সোজা কথা
আমাদের পরিবেশ নারীবান্ধব নয়
এ মাসেই চলে গেল বিশ্ব নারী দিবস। দিনটিতে বিভিন্ন বয়সী নারীরা দিনভর মিছিল-মিটিং, গেট-টুগেদার, মিলনমেলা কত কিছু করেন। পুরুষরাও বুকে ব্যাজ লাগিয়ে নারী দিবস পালন করেন। আর আমার শুধু দিনভর নিজেকে কেমন যেন অসহায় অসহায় লাগে। নারীদের সম্মানে আয়োজিত নানা অনুষ্ঠানে যাওয়ার আমন্ত্রণ থাকে, আমি নানা অজুহাতে সেসব জায়গা এড়িয়ে যাই। চারপাশের আত্মবিশ্বাসী সাহসী মেয়েগুলোকে যেন একদিনের স্বাধীনতা দিয়ে উদ্ধার করে ফেলেছেন পুরুষ প্রভুরা। দিবসটি নিয়ে পুরুষ সহকর্মীরা কিন্তু ব্যঙ্গ করেন মেয়েদের। যাঁরা খুব প্রগতিশীল বলে নিজেকে দাবি করেন, সমাজে তাঁরা কিন্তু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন নারীর শরীর-মন সব কিছুর মালিক তাঁরা।
আমাদের পরিবেশ এখনো যে নারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি, তার প্রমাণ পেতে বেশি কষ্ট করার প্রয়োজন নেই। রাতে পাবলিক ট্রান্সপোর্টগুলোতে চলাচল করতে আমিও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। আমার কথা শুনে অনেকেই ঠোঁট ওল্টাতে পারেন। রাজধানীতে তো লাখ লাখ মেয়ে রাতবিরাতে কাজ করে বাড়ি ফিরছে। আমি মানছি অবশ্যই ফিরছে তারা, তবে সে ক্ষেত্রে এদের বেশির ভাগই কয়েকজন মিলে একসাথে যাচ্ছে, পুরুষ কলিগ কেউ সঙ্গে থাকছে আর যাঁরা একান্তই একা চলছেন, তাঁদের অবস্থা ভাটারার সেই আদিবাসী মেয়েটার মতোও হচ্ছে হয়তো। অনেক খবরই আমাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। খবরটা চার কান হলে লোকে ছেলেগুলোর কোনো দোষ দেখবে না, দোষ হচ্ছে মেয়েটার। এত রাতে কেন একা একা বেরিয়েছে? বেরিয়েছে ভালো কথা, রাস্তায় কে কী করেছে তা চেপে গেলেই হয়, না, মামলা করে দোষীদের শাস্তি দাবি করছে। মেয়েদের এমন বেলাল্লাপনায় পুলিশরাও যারপরনাই বিরক্ত।
তাই তো কোনো মেয়ে যখন সেক্সুয়াল হেরেজমেন্টের অভিযোগ নিয়ে থানায় যান, সেখানে রেপের চেয়েও বেশি নির্যাতনের শিকার হন মেয়েরা। নানা অশ্লীল প্রশ্নবাণে পুলিশ সদস্যরা নির্যাতিত মেয়েটির কী অবস্থা করতে পারেন তার প্রমাণ পেয়েছেন আদিবাসী সেই মেয়েটি। অন্তত সারা জীবন এই বীভৎস স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হবে তাকে। এমন কত মেয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশেই কী ভয়ানক কষ্ট নিয়ে পথ চলছে প্রতিনিয়ত।
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পহেলা বৈশাখে নারীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনাকে ‘তেমন বিষয় না’ বলে মন্তব্য করেছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।
গত বছরের বহুল আলোচিত এই ঘটনার প্রসঙ্গ তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বেসরকারি সংগঠনের অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখে অনেক মানুষ রাস্তায় থাকে। কোটি কোটি মানুষের এই দেশে ঢাকা শহরে প্রায় দুই কোটি মানুষ থাকে। তার মধ্যে এমন কী ঘটনা ঘটেছে, যা সংবাদ হওয়ার মতো? এমন টুকিটাকি ঘটনা হতেই পারে! এতগুলো মানুষের মধ্যে এটা তেমন কোনো বিষয়ই না। ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে সম্প্রতি একজনকে গ্রেপ্তারের পর মামলাটি পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক সমালোচক আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারকে ‘ব্যর্থ’ প্রমাণের চেষ্টা চালিয়েছিল বলে মন্তব্য করেন শাজাহান খান।
পহেলা বৈশাখে টিএসসি এলাকায় যৌন নিপীড়নের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন যুবকের চেহারা সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়লেও তাদের শনাক্ত করা যায়নি উল্লেখ করে মামলাটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল পুলিশ। পহেলা বৈশাখে টিএসসির সামনে নারীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনাকে ‘তিন-চারটা ছেলের দুষ্টামি’ বলে মন্তব্য করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল। ২০১৫ সালের ১২ মে এক অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন। এরপর একেবারে আঞ্চলিক ভাষায় আইজিপি বলেন, ‘তিন-চারটা ছেলে দুষ্টামি করতাছে, মেয়েদের শ্লীলতাহানি করছে, কেউ আগায়া আসল না, বাকি লোক তাকিয়ে দেখল।’
বাংলা বর্ষবরণ উৎসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় যৌন নিপীড়নের ঘটনায় জড়িতদের একজনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। পরে সে বক্তব্য থেকে সরে এলেন তিনি নিজেই। নতুন করে মন্ত্রী বলেছেন, গত পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় নারী লাঞ্ছনার ঘটনায় ভিডিও ফুটেজের শনাক্ত করা নিপীড়কদের আটক করা হয়নি।
২০১৫ সালের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের উৎসবের সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে ভিড়ের মধ্যে একদল যুবক নারীর ওপর চড়াও হয়। তাতে বাধা দিতে গিয়ে আহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দীসহ কয়েকজন। এ ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। ঘটনার পর এক মাসেও কাউকে গ্রেপ্তর করতে না পেরে ছবি ও ভিডিও দেখে চিহ্নিত আটজনের পরিচয় শনাক্ত করার জন্য গত ১৭ মে এক লাখ টাকা করে পুরস্কারও ঘোষণা করে পুলিশ।
আমরা যদি পুরো ঘটনাটি একে একে সাজাই, তাহলে খুব সাদা চোখেই ধরা পড়ে যে দুষ্কৃতকারীদের যাঁরা ধরবেন সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে এটা কোনো বিষয়ই না, তাঁদের মনোভাবের সঙ্গে একই মত পোষণ করেন যে মন্ত্রী এমপিরা, তারও প্রমাণ কিন্তু আমরা দেখতে পাই নৌপরিবহনমন্ত্রীর কথায়। পরে সমালোচনার মুখে তিনি তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করলেও তাঁর মনোভাব বুঝতে কারো কোনো অসুবিধা হয়নি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেশের জনগণের রক্ষক বলা হলেও তাদের ভক্ষকের ভূমিকায় আমরা বারবার দেখি। সেই ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট পুলিশ হেফাজতে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পর সমাজে কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? এখন বরং যেন পুলিশ আরো বেপরোয়া। ইয়াসমিনের ঘটনা আরো হাজারো ঘটনার ভিড়ে চাপা পড়ে গেছে। কী নির্মমতায় মেয়েটিকে জীবন হারাতে হয়েছিল। দিনাজপুরের পুলিশের পিকআপ ভ্যানচালক অমৃতলাল, পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মইনুল এবং আব্দুস সাত্তার এই অসহায় মেয়েটিকে সাহায্য করার কথা বলে কী নৃশংসভাবে হত্যা করে রাস্তায় ফেলে রাখে। এখানেই শেষ হয়নি, ইয়াসমিন হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে জীবন দিতে হয়েছে সাতজন নিরাপরাধ মানুষকে। তৎকালীন মন্ত্রী-এমপিরাও বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত দোষীদের শাস্তি হয়েছিল অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। সময় একটুও বদলায়নি। নারীর প্রতি অবমাননা এখন কোনো অন্যায় নয়, বরং নারীর চলনবলনে দোষ ধরা হয়। এখনো পুলিশ চাইলেই কারো বাড়িতে ঢুকে তল্লাশির নামে শ্লীলতাহানি করছে, মিথ্যা অভিযোগ দাঁড় করা হচ্ছে, নারীর প্রতি অবমাননার মামলায় নারীকেই বিব্রত করছে পুলিশ।
আবারও আসছে পহেলা বৈশাখ। আবারও সর্বস্তরের বাঙালি নেচে গেয়ে উদযাপন করবে তাদের প্রাণের উৎসব। কিন্তু ভয়াবহ সেই দুঃস্বপ্ন তাড়া করে ফিরবে সেই মেয়েটিকে, বা যে মা সেদিন লাঞ্ছিত হয়েছিলেন, তাঁরা কি পারবেন স্বাভাবিক হতে? আজ তারা হাজারো মানুষের ভিড়ে লাঞ্ছিত হচ্ছে, যারা এই অপকর্ম করছে তারা এতটুকু লজ্জিত নয়, নিজের মেয়ে মা বউ কিংবা বোন নয় ভেবে যারা পাশ কাটিয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছে তারাও কি দোষী নয়? যারা বিবেকের তাড়নায় এগিয়ে এসেছে তারাই আবার পুলিশের হাতে নির্যাতিত হয়েছে। অনেক উদ্বিগ্ন মা-বাবাই হয়তো এবারের পহেলা বৈশাখে তার সন্তানকে বাড়ি থেকে বের হতে দেবেন না। মন খারাপ করে অবুঝ কিশোরী মেয়েটি তার ভাইকে ঈর্ষা করবে, কেন যে ছেলে হলাম না।
আমরা কি তবে এই এগিয়ে চলা সময়ের উল্টোস্রোতে হাঁটব? মেয়েদের নিরাপত্তার নামে তাদের আবারও ঘরে বন্দি করে রাখব? আমি এতটা নিরাশাবাদী হতে রাজি নই। আমার প্রত্যাশা আসছে, পয়লা বৈশাখে মেয়েরা রঙে রঙে রঙিন প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াবে রমনার বটমূলে, নোংরা মানসিকতা নিয়ে কেউ যদি এগিয়ে আসে তার হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে অপরিচিত পাশের মানুষগুলোই। শুধু রমনার বটমূল কেন, গভীর রাতে পথ যত নির্জনই হোক না কেন, একলা চলা কোনো মেয়েই আর ভয় পাবে না পথ চলতে।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ