ইউপি নির্বাচন
ভোটের হাত ধরে হেঁটে চলা আমাদের ‘গণতন্ত্র’
‘অশিক্ষিত মানুষের জন্য গণতন্ত্র নয়,’ কথাটি কোন এক বইয়ে পড়েছিলাম, মনে নেই। সে কারণেই বোধ হয় আমাদের দেশে গণতন্ত্র বা ডেমোক্রেসি শব্দটি নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপও হয় দেদার। টিভি ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেত তাঁর একটি কৌতুকের অ্যালবামে বলেছিলেন, আব্রাহাম লিংকনের ডেমোক্রেসির সংজ্ঞাটি এখন হবে Government buy the people, Off the people, Far the people, অর্থাৎ, গণতন্ত্র জনগণকে কেনে, জনগণের বাইরে রাখে এবং জনগণ থেকে দূরে থাকে।
আমরা কী ধরনের গণতন্ত্রের চর্চা করি এবং কী ধরনের গণতন্ত্রের ভেতরে রয়েছি কিংবা ছিলাম- তার উত্তর খুঁজতে গেলে হানিফ সংকেতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের খুব বেশি সুযোগ বোধ করি নেই।
বস্তুত যে দেশে গণতন্ত্র যত বেশি সংকটাপন্ন, সে দেশের সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি তত বেশি উচ্চারণ করেন এটি বোঝানোর জন্য- ‘ঠাকুর ঘরে কে রে? আমি কলা খাই না।’
কেউ কেউ গণতন্ত্রের সঙ্গে উন্নয়নকেও গুলিয়ে ফেলে এমন সব তত্ত্ব হাজির করেন, যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ল্যাসিক বা আধুনিক পুস্তকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বরং মনে হতে পারে এটি গণতন্ত্রের উত্তরাধুনিক ধারণা বা সংজ্ঞা।কেননা গণতন্ত্র থাকলেই যে সেখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উন্নয়ন হবে- এই কথাটিও জনগণকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য বারবারই গণতন্ত্র, আইয়ুব খানীয় বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্র,সেন্সরড বা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা ইত্যাদি উদ্ভট তত্ত্বের জন্ম দিতে হয় পলিটিশিয়ানদের। আর গণতন্ত্র চর্চার এই সংস্কৃতিতে বিএনপি-আওয়ামী লীগ কিংবা অন্য দলগুলোর মধ্যে পার্থক্য শুধু নামে। জনগণের কাছে- ‘যাহা বাহান্ন তাহাই তেপ্পান্ন।’
আমাদের যখন গণতন্ত্র শেখানো হয়, তখন সবচেয়ে বড় উদাহরণ খাড়া করা হয় নির্বাচনকে। দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া নির্দিষ্ট বিরতিতে আমাদের দেশে ভোটের উৎসব হয়; যা কখনো কখনো ঈদ বা দুর্গাপূজার উৎসবকেও ছাড়িয়ে যায়। জনগণ নিজের পবিত্র আমানত ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের প্রতিনিধি বাছাই করে আনে। অনেক সময় প্রতিনিধিরা ভোট ছাড়াই জনগণের সেবা করার গুরু দায়িত্ব পেয়ে যান এবং ভোটের আগে ‘ফস করা পানির বোতল’ যথারীতি ভরে তোলেন খালের পানিতে। জনগণ গোস্বা হয় এবং অপেক্ষা করে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য এবং তখন তারা প্রতিশোধ নেয়। তারা জনপ্রতিনিধি বদল করে এবং ভাবে যে বিশ্ব জয় করে এসেছে এবং পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য তারা একই চরিত্রের মানুষকে নির্বাচিত করে।
স্বাধীনতার পর এ যাবত জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছে ১০টি।নিয়মিত বিরতিতে হয়েছে স্থানীয় সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদেও। জেলা পরিষদে ভোট না হলেও সেখানে সরকারের মনোনীতরা দায়িত্ব পালন করছেন।যদিও এটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে আদৌ দাঁড়িয়েছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
দেশের সবচেয়ে বড় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন পরিষদ; যেখানে স্বাধীনতার পর এ যাবত ভোট হয়েছে ৮ বার। ২২ মার্চ থেকে শুরু হতে যাওয়া এবারের ইউপি নির্বাচন হবে নবম আয়োজন। নির্বাচন কমিশনের হিসেবে, সারা দেশের চার হাজার ৫৪৬টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে চলতি বছরে মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে এ রকম চার হাজার ২৭৫টি। এসব ইউনিয়ন পরিষদে ছয়টি ধাপে ভোট নেওয়া হবে।
এই যে এত এত ভোট এবং জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন- যাকে জ্ঞানীরা গণতন্ত্রের উৎসব বলে আখ্যা দেন- তাতে স্বাধীনতার ৪৪ বছরে দেশের আনাচে-কানাচে, প্রতিটি ঘরে, অফিসে, রাজনৈতিক দলের ইউনিট কার্যালয়ে গণতন্ত্রে ভরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গণতন্ত্র মহোদয় কোথায় থাকেন-তা কজন জানেন? তা ছাড়া এসব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোই বা কতটা শক্তিশালী হয়েছে, সে প্রশ্নের জবাবও জনগণ জানে।
আবার ইউনিয়ন পরিষদে তৃণমূলের মানুষের দলমতের ঊর্ধ্ব উঠে তাদের জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের যে সুযোগটি ছিল এতদিন, এবার তাও রহিত করা হচ্ছে ওই তথাকথিত গণতন্ত্র শক্তিশালী করার নামেই। অর্থাৎ এবার ইউপি নির্বাচনেও চেয়ারম্যান পদে ভোট দিতে হবে নৌকা বা ধানের শীষে, ব্যক্তিকে নয়। অর্থাৎ লাউ বা কদুকে। ব্যক্তি ইমেজ, এলাকার মান্যগণ্য ভদ্রলোক, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, স্বচ্ছল কৃষক কিংবা সমাজকর্মীরা এ যাত্রা গণতন্ত্রের এই বৃহৎ উৎসব থেকে নিজেদের দূরে রাখলেই নিরাপদ থাকবেন। কেননা, আপনি যেই হোন না কেন, যাই থাক আপনার পারিবারিক ঐতিহ্য বা জনগণসম্পৃক্ততা- আখেরে ভোট যাবে নৌকা-ধানের শীষের গোলায়। সুতরাং আগে আপনাকে কোনো না কোনো দলে নাম লিখাতে হবে।
গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। কিন্তু এই নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের দেশের গণতন্ত্র আসলেই কতটা শক্তিশালী হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার হাজারো যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
প্রায় এক দশকের স্বৈরশাসনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে দেশের মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল এই ভেবে যে, এবার বোধ হয় গণতন্ত্রের ধানে গোলা ভরে যাবে। কিন্তু ১৯৯১ সালের পরে নিয়মিত বিরতিতে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল হলেও, ২০০৬ সালে এসে আবার সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা ধরে রাখা আর ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় যাওয়ার উন্মত্ত বাসনা ডেকে আনে অনির্বাচিত সরকার। আবার ১৯৯১ থেকে ২০০৬ সাল পযর্ন্ত ১৫ বছর শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর হলেও এই সময়ের মধ্যে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আখেরে কতটা মজবুত হয়েছে, দলের ভেতরেই কী ধরনের গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে, রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের মতামতের আসলেই কতটা সুযোগ তৈরি হয়েছে, গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান শর্ত পারস্পরিক সম্মান তথা ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কতটা তৈরি হয়েছে- এসব নিয়েও প্রশ্ন আছে।
সম্প্রতি সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী বলেছেন, ‘গণতন্ত্র মানেই সবার সমান অধিকার নয়। তাহলে গণতন্ত্রে কারাগার থাকত না, বিচারালয় থাকত না। গণতন্ত্রের নামে অপরাধী আর অপরাধীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তকে এক পাল্লায় মাপা যায় না। ঠিক তেমনই নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা নির্বাচনে জয়ী হলেই অপরাধীর অপরাধ হালাল হয়ে যায় না। গণতন্ত্রের নির্বাচনও সবার অংশগ্রহণের অধিকার দেয় না।’
মন্ত্রী মহোদয়ের এই বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু গণতন্ত্র বলতে আমাদের ক্ষমতাসীনরা বরাবরই ক্ষমতায় থাকতে যে তত্ত্ব দেন, ক্ষমতার বাইরে থাকলে ঠিক তার উল্টো তত্ত্ব হাজির করেন। অর্থাৎ গণতন্ত্র শব্দটিকে তারা প্রয়োগ করতে চান নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী।
বলা হয় শিক্ষা ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। অতএব গণতন্ত্র চর্চার আগে আমাদেরকে শিক্ষিত হতে হবে। এখন আপনি যদি প্রশ্ন করেন সেই শিক্ষার ধরন কী হবে? কিংবা ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষার জন্য ভিন্ন ভিন্ন গণতন্ত্র হবে কি না। এই যেমন ধরা যাক ইংলিশ মিডিয়ামের জন্য ইউরোপীয় গণতন্ত্র, বাংলা মিডিয়ামে পড়া লোকেদের জন্য দেশি গণতন্ত্র, মাদ্রাসায় পড়ুয়াদের জন্য ইসলামিক গণতন্ত্র ইত্যাদি। আবার প্রাথামিক স্তরেই যেহেতু আমাদের প্রায় ১১ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে, অতএব এর জন্য আলাদাভাবে ১১ ধরনের গণতন্ত্র আবিষ্কার করতে হবে কি না- তা নিয়েও আলোচনা শুরু করা দরকার বলে মনে হয়।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।