পাওয়া যাবে না।
আর পৃথিবীতে কোনো শিক্ষকের প্রয়াণে জানা নাই তাদের ছাত্ররা মেসেজ পাঠায় -
‘বাবা, তুমি আমাদের ছেড়ে এভাবে চলে যেতে পার না, কিশোরগঞ্জ মেডিকেলের তোমার প্রতিটা ছেলেমেয়ে তোমাকে মিস করে।’
আমরা আমাদের বাবাকে আসলেই অনেক মিস করি। বাবার সব শিক্ষার্থীই করে। বাবার প্রতি সন্তানের অনেক অনেক শ্রদ্ধা রইল।
লেখক : চিকিৎসক, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ।
সহযোগিতায় : খাইরুন নেসা, মীর শওকত নেওয়াজ নিরব, শাহ মোহাম্মদ রিমান, মো. আবুল হাশেম রায়হান, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ, নুসরাত জাহান, জান্নাতুল মাওয়া (শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ)।