সংবাদপত্র
যে বার্তা দিল ব্রিটেনের ইনডিপেনডেন্ট
২৬ মার্চ বিবিসি অনলাইনের একটি খবরের শিরোনাম ‘কাগজে আর ছাপা হবে না দি ইনডিপেনডেন্ট’। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘ব্রিটেনে ৩০ বছরের পুরোনো একটি সংবাদপত্র দি ইনডিপেনডেন্ট আজ তার সবশেষ প্রিন্ট সংস্করণ বাজারে ছেড়েছে। এখন থেকে এই পত্রিকা শুধু অনলাইনেই প্রকাশিত হবে।’
প্রসঙ্গত, এটিই ব্রিটেনে মূলধারার প্রথম কোনো পত্রিকা, যারা নিজেদের মুদ্রণযন্ত্রে ছাপা থেকে অনলাইনে রূপান্তর ঘটাল। ১৯৮৬ সাল থেকে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়ে আসছিল।
বিবিসির খবরে বলা হচ্ছে, পত্রিকাটি যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিল, তখন দৈনিক এর প্রচারসংখ্যা ছিল চার লাখের মতো। কিন্তু পত্রিকাটির ছাপার সংস্করণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তা কমে এসেছিল মাত্র ৪০ হাজারে। যদিও এর ডিজিটাল বা অনলাইন সংস্করণ এরই মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
পত্রিকাটির সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ‘আজ এই পত্রিকার প্রেস বন্ধ হয়ে গেল, কালি শুকিয়ে গেছে, পত্রিকাটিতে আর কোনো ভাঁজ পড়বে না। কিন্তু একটি অধ্যায় যেমন সমাপ্ত হলো, তেমনি শুরু হলো আরেক অধ্যায়ের। দি ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, সেটা অব্যাহত থাকবে।’
তো, এই সংবাদটি বাংলাদেশের গণমাধ্যম, বিশেষ করে সংবাদপত্রের জন্য কী বার্তা দিল? সম্ভবত এই বার্তা দিল যে, মুদ্রিত সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। পয়সা দিয়ে কাগজে ছাপা পত্রিকা আর কেউ কিনবে না।
অদূর ভবিষ্যতে, সেটি হয় পাঁচ কিংবা ১০ বছর পরে পয়সা দিয়ে কেউ যে আর কাগজে ছাপা সংবাদপত্র কিনবে না, সেটি আরো আগে থেকেই বলা হচ্ছে এবং এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংবাদপত্র প্রথম আলো এরই মধ্যে তাদের অনলাইন সংস্করণ বেশ শক্তিশালী করেছে। ইংরেজি মাধ্যমের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংবাদপত্র ডেইলি স্টারও এগোচ্ছে একই ধারায়। প্রথম সারির অন্য সব পত্রিকাই এখন সমানতালে তাদের অনলাইন সংস্করণ শক্তিশালী করার দিকে নজর দিচ্ছে। কারণ কর্তৃপক্ষ জানে, কাগজে ছাপা সংবাদপত্র একটা সময় পরে অচল মুদ্রায় পরিণত হবে।
তথ্যপ্রযুক্তির ওপর মানুষ যত বেশি নির্ভরশীল হচ্ছে, তত বেশি কমছে কাগজে ছাপা জিনিসের প্রতি তার নির্ভরশীলতা। অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে পেপারলেস বা কাগজমুক্ত অফিস ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ তাদের সব কাজই হয় কম্পিউটারে। এতে একদিকে যেমন কাগজের খরচ বাঁচে, তেমনি কাগজের জঞ্জালের হাত থেকেও মুক্তি মেলে।
যাঁরা নিয়মিত বাসায় এক বা একাধিক পত্রিকা রাখেন, মাস শেষে তাঁদের ঘরে কাগজের যে স্তূপ জমে যায়, সেটি এখন অনেকেরই বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে এই কারণেও অনেকে বাসায় নিয়মিত সংবাদপত্র রাখা বন্ধ করে দিয়েছেন বলে শোনা যায়।
তবে কাগজে ছাপা সংবাদপত্রের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মোবাইল ফোন। ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে যদি এখন ১০ কোটি মানুষও মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন, তাহলে ধরে নেওয়া যায় অন্তত এর অর্ধেক জনগোষ্ঠী মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। আর যাঁরা মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তিনি কী কারণে বাসায় কাগজে ছাপা পত্রিকা রাখবেন, যেখানে তিনি প্রতিমুহূর্তেই মোবাইল ফোনে খবর জানতে পারছেন?
মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর এই সংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকবে এবং সংগত কারণেই কাগজে ছাপা পত্রিকার চাহিদা কমতে থাকবে। সে সঙ্গে সব ক্ষেত্রে কাগজের ব্যবহার কমানো গেলে যে সেটি পরিবেশের জন্যও একটা আশীর্বাদ হয়ে উঠবে, সে বিষয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়, বিশেষ করে যখন বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্র উপকূলীয় গরিব দেশগুলো তো বটেই, উদ্বিগ্ন ধনী রাষ্ট্রগুলোও।
ফলে পেপারলেস হওয়ার একটা আন্দোলন ভেতরে ভেতরে দানা বাঁধছে এবং পেপারওয়ালারাও সেই আসন্ন পরিবর্তনের সঙ্গে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে জোর দিচ্ছেন অনলাইন মাধ্যমে।
অবশ্য অনলাইন সংবাদমাধ্যমের বিপত্তিও এরই মধ্যে টের পাওয়া যাচ্ছে। হাতেগোনা কিছু অনলাইন সংবাদপত্র নিজেদের বস্তুনিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারলেও অখ্যাত অনামি সব ডটকমের উদ্ভট বানোয়াট আর উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ভুয়া খবর যেভাবে প্রতিনিয়ত ফেসবুকে শেয়ার হচ্ছে, তা বিশ্বাস করার লোকের সংখ্যা কম নয়। ফলে সংবাদের নামে বিভ্রান্তিও ছড়াচ্ছে এই তথাকথিত অনলাইন সংবাদপত্রগুলো।
সরকার ঘোষণা দিয়েছে, অনলাইন সংবাদমাধ্যমকেও একটি নীতিমালার আওতায় আনার। নিবন্ধনের কথাও বলা হচ্ছে। কিন্তু তার পরও আইনের ফাঁক গলে আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্রের মতো এসব বস্তাপচা অনলাইন সংবাদপত্রও যে টিকে থাকবে, তাতে সন্দেহ কম। ফলে কাগজে ছাপা সংবাদপত্রের যুগে যেমন আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্রের দাপট রয়েছে, সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকবে অনলাইন যুগেও। এ ক্ষেত্রে বিচারের ভার শেষতক পাঠকেরই।
যেমন ফেসবুককে এখন বলা হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিকল্প গণমাধ্যম; বরং ফেসবুক মাঝেমধ্যেই এমন সব ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে যে, এটি মূলধারার গণমাধ্যমের চেয়েও বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সিলেটের শিশু রাজন কিংবা খুলনার রাকিব হত্যা মামলায় যে দ্রুততম সময়ে রায় হলো, সেটির মূল অনুঘটন এই ফেসবুক। আবার যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে শাহবাগে যে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হয়েছে, তারও স্রষ্টা এই ফেসুবক। সর্বশেষ কুমিল্লায় কলেজছাত্রী তনু হত্যার ঘটনাটি শুরুতে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো ব্ল্যাকআউটের চেষ্টা করলেও ফেসবুকের তাণ্ডবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তনু হত্যার বিচার দাবিতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে।
সুতরাং অনলাইন মাধ্যমই যে ক্রমে নেতৃত্বের জায়গায় চলে যাচ্ছে, সে বিষয়ে আর সন্দেহের অবকাশ কম। সে ক্ষেত্রে এখন চ্যালেঞ্জ একটাই, তা হলো দায়িত্বশীলতা। অনলাইন মাধ্যম এমনই সহজ যে আপনি চাইলেই যেকোনো সময় যেকোনো কিছু লিখে আপ করে দিতে পারেন। যেকোনো গুজব ছড়িয়ে দিতে পারেন। দাঙ্গাও বাধিয়ে দিতে পারেন। সুতরাং এখানে অনলাইন মাধ্যমের শক্তিটা নির্ভর করছে এর পেছনের ব্যক্তিটা কে, তার ওপর।
আমীন আল রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক।