নগরজীবন
ঢাকা শহর ও আগুনে পোড়া পরিবার
‘ওদের একটা চাদর বা তোশকই পুড়ত। আমার বাচ্চারা তো বাঁচত। একটা মানুষও সাহায্য করেনি। মানুষ কত অমানবিক।’
এমন মর্মস্পর্শী বর্ণনা রাজধানীর উত্তরায় আগুনে পোড়া পরিবারের গৃহকর্ত্রী সুমাইয়া আক্তারের, যাঁর স্বামী ও দুই ছেলে এরই মধ্যে মারা গেছেন। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন তিনি ও তাঁর আরেক ছেলে।
হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা সুমাইয়া ওই দিনের ঘটনার যা বর্ণনা দিয়েছেন, তা এরই মধ্যে গণমাধ্যমে এসেছে। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘প্রথমে চারতলা ও পরে তিনতলায় ফ্ল্যাটের দরজায় কড়া নাড়লাম। ওরা দরজা খুলল। আমাগো দেইখ্যা দরজাগুলো সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিল। বিল্ডিংয়ের নিচে নামলাম। দেখলাম কত মানুষ। কেউ এগিয়ে এলো না। সবাই তাকাইয়্যা রইল। বিল্ডিংয়ের মহিলারা একটা চাদরও আগাইয়্যা দিল না। বললাম, আমি মহিলা; অন্তত একটা চাদর দেন। কিচ্ছু দিল না।’
আমেরিকান দূতাবাসে কাজ করতেন শাহীন শাহনেওয়াজ। ঝালকাঠি শহরের যে এলাকায় তাঁর বাড়ি, সেটি আমাদের বাসা থেকে হাঁটাপথ। যদিও এই পরিবারের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। দুর্ঘটনার পর গণমাধ্যমের খবরেই জানতে পারি, আমরা একই শহরের। পরে ফেসবুকে দেখলাম, আমার শৈশবের এক বন্ধুর খালু তিনি। পাঁচ সদস্যের পরিবারে এখন বেঁচে রইলেন কেবল শাহনেওয়াজের স্ত্রী আর এক ছেলে। ছেলে আশঙ্কামুক্ত; কিন্তু স্ত্রীর অবস্থা সংকটাপন্ন।
অনেকেই বলছেন, এই ট্র্যাজেডি ব্যক্তিকেন্দ্রিক মহানগরীর একটি মর্মান্তিক উদাহরণ। কেননা, প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ যে ছোট্ট শহর থেকে এসেছেন, সেখানে এই ঘটনা ঘটলে তাঁর স্ত্রীর ডাকে অবশ্যই অনেক মানুষ সাড়া দিত এবং হাতের কাছে যার যা কিছু আছে, যত দামি চাদরই হোক, তা দিয়ে নিশ্চয়ই তাঁর আগুনে পোড়া সন্তানকে জড়িয়ে ধরত, যাতে আগুন সারা শরীরে ছড়িয়ে না যায়। কিন্তু এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক মহানগর তাঁকে বাঁচতে দেয়নি।
২.
ব্যাচেলর জীবনে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের একটি ছয়তলা বাসার টপ ফ্লোরে থাকতাম আমি আর আমার এক বন্ধু। তাঁর বাড়ি সাতক্ষীরায়। তাঁদের একাধিক মাছের ঘের আছে। সংগত কারণে মাঝেমধ্যেই তাঁর বাড়ি থেকে ককশিটে করে আমাদের বাসায় মাছ আসত। সেই মাছের একটি অংশ আমরা অবশ্যই চারতলায় বাড়িওয়ালার বাসায় পাঠিয়ে দিতাম।
একবার আমার বন্ধুর মা শবে বরাত উপলক্ষে বেশ কিছু নারকেল আর গুড় পাঠিয়ে দিয়ে বললেন, কাজের মহিলাকে দিয়ে যদি সম্ভব হয় কিছু পিঠা বানিয়ে খেতে। আমরা ওই নারকেল আর গুড়ের একটা অংশ বাড়িওয়ালার বাসায় পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু দেখা গেল, শবে বরাতের রাতে ন্যূনতম ভদ্রতার খাতিরেও ওই বাসার কেউ আমাদের বলেনি যে ‘আজ রাতে আমাদের সঙ্গে খাবেন’ বা ওই নারকেল ও গুড় দিয়ে নিশ্চয়ই তারা পিঠা পায়েস বানিয়েছিল, কিন্তু তার ছিটেফোঁটাও আমাদের বাসায় আসেনি। ঢাকা শহরের বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে ভাড়াটিয়াদের সম্পর্ক কমবেশি এ রকমই।
তবে ব্যতিক্রমও আছে। অন্তত আমার বর্তমান ও পূর্বের বাড়িওয়ালার সঙ্গে আমাদের পরিবারের যে সম্পর্ক, সেটি একেবারেই ব্যতিক্রম। এখনো প্রতিবেশীদের সঙ্গে, বিশেষ করে দু-তিনটি পরিবারের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক, সেটিও ঢাকা শহরের সাধারণ চিত্রের সঙ্গে মেলে না; বরং সাধারণ চিত্র উত্তরার ওই ভবনের মতো, যেখানে একজন নারী তাঁর আগুনে পোড়া সন্তানকে বাঁচানোর জন্য আকুতি করছেন আর বাকিরা তাঁকে দেখে ঠাস করে দরজা বন্ধ দিচ্ছে। কারণ, অন্যের আগুনে পোড়ার মতো যথেষ্ট সময় ও মানসিকতা—কোনোটিই এই শহরের মানুষের নেই।
৩.
এই শহরের মানুষের অনেক ভয়। তারা রাত ১১টার পর গেটে কয়েকটি তালা লাগিয়ে দেয়, যার চাবি থাকে বাড়িওয়ালার কাছে। সুতরাং ১১টার পর বাড়ির বাইরে যেতে চাইলে বা বাসায় ঢুকতে গেলে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে চাবি নিতে হয়।
এ শহরের ভাড়াটিয়াদেরও ভয় অনেক। তারা পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে, তা জানে না। কারণ, এটি জেনে তাদের কোনো লাভ নেই। জানলেই বরং মাঝেমধ্যে দাওয়াত করে খাওয়াতে হবে। আবার কে জঙ্গি, কে আওয়ামী লীগ কে বিএনপি-জামায়াত, কে কোন মানসিকতার—এসব চিন্তাও মাথায় থাকে। সুতরাং কেউই ঝামেলায় যেতে চায় না। যে যার মতো ভালো থাকতে চায়। ফলে যখন ঈদ বা পূজার লম্বা ছুটি মেলে, তখন এই মানুষগুলো আর এই শহরে থাকতে চায় না। পরিবার-পরিজন নিয়ে দৌড় দেয় মফস্বলে। কারণ, এই শহরটা আসলে তার নয়। এই শহর সে ওউন করে না। এই শহরে সে থাকে কেবল জীবিকার প্রয়োজনে। ফলে এই শহরের প্রতিবেশীরা তার কাছে আপন নয়।
এই শহরের মানুষেরা অনেক ব্যস্ত। তাদের ব্যস্ততা ক্যারিয়ার নিয়ে, তাদের ব্যস্ততা আরেকটু ভালো থাকা নিয়ে। তাদের ব্যস্ততা নিজের পরিবার নিয়ে। নিজের পরিবার বলতে স্বামী-স্ত্রী-সন্তান। এর বাইরে বাবা-মা বা অন্য আত্মীয়স্বজনও অনেক সময় গৌণ।
সুতরাং এই শহরে কোনো একজন বিপদাপন্ন মানুষ সহায়তার জন্য আকুতি করবেন আর বাকিরা দরজা বন্ধ করে ঘুমাবেন, এটিই স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে বেঁচে থেকে সবচয়ে বেশি অসুবিধায় পড়লেন সুমাইয়া আক্তার আর তাঁর ছেলে। যতদিন তাঁরা বেঁচে থাকবেন, প্রতিবেশীর সম্পর্কে এক ধরনের ঘৃণা নিয়েই তাঁদের বাঁচতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক