সোজা কথা
সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ও একাংশের আত্মতুষ্টি
১৯৮৮ সালের ৫ জুন তদানীন্তন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনকালে সংবিধানের ‘অষ্টম সংশোধনী’ যুক্ত করা হয়। নতুন ওই সংশোধনীতে বলা হয়েছিল, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’ এরশাদের আমলেই সংশোধিত সংবিধানের সঙ্গে পরে অনুচ্ছেদ-২-এর পর ২(ক) যুক্ত হয়।
২(ক)-তে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সম-অধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ একই বছরের ৯ জুন রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের মধ্য দিয়ে এটা আইনে পরিণত হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে এই পরিবর্তনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তখনই ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র পক্ষে রিট (নম্বর ১৪৩৪/১৯৮৮) দায়ের করেন ১৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। সাবেক প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ ১৫ বিশিষ্ট নাগরিক হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে নানা ধর্মবিশ্বাসের মানুষ বাস করেন। এটি সংবিধানের মূলস্তম্ভে বলা হয়েছে। এখানে রাষ্ট্রধর্ম করে অন্য ধর্মকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এটি বাংলাদেশের অভিন্ন জাতীয় চরিত্রের প্রতি ধ্বংসাত্মক।’
এই রিট দায়েরের দীর্ঘ ২৩ বছর পর ২০১১ সালের ৮ জুন একটি সম্পূরক আবেদন করা হয়। ওই দিনই বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন। পাশাপাশি শুনানির জন্য অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ১৪ জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ রুল জারির কিছুদিন পর একই বছরের ২৫ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করা হয়। এতে ২ অনুচ্ছেদ আবারও সংশোধন করা হয়। সংশোধনীতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সম-অধিকার নিশ্চিত করবে।’
এর আগে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি শুনানির জন্য ২৭ মার্চ দিন ধার্য করেন আদালত, একই সঙ্গে এ মামলায় আইনি সহায়তাকারী হিসেবে ১৪ অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’ বহাল রেখে ২৯ বছর পূর্বে দায়ের করা একটি রিট সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের নির্দেশে বলা হয়েছে, যে সংগঠনের ব্যানারে রিটটি করা হয়েছিল, তাদের রিট করার এখতিয়ার নেই। বিচারপতি নাইমা হায়দারের নেতৃত্বে হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ শুনানি করে ২৮ মার্চ আবেদনটি খারিজ করে দেন। এ বেঞ্চের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল। রিট আবেদনকারীদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জগলুল হায়দার আফ্রিক ও সুব্রত চৌধুরী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা।
২০১১ সালের ২৫ জুন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের ওই ২ অনুচ্ছেদ আবারও সংশোধন করা হয়। এর পর রিট আবেদনকারী পক্ষ পঞ্চদশ সংশোধনীতে থাকা ওই বিধান চ্যালেঞ্জ করে সম্পূরক আবেদন করে। শুনানি নিয়ে ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ সম্পূরক রুল দেন। পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা ২(এ) অন্তর্ভুক্তি কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।
প্রতিস্থাপিত ২(এ) অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সম-অধিকার নিশ্চিত করবে।’
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের পাশাপাশি বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতি ফিরিয়ে আনার দাবি করে আওয়ামী লীগ। তবে ক্ষমতায় যাওয়ার পর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে আওয়ামী লীগ কোনো উচ্চবাচ্য করেনি।
আজকে যাঁরা সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রাখতে উৎসাহী কিংবা রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করতে ভয় পান, ১৯৮৮ সালে তাঁরা সবাই একজোট হয়ে ডেকেছিলেন হরতাল। এদিকে নব্বইয়ের আন্দোলনে স্বৈরশাসক পতনের পর ক্ষমতায় আসে বিএনপি।
’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার অঙ্গীকার করে জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। কিন্তু ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনলেও রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করেননি মহাজোটের সংসদ সদস্যরা। সংবিধান সংশোধনীর পর হাইকোর্ট তাই সম্পূরক রুল জারি করে সরকারের কাছে আবারও জানতে চায় : রাষ্ট্রধর্ম কেন বাতিল করা হবে না। এর পরে আর রিটটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসেনি।
রাষ্ট্রধর্ম-সংক্রান্ত রিট শুনানিকে ঘিরে রাজনীতিতে এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের শুনানির দিন ধার্য হওয়ার পর থেকে আবারও সংগঠিত হচ্ছিল হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামী দল ও সংগঠনগুলো। এরই মধ্যে তারা একাধিক কর্মসূচিও দিয়েছে। একই ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামীর ডাকে ২৮ মার্চ সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালও ডাকা হয়, যদিও রিট খারিজের পর দুপুরে তা প্রত্যাহার করে নেয় তারা।
রিট খারিজের খবর পেয়ে আদালত এলাকায় উল্লাস প্রকাশ করেন অল্পসংখ্যক আলেম-ওলামা। এর আগে বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর এক বিবৃতিতে জানান, এ রিটের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়, যা কার্যকর হয় ওই বছরেরই ১৬ ডিসেম্বর থেকে। সেই সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতি ছিল—১. জাতীয়তাবাদ, ২. গণতন্ত্র, ৩. সমাজতন্ত্র এবং ৪. ধর্মনিরপেক্ষতা। অর্থাৎ সংবিধানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। এর পর ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের শুরুতে প্রস্তাবনার আগেই ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম' (দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করলাম) কথাটি সংযোজন করা হয়।
এখন বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে রাষ্ট্রধর্ম থাকা না-থাকাটা একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। ‘ইসলাম' যেমন রাষ্ট্রধর্ম আছে, তেমনি এটাও পরিষ্কার উল্লেখ আছে যে দেশটিতে সব ধর্মের মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তা সমান। ফলে এটা থাকায় সমাজের একটি ধর্মান্ধ অংশ আত্মতুষ্টিতে ভোগে, কিন্তু আইনের বিচারে সেটা তাদের কোনো বাড়তি সুবিধা দেয় না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, রাষ্ট্রধর্ম থাকা বাংলাদেশে কোনো ধর্মভিত্তিক দল স্বাধীনতার পর আজ অবধি এককভাবে ক্ষমতায় আসতে পারেনি। ভবিষ্যতে পারবে এমন কোনো ইঙ্গিতও নেই; বরং প্রধানতম রাজনৈতিক দলগুলো তাদের চারিত্রিক দুর্বলতার কারণেই ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়। তবে আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয় এবং সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চায়। কোনো উসকানিতে তা নষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ