রাজনীতি
বিএনপির কাউন্সিল ও গণতন্ত্র
ষষ্ঠ কাউন্সিল সামনে রেখে বিএনপি যে পোস্টার ছাপিয়েছে, সেখানে ‘গণতন্ত্র’শব্দটিকে জেলখানার প্রতীকে আবদ্ধ রেখে লেখা হয়েছে, ‘মুক্ত করবোই’। অর্থাৎ তারা বলছে, গণতন্ত্র এখন কারাবন্দি, তারা সেটিকে মুক্ত করবে। তো এই পোস্টার দেখে মনে হয়, বিএনপির আমলে বোধ হয় দেশে ব্যাপকমাত্রায় গণতন্ত্র ছিল। সেই সাথে এই প্রশ্নটিও করার ইচ্ছে জাগে যে, আমাদের দেশে আসলেই কবে গণতন্ত্র ছিল?
১৯ মার্চ রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিল নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা অনেক দিন ধরেই। বিশেষ করে এই কাউন্সিলের মাধ্যমে মৃতপ্রায় বিএনপি ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠবে-এমন আশাবাদ লক্ষ করা গেছে দলের সিনিয়র নেতাদের কথায়। ফলে আশাবাদী হয়ে ওঠে তৃণমূল।
যদিও চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদে সঙ্গত কারণেই খালেদা জিয়া এবং তার বড় ছেলে তারেক রহমান ছাড়া অন্য কেউ মনোনয়ন ফরম না নেওয়ায় বা নেওয়ার সাহস না করায় এ দুটি পদে তারা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন এবং কাউন্সিলের দিন সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। ফলে কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে শীর্ষ নেতৃত্বে যে কোনো পরিবর্তন এসেছে, তা নয়।
তা ছাড়া দলের স্থায়ী কমিটি ও নির্বাহী কমিটির বাকি পদগুলো নির্বাচনে একক ক্ষমতা ও সর্বময় কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে চেয়ারপারসনকে। জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ এই প্রস্তাব উত্থাপন করলে কাউন্সিলররা তা অনুমোদন করেন এবং এটি বোঝার জন্য খুব বুদ্ধিমান হওয়ার দরকার নেই যে, খন্দকার মোশাররফ নিজের উদ্যোগে এই প্রস্তাব করেননি; বরং এটিই দলীয় সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত কী নেওয়া হবে, তা আগেই নেওয়া হয়েছে। কাউন্সিলররাও যে যথারীতি সংসদে বিল পাসের মতো হ্যাঁ বলে সমর্থন জানাবেন, সেটিও পূর্বনির্ধারিত। অর্থাৎ এখানে লোকে দেখছে যে খুব গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে, সবার মতামত নেওয়া হচ্ছে, সবাই হাত তুলে সমর্থন জানাচ্ছে; পক্ষান্তরে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার সাহস বা এখতিয়ারও কারো নেই। অর্থাৎ এটি গণতন্ত্রের বাংলাদেশি স্টাইল, যা প্রধান দুই দলই চর্চা করে।
প্রশ্ন হলো, দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা কি কখনো চেয়ারপারসন এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বাইরে অন্য কাউকে চিন্তা করেন বা অন্য কারো নাম চিন্তা করার মতো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি কি আদৌ বিএনপির ভেতরে রয়েছে?
একই কথা প্রযোজ্য দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বেলায়ও। যত দিন শেখ হাসিনা জীবিত এবং সুস্থ থাকবেন, তত দিন এই দলের প্রধান হিসেবে অন্য কারো নাম চিন্তা করার কি কোনো সুযোগ আছে?
বাস্তবতা হলো, দেশের সাধারণ মানুষও প্রধান দুই দলের প্রধান হিসেবে শেখ ও জিয়া পরিবারের বাইরে কারো কথা ভাবতে পারে বলে মনে হয় না। কারণ বছরের পর বছর ধরে তারা এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন যেখানে গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও, এ দুটি পরিবারের বাইরে গিয়ে অন্য কিছু ভাববার অবকাশ নেই। ফলে একে পারিবারিক গণতন্ত্র বলাই শ্রেয়। আর এ কারণে আরো বহু বছর এ দুই পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাই, তাদের রাজনৈতিক মেধা থাকুক বা না থাকুক, বংশপরম্পরায় যে দলের নেতৃত্ব দেবেন, তাতে সন্দেহ কম।
রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র নতুন কিছু নয়। এই উপমহাদেশ তো বটেই, উন্নত বিশ্বেও এর প্রচলন আছে। কোনো একজন তাঁর ক্যারিশমায় সে দেশের জনগণের কাছে নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেলে তাঁর উত্তরাধিকার দেশের রাজনীতিতে আবির্ভুত হন। সেই উত্তরাধিকাররা আসলেই যোগ্য হলে এ নিয়ে কোনো সমালোচনার অবকাশ থাকে না। কিন্তু যোগ্যতা না থাকার পরও যখন কেবল এই পারিবারিক পরিচয় সম্বল করে রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেন, তখনই পরিবারতন্ত্রের সমালোচনা হয়। ফলে পরিবারতন্ত্রের ইতিনেতি বিষয়টি নির্ভর করে ব্যক্তির ওপর।
আবার দলগুলোর ভেতর যখন গণতন্ত্র থাকে এবং যদি দলের সদস্যদের গোপন ভোটে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়, তখন পরিবারতন্ত্র নিয়ে কোনো সমালোচনা হয় না। ফলে আমাদের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র শব্দটি খারাপ অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার কারণ দলের ভেতরে গণতন্ত্র না থাকা। যখন লোক দেখানো কাউন্সিলের মাধ্যমে একই লোক বারবার দলের শীর্ষ পদে আসীন থাকেন, তখনই পরিবারতন্ত্র সমালোচনার মুখে পড়ে।
যদিও পৃথিবীর ইতিহাসে বরেণ্য ব্যক্তিদের অধিকাংশই এসেছেন সাধারণ পরিবার থেকে। যেমন আব্রাহাম লিংকন, উইনস্টন চার্চিল, মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এঁরা প্রত্যেকেই নেতৃত্বে এসেছেন তাঁদের নিজস্ব গুণাবলির কারণে। তাঁদের পিতা বা মাতা কেউ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন না। এটিই গণতন্ত্রের শক্তি।
কিন্তু আমাদের ক্ষমতাসীনরা যখন গণতন্ত্রের কথা বলেন, তখন তাঁরা গণতন্ত্র বলতে বোঝান নির্দিষ্ট মেয়াদে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল।কিন্তু গণতন্ত্র মানে যে বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র মানে যে ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধা,গণতন্ত্র মানে যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস, গণতন্ত্র মানে যে সবার সমান অধিকার, গণতন্ত্র মানে যে আইনের শাসন, গণতন্ত্র মানে যে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, গণতন্ত্র মানে যে কার্য়করর সংসদ ও শক্তিশালী বিরোধী দল, গণতন্ত্র মানে যে স্বাধীন ও কোনো রকম চাপ ও প্রভাবমুক্ত গণমাধ্যম, গণতন্ত্র মানে যে বিশেষ কোনো ধর্ম বা জাতিগোষ্ঠী বিশেষ সুবিধা পাবে না-তার কোনো বালাই থাকবে না।
ফলে বিএনপি যখন পোস্টারে গণতন্ত্র শব্দটি লিখে মুক্ত করার স্লোগান দেয়, তখন প্রশ্ন জাগে, তারা কোন্ গণতন্ত্রের কথা বলছে? তারা কি একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন পেলেই গণতন্ত্র মুক্ত হয়েছে বলে ধরে নেবে নাকি গণতন্ত্র বলতে আসলেই যা বোঝায়, যেমন বাকস্বাধীনতা, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, মুক্ত গণমাধ্যম ইত্যাদিকে বোঝে? যদি তাই হয়, তাহলে তাদের এই গণতন্ত্রের জন্য নাকিকান্নার আগে নিজের দলের ভেতরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। কাউন্সিলের নামে লোকদেখানো গণতন্ত্রের শোডাউন আখেরে দেশের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনে না।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর