নতুন জাতির জন্ম ১৯৭১: জাতিসংঘের সাফাই
১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হইয়াছে তখন সম্মিলিত জাতিসংঘের (অথবা এককথায় জাতিসংঘের) মহাসচিব ছিলেন বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ বর্মামুলুক বা মিয়ানমারের কূটনীতি ব্যবসায়ী উ থান্ট। উ থান্ট ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই বিশ্বসভার মহাসচিব (বা প্রধান কর্মকর্তা) ছিলেন। ভালমানুষ পরিচয়ে তাঁহার বড়ই সুনাম ছিল। তিনি অপেক্ষাকৃত কম বয়সে- মাত্র ৬৫ বছরে- মারা গিয়াছেন ১৯৭৪ সালে। অবসর লইবার পর জাতিসংঘের স্মৃতিচারণ করিয়া তিনি একখ- বইও লিখিয়াছিলেন। তাঁহার পরলোকগমনের চারি বছর পর- ১৯৭৮ সালে-বইটি প্রকাশিত হয়। বইয়ের নাম- বড়ই মজার-‘জাতিসংঘের চোখে। এই বইয়ে বাংলাদেশের জন্ম বিষয়ে কিছু কথা পাওয়া যায়।
১
উ থান্ট প্রথমেই লিখিয়াছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা। বর্তমানে বাংলাদেশে স্বাধীনতা ঘোষণার কাহিনী লইয়া যে নির্বোধ কুতর্ক জারি আছে তাহার সমাধানের মধ্যে উ থান্টের স্মৃতিকথা প্রাসঙ্গিক। ইহাকেও সাক্ষী মানা যাইতে পারে। উ থান্ট লিখিয়াছেন, ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখে জাতিসংঘের পাবলিক ইনফর্মেশন আপিস বা জাহিরী তথ্য বিভাগ তাহাদের কলিকাতা দপ্তর হইতে নিউ ইয়র্কে- সদর দপ্তরে- একটি বার্তা প্রেরণ করে। বিষয়: বাংলাদেশের ঘটনা। আমি ওই বার্তার তর্জমা দিতেছি।
“আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান এই শুক্রবার পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াছেন। দেশের নাম দাঁড়াইয়াছে ‘বাংলা দেশের গণ প্রজাতন্ত্র’ (পপুলার রিপাবলিক অব বাংলা দেশ)।”
“খবরটি পাওয়া গিয়াছে ভারতীয় সংবাদ সংস্থার দপ্তরে। এই খবর তাঁহারা পাইয়াছেন ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ (ভয়েস অব দি ফ্রি বাংলা দেশ রেডিও) হইতে প্রচারিত ঘোষণায়। আরও খবর পাওয়া গিয়াছে সেখানে সশস্ত্র সংঘাত চলিতেছে।”
উ থান্ট লিখিয়াছেন, ২৬ মার্চের পরের কয়েক দিন খবর পাওয়া যাইতেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে ‘ব্যাপক সংখ্যায় মানুষ হত্যা’ করিতেছে। সঙ্গে আরও নানান ধরনের নৃশংসতার খবর পাওয়া যাইতেছিল। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এমন খবর পাওয়ায় পর জাতিসংঘ কি করিতেছিল। উত্তর- এককথায় বলিতে গেলে- কিছুই না। এহেন শান্তিনাশা সংকটে জাতিসংঘ কেন কিছুই করিতে পারে নাই তাহার একটা কৈফিয়ত দেওয়ার চেষ্টা উ থান্ট মহোদয় করিয়াছেন।
তিনি স্বীকার করিয়াছেন, মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ না যাইতেই পূর্ব পাকিস্তান হইতে মানুষজন বিপুল সংখ্যায় পাশের দেশ ভারতে আশ্রয় লইতেছিল। সে খবর তাঁহারা সুদূর জাতিসংঘের সদরে বসিয়াও পাইয়াছিলেন। কিন্তু কাজের বেলায় কিছুই করিতে পারেন নাই। কেন পারেন নাই? মহাসচিব উ থান্টের মতে ইহার প্রথম কারণ ছিল পাকিস্তানের বিরোধিতা। পাকিস্তানের বক্তব্য, ভারত বাঙ্গালিদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিতে উস্কানি দিয়াছে আর বাঙ্গালি ‘মুক্তিযোদ্ধা’দের ভারতভূমিতে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হইতেছে।
উ থান্ট তারপর বলিতেছেন, ঘটনা আরও ঘোরাল হইয়া উঠিয়াছিল ভারতের কারণে। তাঁহার মতে, পাকিস্তানের মতন ভারতও চাহে নাই সমস্যার সমাধানকল্পে জাতিসংঘ কোন উদ্যোগ গ্রহণ করুক। সেই কারণে জাতিসংঘের ‘নিরাপত্তা পরিষদ’ এই প্রশ্নে অসাধারণ অনীহা দেখাইয়াছিল। ভারত আর পাকিস্তান- দুই পক্ষই- যখন বলিল বিষয়টি তাহাদের স্ব স্ব অভ্যন্তরীণ বা ঘরোয়া ব্যাপার তখন নিরাপত্তা পরিষদের কোন স্থায়ী সদস্যই ইহা লইয়া কোন সভা আহবান করিতে রাজি হইল না। একটিও না।
কথাটি বিশ্বাস করিতে কষ্ট হয়। কিন্তু না করিয়া উপায়ও নাই। পাকিস্তান তো চাহিবেই না ব্যাপারটা লইয়া পৃথিবী মাথা ঘামাক। কিন্তু ভারত কেন চাহিবে না? এখানে আসিয়া ভারতের বিরুদ্ধে একটা স্ববিরোধিতার অভিযোগ উত্থাপন করিয়াছেন উ থান্ট। তাঁহার মতে, ভারত একমুখে বলিতেছিল পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার অবিচারের ফলে উহার নিজস্ব জাতীয় নিরাপত্তা ব্যাহত হইতেছে। দেশটি আরমুখে একই সঙ্গে কহিতেছিল, পাকিস্তানের সমস্যা পাকিস্তানেরই আপনকার। একান্ত ঘরোয়া ব্যাপার। তাহাতে জাতিসংঘের হাত দেওয়া চলিবে না।
এখন প্রশ্ন হইতেছে, জাতিসংঘের মহাসচিব মহোদয় কেন তাঁহার নিজস্ব ক্ষমতার দোহাই দিলেন না। জাতিসংঘ সনদের ৯৯ নং ধারা অনুযায়ী মহাসচিবের একটা ক্ষমতা আছে। তিনি যখন মনে করিবেন কোন ঘটনা বিশ্বশান্তির বিরুদ্ধে হুমকির মতন বাড়িয়া উঠিতেছে তখন সেই ঘটনার দিকে নিরাপত্তা পরিষদের চোখ ফিরাইতে- অথবা প্রচলিত বুলিতে বলিলে- পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারেন তিনি। উ থান্ট তাহাও করেন নাই।
কেন করেন নাই তাঁহার এক জওয়াব এই স্মৃতিকথায় পাই। জওয়াবের সারমর্ম এই রকম। পাকিস্তান আর ভারত কেহই যখন চাহে নাই এই বিষয়ে জাতিসংঘ কিছু একটা করুক তখন নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরাও আপন উদ্যমে কিছু করিতে চাহে নাই। বিষয়টি যে আদৌ আলোচনার যোগ্য তাহাও কেহ মনে করে নাই। বিশেষ করিয়া পাকিস্তান বলিতেছিল, ব্যাপারটি তাহাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার- পাকিস্তানের সহিত আওয়ামী লীগের মামলা বিশেষ। ইহাতে অন্যের নাক গলাইবার প্রয়োজন নাই। অধিকারও নাই।
উ থান্ট সাহেব আপনকার স্মৃতিকথায় দ্বিতীয় জওয়াবটিও প্রকাশ করিয়াছেন। এই জওয়াব অনুসারে তিনি তখন গোপনে একটা আপোস-নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করিয়াছিলেন। প্রকাশ্যে (অর্থাৎ নিরাপত্তা পরিষদে) আলোচনার প্রস্তাব দিলে- ৯৯ নং ধারার আওতায় তলবী সভা ডাকার উদ্যোগ নিলে- সেই গোপন আলোচনাটি ভাসিয়া যাইতেও পারে। তাই তিনি কোন প্রকাশ্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন নাই। এই যুক্তিকে আর যাহাই বলি সবল যুক্তি বলিতে পারি না।
উ থান্ট দাবি করিতেছেন, ঐ সময় ভারত ও পাকিস্তানের সহিত তিনি প্রায় প্রতিদিনই যোগাযোগ রক্ষা করিতেন। করিতেন নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যদের সহিতও। দুঃখের মধ্যে, তাঁহাদের অধিকাংশই বিষয়টি লইয়া আলোচনা করিতে পর্যন্ত রাজি হয়েন নাই। প্রায় চারি মাস ধরিয়া এই ব্যর্থ চেষ্টার পর তিনি একদিন- ১৯৭১ সালের ২০ জুলাই নাগাদ- একপ্রস্ত গোপন স্মারকলিপি সদস্যদের মধ্যে বিলি করিলেন। সাবধানবাণী উচ্চারণ করিলেন, গোটা উপমহাদেশে যুদ্ধের আগুন লাগিয়া যাইতে পারে। জাতিসংঘকে এখনই উদ্যোগ লইতে হইবে। নতুবা আর সময় থাকিবে না। এক মাস পরে- অগস্ট নাগাদ- তিনি স্মারকলিপিটা জনসমক্ষেই ফাঁস করিলেন। একভাবে না হউক অন্য একভাবে ৯৯ নং ধারার আশ্রয় লইলেন। তাহাতেও কাজ হইল না। আবারও চারি মাস পার হইয়া গেল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলিবার কালে নিরাপত্তা পরিষদ একবার বাদে আর কোন সভায় বিষয়টা আলোচ্যসূচিতে গ্রহণ করিয়া বৈঠকে বসে নাই। বসিয়াছিল একবার মাত্র, ডিসেম্বরের ৪ তারিখ। ততদিনে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হইয়া গিয়াছে। ৪ ডিসেম্বরের বৈঠকে কোন সিদ্ধান্ত হইল না। সিদ্ধান্তের মধ্যে একটাই চূড়ান্ত হইয়াছিল। তাহা ৬ ডিসেম্বর তারিখে। ঐদিন ভারত সরকার প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে সরকারীভাবে স্বীকার করিয়া লইয়াছিল। ঐদিনই সোমালিয়ার রাষ্ট্রদূত এ. এ. ফারাহের প্রস্তাবক্রমে বিষয়টি সাধারণ পরিষদে পাঠানো সম্ভব হইয়াছিল। সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটি হইল পরের দিন-৭ ডিসেম্বর। সেখানে যুদ্ধবিরতির পক্ষে ভোট ১০৪, বিপক্ষে ১১, নিরপেক্ষ ভোট ১০। সাধারণ পরিষদের এই ভোটাভুটিকে ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার পরাজয় বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন উ থান্ট।
ঘটনাচক্রে সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত আমলে লইতে কোন পক্ষই বাধ্য নহে। সেই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরাজয়ের মুখে। তাই ভারত ও বাংলাদেশের সম্মিলিত বাহিনী ছিল যুদ্ধবিরতির বিরুদ্ধে। নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সোভিয়েত রাশিয়ার ভেটো বা নাকচ ভোট না পড়িলে যুদ্ধ বন্ধ হইয়া যাইতে পারিত। উ থান্ট দুঃখ করিয়া লিখিয়াছেন, নিরাপত্তা পরিষদ অচল হইয়া পড়িয়াছিল। তাঁহার ভাষায়: ‘বিরোধটা কি লইয়া তাহাও বিরোধের বিষয়বস্তু হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। বিরোধটা কি ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে, না পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে, নাকি ভারত, পাকিস্তান ও ‘বাংলা দেশে’র মধ্যে-তাহা লইয়াও ন্যূনতম ঐক্যমতের ছায়া পর্যন্ত দেখা যায় নাই।’ উ থান্ট দুঃখ পাইয়াছেন এই ঐকমত্যের অভাব দেখিয়া। দুঃখ গোপন করেন নাই তিনি। পাকিস্তান ভাঙ্গিয়া যাইতেছে দেখিয়া তিনি ঢের ব্যথিত হইয়াছিলেন।
২
জাতিসংঘের মহাসচিব আমড়া কাঠের ঢেকি হইয়া রহিলেন। অবস্থাটা তিনি বিসমিল্লাতেই আমল করিয়াছিলেন। তাই মে মাস হইতে শরণার্থী সমস্যার দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করিয়া রহিলেন। মে মাসে প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানকে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার নিয়োগ দিয়াছিলেন তিনি।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করিয়াছিল মার্চ মাসে। তখন জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ করিতে রাজি হয় নাই। তাহারা বড়জোর ‘আনুষঙ্গিক মানবিক সমস্যা’ অর্থাৎ শরণার্থী সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হইয়াছিলেন। জুন মাসের কোন একদিন ‘জাতিসংঘ সংবাদদাতা সমিতি’ উ থান্টের সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করিয়াছিল। সেই ভোজসভায় নাম না জানা এক ভারতীয় সাংবাদিক উ থান্টকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, জাতিসংঘের এই আচরণের, এই অনীহার অর্থ কি। স্মৃতিকথার এক জায়গায় উ থান্ট কবুল করিয়াছেন, এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর তিনি দিতে পারেন নাই। দায় সারিবার মতলবে শুদ্ধ বলিয়াছিলেন, গোটা ব্যাপারটাই দুর্ভাগ্যজনক: ‘মানবেতিহাসের পাতায় সাংঘাতিক বড় একটা কালোদাগ বৈ নয়।’
উ থান্ট মহাশয় আপনকার স্মৃতিকথায় এই বিষয়ে একটা দোহাইও পাড়িয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, মধ্যস্থতাকারী আকারে নিজের নিরপেক্ষতা অক্ষুণ্ণ রাখাই ছিল তাঁহার আসল মতলব। তিনি ধরিয়া লইয়াছিলেন, সমাধানের কোন উদ্যোগ প্রকাশ্যে গ্রহণ করিলে তাঁহার মধ্যস্থতার গোপন সেতুটি ভাসিয়াও যাইতে পারে। এক্ষণে গোপন উদ্যোগের কথাটা বলা যায়। এপ্রিল মাসে উ থান্ট মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুর রহমানকে একটা চিঠি লিখিয়াছিলেন। অনুরোধ করিয়াছিলেন, তিনি যেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আর আওয়ামী লীগের মধ্যে কোন সমঝোতা করা যায় কিনা তাহার চেষ্টা করেন। টুংকু আবদুর রহমান ৩ মে তারিখে-‘আল্লাহর নামে আর মানব জাতির প্রয়োজনে’-এই দায়িত্ব কাঁধে লইতে রাজি হইয়াছিলেন। উ থান্টের চিঠি আর আবদুর রহমানের সম্মতিপত্র উ থান্টের বইয়ের শেষে ছাপা হইয়াছে।
টুংকু আবদুর রহমান অনেক চেষ্টা করিয়াও এই সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করিতে সমর্থ হয়েন নাই। তবে জুলাই মাসের ১৭ তারিখ পর্যন্তও তিনি আশা ছাড়েন নাই। মায় ২৩ তারিখেও না। ২৩ তারিখেও তিনি জেদ্দা হইতে লিখিয়াছিলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার মধ্যে একটা বৈঠক সম্ভব করা যাইতে পারে। কিন্তু ৭ সেপ্টেম্বর নাগাদ তিনি এই উদ্যোগের ব্যর্থতা স্বীকার করিয়া নতুন পত্র লিখিয়াছিলেন উ থান্টকে। টুংকুর শেষ চেষ্টা ছিল ইয়াহিয়া খানের সহিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটা বৈঠক আয়োজন করা। তাঁহার শেষ চিঠিতে তিনি ইয়াহিয়া খানকে সনির্বন্ধ বলিয়াছিলেন, বিচারে যদি দেখা যায় শেখ মুজিব দোষী সাব্যস্ত হইয়াছেন তবু তাঁহার প্রাণ সংহার না করিতে।
এক্ষণে মনে হইতেছে এই ব্যর্থ উদ্যোগের কারণেই পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু করিতে খানিক বিলম্ব করিয়াছিল। সকলেই জানিতেন ২৫ মার্চ রাতে শেখ সাহেবকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বন্দী করে। ইহার পরের তিন মাস তিনি যে কোথায় ছিলেন তাহা কেহ জানিতেন না। এমন কি তিনি আদৌ জীবিত আছেন কি নিহত হইয়াছেন তাহা জানারও কোন উপায় ছিল না। উ থান্ট জানাইতেছেন, এই সময় কেহ- মায় মিত্রপক্ষীয় কোন কূটনীতি ব্যবসায়ী পর্যন্ত- যদি ইয়াহিয়া খানকে একথা জিজ্ঞাসা করিতেন- বলিতেন শেখ মুজিব কোথায়- তিনি রাগিয়া যাইতেন। শেখ মুজিবের সম্মতি ছাড়া কোন রাজনৈতিক মিটমাট যে সম্ভব ছিল না তাহা দিবালোকের মতন সত্য। তাই জাতিসংঘের সঙ্গে জড়িত সকল কূটনীতি ব্যবসায়ীই শেখ মুজিবের প্রাণরক্ষা পাইল কিনা জানিতে গ্রীবা উঁচা করিয়া ছিলেন। এই অবস্থায় মহাশয় উ থান্টও ইয়াহিয়া খান বরাবর শেখ মুজিবের প্রাণ না লইতে অনুরোধ করিয়া পত্র লিখিলেন। ইয়াহিয়া খান সেই পত্রের কোন জওয়াব দেন নাই।
সেই সময় এক ফরাশি সাংবাদিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান স্বীকার করিয়াছিলেন তাঁহার সেনাবাহিনী ঢাকায় অনেক মানুষ হত্যা করিয়াছে। ফরাশি সংবাদপত্র ‘লা ফিগারো’র প্রতিনিধি মন্তব্য করিলেন: ‘[পূর্ব পাকিস্তানে] মৃতের সংখ্যা ২৫০,০০০। একথা তো আপনি অস্বীকার করিয়াছেন, তাই না?’ ইয়াহিয়া খান উত্তরে বলিলেন, ‘সংখ্যাটা আপনি বাড়াইয়া বলিতেছেন। তবে কিছু মৃত্যুর ঘটনা তো ঘটিয়াছেই। ঢাকায় যাহা ঘটিয়াছে তাহাকে আর যাহাই বলেন ফুটবল খেলা তো বলা চলে না। মানুষ যখন যুদ্ধ করে তখন ফুল ছুঁড়িয়া মারে না।’ এই সাক্ষাৎকারের ইংরেজি তর্জমা ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ নামক প্রসিদ্ধ মার্কিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
৩
উ থান্ট লিখিতেছেন, পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার শুরু হইল ১১ অগস্ট। বলাবাহুল্য, খবরটা উ থান্ট তখন তখনই জানিতেন না। সমঝোতার শেষ আশার আলোও নিবিয়া গেল। যুদ্ধের দামামা শোনা যাইতে লাগিল। ২৩ নবেম্বর পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করা হইল। তাঁহার পেটে সাত বছরের পুরানা একটা আলসার বা ক্ষত ছিল। অন্ত্রের সেই ক্ষত সারাইবার উদ্যেশ্যে উ থান্ট মহাশয় এই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ২৭ নবেম্বর তিনি হাসপাতাল হইতে ছাড়া পাইলেন।
২৯ তারিখে দেখা পাইবার আশা বুকে লইয়া তাঁহার বাসায় গেলেন ভারতের রাষ্ট্রদূত সমর সেন। তিনি বলিলেন, পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর জোর লড়াই লাগিয়া গিয়াছে। আরও বলিলেন, তাঁহার দেশের প্রধানমন্ত্রী মহাসচিবের সুস্বাস্থ্যও কামনা করিয়াছেন। আর ৩০ তারিখ গেলেন সোভিয়েত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত এয়াকুব মালেক। মালেক বলিলেন, দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান সমস্যার সমাধান একটাই। কার্যক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা তুলিয়া দেওয়া। ইহার আর কোন অন্যথা দেখেন না তিনি। উ থান্ট লিখিতেছেন, ‘যখন উঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম এমতাবস্থায় নিরাপত্তা পরিষদ কি করিতে পারে, উনি জানাইলেন, পরিষদ যদি সত্য সত্য কিছু করিতে চাহে তো পূর্ব পাকিস্তানের মূল রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করিতে পারে।’
ভারতের রাষ্ট্রদূত চলিয়া যাইবার পর উ থান্ট মহাশয় আপনকার দপ্তর হইতে পাঠান কাগজপত্র ঘাঁটিতে লাগিলেন। এই কয়দিন কাগজ দেখার সময় হয় নাই। হঠাৎ দেখিলেন, কলিকাতা হইতে পাঠান একটি সংবাদ ব্যবসায়ী সংস্থার এক দফা বার্তা। ইহাতে বলা হইয়াছে ‘বাংলা দেশ সরকারের মন্ত্রীসভা’কে খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না। বার্তায় আরো জানান হইয়াছে, ‘নিশ্চিত করিয়া বলা না গেলেও লোকে সর্বত্র বলিয়া বেড়াইতেছে যে মঙ্গলবার (২৩ নবেম্বর) মন্ত্রীসভা বিশেষ বিমানযোগে উড়িয়া নয়া দিল্লী গিয়াছে। তাঁহারা ভারত সরকারের সহিত বৈঠক করিবেন। গুজবে প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁহাদিগকে রাজধানীতে ডাকিয়া পাঠাইয়াছেন একটা কথা বলিবার জন্য। তিনি বাংলাদেশ সরকারকে সরকারীভাবে স্বীকৃত জানাইবেন বলিয়া মনস্থির করিয়াছেন।’
ডিসেম্বরের ৩ তারিখ পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরু হইল। নিরাপত্তা পরিষদ তখনও মূল রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করিতে রাজি হইল না। তাহারা খালি ‘যুদ্ধবিরতি’, ‘যুদ্ধবিরতি’ করিতে লাগিলেন। সোভিয়েত রাশিয়ার প্রস্তাব ছিল যুদ্ধবিরতির সহিত রাজনৈতিক সমাধানটাও যুক্ত রাখা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাহাতে রাজি হইল না। আরেকটা প্রস্তাব ছিল নিরাপত্তা পরিষদে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের ডাকা। তাঁহাদেরও বক্তব্য শোনা। চীন গণপ্রজাতন্ত্র তাহাতেও ঘোর আপত্তি তোলে। এই প্রশ্নে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতিনিধির সহিত তাঁহাদের ঘোর বচসা হয়।
সুতরাং নিরাপত্তা পরিষদের সমস্ত চেষ্টা বিফলে গেল। উদাহরণস্বরূপ, দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের ভিতর- ডিসেম্বরের ৪ তারিখ হইতে ১৫ তারিখের মধ্যে- ঐ পরিষদে সর্বমোট ২৪টি প্রস্তাব পেশ করা হইয়াছিল। তাঁহার মধ্যে একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, একটি সোভিয়েত রাশিয়ার আর একটি ছিল আটটি সদস্য রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রস্তাব। শেষ পর্যন্ত কোন প্রস্তাবই পাশ হয় নাই। পাশ হইয়াছিল মাত্র একটি। কারণ তাহা ছিল যুদ্ধবিরতির আলোচনা সাধারণ পরিষদে স্থানান্তর করার প্রস্তাব। ইহার কথা আমরা আগেই বলিয়াছি।
সর্বশেষ প্রস্তাবটি পাশ হইল ২১ ডিসেম্বর। ততদিনে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করিয়াছে। পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারত একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করিবার পর পাকিস্তানও সেই ঘোষণার অনুগমন করে। জাতিসংঘের শেষ প্রস্তাবে এই যুদ্ধবিরতি মানিয়া চলিতে সবাইকে অনুরোধ জানানো হয়। অনুরোধ জানানো হয়, সকল পক্ষই যেন ১৯৪৯ সালের জেনেবা চুক্তি মোতাবেক যুদ্ধবন্দী ও বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করে।
২৪ মার্চ ২০১৫
দোহাই
১. উ থান্ট, ভিয়ু ফ্রম দি ইউ.এন. (গার্ডেন সিটি, নিউ ইয়র্ক: ডাবলডে, ১৯৭৮)।
সলিমুল্লাহ খান: লেখক ও অধ্যাপক, ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়