স্মৃতিচারণ
প্রত্নতত্ত্ব চর্চায় আমার অভিভাবক
লেক সার্কাস তেঁতুলতলার মাঠটা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর হয়তো অনেকদূর। এর একটায় রয়ে গেছে অনেক স্মৃতি আর অন্যটা হয়ে গেছে স্মারক কিংবা কালের নিষ্ঠুরতম বাস্তবতার সাক্ষী। সময়টা ২০০৭ সালের শেষাংশ। কলাবাগান লেক সার্কাসে বিল্ডারদের তাণ্ডব সেভাবে শুরু হয়নি। আর চারদিকে আকাশচুম্বী অট্টালিকাগুলো একের পর এক মাথা তুললেও দুটো ভবন ছিল একটু অন্যরকম। তার একটি ১৫/সি এর দোতলার বারান্দা কিংবা জানালা থেকে উঁকি দিয়ে প্রথম চোখ পড়েছিল এক বর্ষীয়ানের দিকে। কাকডাকা ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত অবধি নিবিষ্ট চিত্তে বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে কিংবা টেবিলে টুকটাক লেখালিখি করেই দিন কাটাতেন তিনি। তখনো মাধ্যমিকের পাঠ শেষ হয়নি, তবে প্রায় শতবর্ষী নিজের দাদার পাশাপাশি প্রতিবেশী বৃদ্ধ ভদ্রলোকের প্রতিও অন্যরকম একটা সম্মান জন্মেছিল তখন।
এরপর বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতা ও রোগে দাদা মারা গেলে অনেকটা শোকে মূহ্যমান অবস্থা। তখন বারান্দার গ্রিল ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তেমন কোনো কাজ ছিল না, এই ফাঁকে একদিন উপযাজক হয়ে এগিয়ে গিয়ে কথা বলা এ নিভৃতচারী প্রত্নতাত্ত্বিকের সঙ্গে। আমার ছোট ফুফুর বাসার ঠিক লাগোয়া ১৬ নং বাসাটিতে থাকতেন তিনি। গতানুগতিক পড়া ও লেখালিখির দিনানুদৈনিক রুটিনে একমাত্র বিকেলে ছিল তাঁর অখণ্ড অবসর। এ সময়টা তিনি কাটাতেন নিজ বাড়ির ছাদে। সেখানে অসীম আগ্রহ আর পরম যত্নে গড়ে তোলা ফুল ও সবজি বাগানের যত্ন নিতেন নিজ হাতে। প্রতিটি গাছের গোড়ায় সার-পানি ঢালা থেকে শুরু করে তার আগাছা পরিষ্কার করতেন বেশ আগ্রহভরে।
প্রথমদিনের দেখায় সালাম বিনিময়ের পর সবে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরুনো এক ছোকরার সঙ্গে কথা চালিয়ে নেওয়ার তেমন কোনো আগ্রহ পাননি তিনি। কিছুক্ষণ সেখানে অনাহূতের মতো দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে আসি সেদিন। কয়েকদিন বাদে আবার দেখা, অনেকটা ফ্রি ছিলেন তিনি। তাই নতুন করে পরিচয়পর্ব, কোন ক্লাসে পড়ি, বাইরের বইপত্র পড়ি কি না, ক্লাসের পাঠের বাইরে আর কোনো ধরনের বইয়ে আগ্রহ বেশি এমনি নানা প্রশ্ন আর উত্তরে সেদিন আড্ডাটা জমেছিল বেশ। তখনো জানা হয়ে ওঠেনি কার সঙ্গে কথা বলছি, অহেতুক আলাপচারিতায় কার গবেষণার মূল্যবান সময় নষ্ট করছি আমি। কিশোর মনের নানা বেখেয়ালে সবকিছু এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকলেও একটু খেয়াল করি তিনি সব আলোচনাতেই কেমন যেন প্রাচীন কাল, পুরাবস্তু আর প্রত্নতত্ত্বকে টেনে আনার চেষ্টা করেন।
অষ্টম শ্রেণির পাঠ শেষ করার আগে সেবা প্রকাশনীর প্রায় সব অনুবাদ গোগ্রাসে গিলতে থাকায় কঠিন হলেও দুর্বোধ্য মনে হয়নি কোনো কিছু। তাই আলাপচারিতায় তিনি যখন পাথর যুগ, গুহামানব, মিসরের প্রত্নঐশ্বর্য- এসব নিয়ে গল্প তুললেন আমিও নির্দ্বিধায় সেবার অনুবাদে পড়া হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের গল্পকে আশ্রয়জ্ঞান করি। বিবর্তনের প্রশ্ন উঠতেই আমি দুম করে হ্যাগার্ডের স্টেলা বই থেকে গড়গড় করে কাহিনী বলা শুরু করি। সেখানে ওঝা ওয়াদাবা জিম্বি, অ্যালান কোয়াটারমেইন কিংবা স্টেলার বোন সেই বেবুন মেয়ের গল্প তাঁকে এতটাই আকৃষ্ট করেছিল যে পরবর্তীকালে ছেলেকে দিয়ে ‘স্টেলা’ বইটা কিনিয়ে এনেছিলেন নীলক্ষেত থেকে। এরপর পাথরযুগ নিয়ে কথা উঠতেই হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের সেই অমূল্য রচনা তথা সেবার অনুবাদে প্রাপ্য ‘নেশা’ থেকে ওয়াই, আকা, তানা, মোয়ানাঙ্গা, নেকড়ে মানব প্যাগ আর হাড় বজ্জাত বুড়ো আর্কের প্রসঙ্গ তুলি। ডায়েরির পাতা হাতড়ে দেখলাম সেদিন খুব হেসেছিলেন তিনি। বললেন থামো, এগুলো তুমি বলছ গল্পের কথা, এসব নিয়ে প্রচুর পড়তে হবে। এটা অত সহজ বিষয় না। এটাকে নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাঁদের বলা হয় প্রত্নতাত্ত্বিক। দেশ বিদেশ ঘুরে ফিরে তাদের দেখে বেড়াতে হয় পুরাকীর্তি, মাটি খনন করেও বের করতে হয় অনেককিছু। আমি অনেকটা সাহসে ভর করে দি মাম্মি আর ইন্ডিয়ানা জোন্সের কথা বলতে গিয়ে তাড়া খেয়ে থেমে যাই।
আর যাই হোক এমনি আলাপচারিতা অনেকটা অজ্ঞাতসারে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়টির প্রতি এক ধরনের সুপ্ত আগ্রহ জন্মে দিয়েছিল আমার মাঝে। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও অনেকটা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে পরিবারে সবার কথা অগ্রাহ্য করে একটা পর্যায়ে ভর্তি হয়ে যাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে। তারপর থেকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রথম কয়েকবছর বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকার দিন পার করে কলম-কিবোর্ডও ধরেছিলাম বেশ শক্তহাতে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর কলাবাগানে আমার যাতায়াত কমে যায়। তবে ছুটির দিনগুলোতে কিংবা অবসরে সুযোগ পেলেই ছুটতাম ছোট চাচার সঙ্গে দেখা করতে আর ফিরতি পথে যাকারিয়া স্যারের সঙ্গে দেখা করে আসিনি এমন নজির বিরল। তবে প্রথম দিকে দাদা ডাকলেও প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষার্থী হিসেবে তাঁর কীর্তিরাজি জানার পর অনেকটা অজ্ঞাতসারে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে স্যার শব্দটি। এ ক্ষেত্রে তাঁর ঘোরতর আপত্তি থাকলেও আমি এখন অবধি স্যার বলেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষার্থী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ গ্রহণের আগেই বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থান ‘উয়ারী বটেশ্বরে’ মাঠকর্মে অংশ নেওয়ার এক বিরল অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমি এবং আমার বন্ধু তুষারের। সেখানে কয়েকদিন কাজ করার পর সমাপনী অনুষ্ঠানে অনেক অতিথির সঙ্গে এসেছিলেন তিনিও। মাঠকর্মের অস্থায়ী ক্যাম্পে বিদ্যমান সুবিধায় যত দূর সম্ভব আপ্যায়ন-সমাদর করার চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না। কিন্তু প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। সে সময় অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, বর্তমানে প্রত্নতত্ত্বের আরো দুই শিক্ষক জামি ভাই এবং সৌরভ ভাইসহ বাকিদের দৌড়াদৌড়ির ঘটনাটি এখনো মনে পড়ে। সেবা শুশ্রূষার একপর্যায়ে একটু সুস্থ হলে তাঁকে নিয়ে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন সৌরভ ভাই। তবে উপস্থিত সবার মধ্যে এক ধরনের আশংকা এবং অদ্ভূদ রকমের ভালোবাসা কাজ করতে দেখেছিলাম এ বর্ষীয়ান প্রত্নতাত্ত্বিকের জন্য। এরপর মাঠ থেকে ফিরে বাড়ি যাওয়ার আগে খোঁজ নিয়ে আসি তাঁর। তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন খুব খুশি হয়েছেন উয়ারী বটেশ্বরে জাহাঙ্গীরনগরের ছেলেমেয়েদের কাজ দেখে। বললেন প্রাচীন স্থাপনা নিয়ে তোমার আগ্রহ আছে, ফাঁকিবাজি না করে মন দিয়ে লেখাপড়া করো, অনেক ভালো করার সুযোগ আছে তোমার জন্য। একইসঙ্গে তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন সবাই প্রত্নতত্ত্ব চর্চা করে নিজের জন্য, নিজেকে বড় মাপের গবেষক জাহির করার জন্য। তুমি এমনটা করবে না, যেহেতু হ্যাগার্ডের সরল ভাষার প্রাচীন নিদর্শনের গল্প পড়ার অভ্যাস তোমার আছে, চেষ্টা করবে বাংলাদেশের প্রত্ন-ঐশ্বর্যকে সাধারণ্যের বোধগম্য করে উপস্থাপন করতে।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর তাঁর উপযুক্ত নির্দেশনার পাশাপাশি নিয়মতান্ত্রিক লেখাপড়ায় বেশ ভালো ফল পাই দ্বিতীয় বর্ষ যেতেই। অনেকটা তাঁর কথা মেনেই কোনো বিষয় নিয়ে মাথা ভারি না করে সবগুলো দিক জানতে চেষ্টা করি। তারপর আরো বছরখানে গেলে টুকটাক লেখালিখিও শুরু করি। তবে লেখার ক্ষেত্রে সরাসরি প্রত্নতত্ত্ব বাদ দিয়ে সহজ ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্বের জনপ্রিয় ধারাকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি বারংবার। ইতিহাস গবেষক ও বর্তমানে আমার পিএইচডি তত্ত্বাবধায়ক এ কে এম শাহনাওয়াজ স্যারের সহলেখক হিসেবে লেখা দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস’ উৎসর্গ করা হয় স্যারকে। তারপর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে ঐতিহ্যের মোমিন মসজিদের শতবর্ষ উদযাপনের এক অনুষ্ঠানে স্যারের উপস্থিতে বইটি তুলে দেওয়া হয় তাঁর হাতে। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে তিনি শুধু বলেছিলেন ‘এটা আমার জন্য আনন্দের, তবে তোমার জন্য সবে পথচলার শুরু। প্রত্নচর্চার ক্ষেত্রে যেমন কোনো শর্টকার্ট রাস্তা নেই, একজন গবেষকের জীবনে তেমনি আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। এখানে একটা অর্জন আনন্দের উপলক্ষ হতে পারে তবে তা নতুন করে আরেকটা কাজ শুরুর উপলক্ষ করে দেয় মাত্র।’
বয়স ছাড়িয়েছিল নব্বইয়ের কোটা বেশ আগেই, বলতে গেলে শতবর্ষ ছুঁই ছুঁই করছিলেন তিনি। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক আতাউর ভাই বলতেন ‘স্যার আপনাকে সেঞ্চুরি করতেই হবে। আমরা ওই দিন একটা ১০০ পাউন্ডের কেক কাটবো’ দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত রোগে ভোগা যাকারিয়া স্যার অবশ্য শতবর্ষ পূরণের স্বপ্নে বিভোর না থেকে বরং দেখা করতে গেলেই বলতেন ‘আমার দিন তো শেষ, নব্বই পেরিয়ে আরো অর্ধযুগ চলে গেল, বল আর কত? তার পরে কখনই আমাদের কারো কাছে কাঙ্ক্ষিত ছিল না যে পত্রিকার পাতায় দেখব- ‘বিশিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক, অনুবাদক ও পুঁথিবিশারদ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া আর নেই।’ কিংবা ফোনের ওই প্রান্ত থেকে কেউ বলবে- ‘ওই অর্ণব তুই কই, যাকারিয়া স্যার পৌনে ১২টার সময় মারা গেছেন।’ অনেকের প্রশ্ন স্যারের কী হয়েছিল- জানিস কিছু? বিষণ্ণতা চেপে উত্তর দিতে হয়েছে ‘দীর্ঘদিন শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন স্যার, ডা. মামুনুর রশিদ ও ডা. কামরুল আলমের ভাষ্যে ফুসফুস ও কিডনির জটিলতাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়েছিলেন তিনি। এ অবস্থায় সেই গত ২৬ নভেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আর ফিরে যেতে পারেননি লেক সার্কাসের ১৬ নম্বর বাসায়।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবন শেষ করে অন্তিম বেলায় যে ইজি চেয়ারটায় তিনি বসতেন সেটা হয়তো এখন খাঁ খাঁ করছে। লেক সার্কাসে তাঁর সে বাসায় হয়তো আর কেউ গিয়ে বিরক্ত করবে না মারুফ সাহেবকে। বারবার কলিংবেল টিপে সারা বাড়িটা সরগরম করে তুলতে চাইবে না প্রায় প্রতিদিনের অতিথি ব্যাংকার মাহমুদুল হাসান। আমাদের দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে অজ্ঞাতসারে নাড়তে থাকা সীমাহীন লেখনী সঞ্জীবনী সে অমিত শক্তিধর হাতটি থেমে গেছে আজ। বেশ কয়েকটি র্যাক ভর্তি থরে থরে সাজানো বইগুলোর পাতা হয়তো আর কেউ উল্টাবে না। অখণ্ড অবসরে পরম মমতায় বাসার ছাদে গড়ে তোলা বাগানটির যত্ন নেওয়ার মতো কেউ হয়তো থাকবে না। ধীরে ধীরে সার পানি না পেয়ে শুকিয়ে যেতে থাকা ছাদের বেগুন-টমেটো-মরিচগাছ আর নেতিয়ে পড়া লাউডগার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষ হয়তো ভুলে যাবে তাঁকে। তবে দিনাজপুর জাদুঘর যত দিন থাকবে তাঁকে মনে করতেই হবে সবার। ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বইটা একবার হাতে নিলে একটি নাম ইচ্ছে-অনিচ্ছে আগ্রহ-অবহেলায় বলতেই হবে সবাইকে। এদিকে গুপিচন্দ্রের সন্যাস, গাজীকালু চম্পাবতী, বিষহরার পুঁথি, বিশ্বকেতু ও সত্যপীরের পুঁথিপাঠে কেউ কেউ খুঁজে ফিরবেন তাঁকেই। তবকাত ই নাসিরী, ম তারিখ ই বাঙ্গালা, মোজাফফরনামা, নওবাহার ই মুরশিদ কুলি খান এবং সিয়রউল মুতাখখিরীনের মতো মূল্যবান গ্রন্থের অনুবাদকর্ম নিয়ে ভাবলে তাঁকে স্মরণ না করে উপায় নেই। তাই জাতি হারিয়েছে এক কৃতী সন্তানকে, আর আমি বলব ‘যাকে হারিয়েছে প্রত্নচর্চায় তিনি আমার অভিভাবক এবং তাঁর তুলনা তিনি নিজেই।’
লেখক : পিএইচডি গবেষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।