সোজা কথা
কেন সন্তানদের হত্যা করছেন মায়েরা?
রাজধানীর বনশ্রীতে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মা নিজ হাতে খুন করলেন তাঁর দুই সন্তানকে। তাঁর শঙ্কা ছিল, পড়াশোনায় ভালো করতে না পারলে সন্তানদের ভবিষ্যৎ কী হবে? এই আশঙ্কা তাঁকে এমন নৃশংস ঘটনা ঘটাতে বাধ্য করল? কী অদ্ভুত! বনশ্রীর এই দুঃসহ হত্যাকাণ্ডের জের কাটতে না কাটতেই আরেক নৃশংস ঘটনা চোখের সামনে চলে এলো। গেল ১৮ এপ্রিল উত্তরার মাস্টারপাড়া সোসাইটির একটি বাসায় মা তার সন্তানকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন করেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে উত্তরখান থানা পুলিশ জানায়,পারিবারিক কলহের জেরে মা তার নিজ সন্তানকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করেছেন। নিহত ওই শিশুর নাম নেহাল সাদিক। মায়ের নাম মুক্তি। বাবা সাজ্জাদ হোসেন পেশায় একজন বিক্রয়কর্মী। স্বামী সাজ্জাদ হোসেন ও স্ত্রী মুক্তির উভয়ের ছিল দ্বিতীয় বিয়ে। বেশ কিছুদিন ধরে তাদের মধ্যে পারিবারিক কলহ চলছিল। সোমবার সকালে সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে মুক্তির ঝগড়া হয়। ঝগড়ার মধ্যেই সাজ্জাদ সকালে কাজে চলে যান। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখেন সন্তান নেহাল সাদিক রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আর স্ত্রী মুক্তিও আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন। তিনি স্ত্রীকে আত্মহত্যার প্রচেষ্টায় বাধা দেন। জানতে পারেন স্ত্রী নিজে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে সন্তানকে খুন করেছেন। বিষয়টি জানাজানি হলে উত্তরখান থানা পুলিশ গিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।
কী ঘটছে এসব? যে ঘটনার কথা কল্পনা করতেও কষ্ট সেই ঘটনা একের পর এক ঘটে চলেছে আমাদের চারপাশে। গত ৭ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। পারিবারিক কলহের জেরে সিরাজগঞ্জের রতনকান্দি ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামে মায়ের হাতে খুন হয় ফুটফুটে শিশু তানভিন হাসান। একমাত্র পুত্রসন্তান হওয়া সত্ত্বেও জন্মের পর বেশি দিন পৃথিবীতে থাকা হয়নি তার। মাত্র ১১ মাসের মাথায় মায়ের হাতে মৃত্যু হয় তানভিনের। হত্যার পর শিশুটির লাশ সুটকেসে ভরে ঘরের ভিতর লুকিয়ে রেখেছিলেন পাষাণ মা রুবিয়া খাতুন (৩০)। এ ঘটনার কিছুদিন পরই পিরোজপুরে তামিম নামে চার বছরের এক শিশুকে পানির সঙ্গে ইঁদুরের ওষুধ মিশিয়ে তা খাইয়ে হত্যা করেন তার মা জায়েদা বেগম। এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যেও ছিল পারিবারিক কলহ।
২৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় সৎ মায়ের হাতে খুন হয় চার বছরের মরিয়ম। আর এভাবেই কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাব-মায়ের হাতে নির্মম হত্যার শিকার হয়েছে শিশুরা। কেবল বাবা-মা নন, ঘরে-বাইরে কারো হাত থেকেই নিস্তার পাচ্ছে না নিষ্পাপ শিশুরা।
গত দুই বছরে বাবা-মায়ের হাতেই খুন হয়েছে অন্তত ৯০ শিশু। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএফ) তথ্যানুসারে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ২৯ শিশু খুন হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে খুন হয়েছে ২০ শিশু। চলতি বছর এ পর্যন্ত খুন হয়েছে ৫৬ শিশু। এরমধ্যে বাবা-মায়ের হাতে খুন হয়েছে ৯ শিশু। ২০১৪-তে এ সংখ্যা ছিল ৪১ জন। আর ২০১৫-তে বাবা কিংবা মা খুন করেছে ৪০ শিশুকে।
ফোরামের পরিসংখ্যান বলছে গত চার বছরে এক হাজার ৮৫ শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ২৯২, ২০১৪ সালে ৩৫০, ২০১৩ সালে ২১৮ ও ২০১২ সালে ২০৯ শিশু খুন হয়েছে। শিশু হত্যার এসব ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাম্প্রতিককালে বাবা-মায়ের হাতে বিশেষ করে মায়ের হাতে শিশু খুন হচ্ছে বেশি। আর এসব খুনের পেছনে পারিবারিক কলহ, বাবা-মায়ের অনৈতিক সম্পর্ক, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, মাদকাসক্তি এবং অপহরণ বা মুক্তিপণ দাবিই বেশি দায়ী। গত বছর ৪৩ শিশু তার মা, বাবা বা কোনো আত্মীয়র হাতে প্রাণ হারিয়েছে।
এসব অস্বাভাবিক হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানদের আন্তঃসম্পর্কের মাত্রা তলানিতে চলে যাচ্ছে। শহরগুলোতে বাড়ছে একক জীবনযাপন করা মানুষ। ভোগবাদী সংস্কৃতির কারণে, টাকার পেছনে ছুটছে অনেকেই। ফল হিসেবে ভেঙে পড়ছে পারিবারিক ও সামাজিক দায়-দায়িত্ব-মূল্যবোধ। হত্যাকাণ্ডগুলোর ধরন এবং হত্যাকারীদের মানসিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, নানাভাবে আমাদের ভেতরে অন্যায় কার্যক্রম বেড়ে গেছে, এখন তারই প্রতিফলন হচ্ছে সমাজে। কারণ আমাদের নেতিবাচক যে মনোবৃত্তি সেটাকে যখন মুক্ত করার চেষ্টা করি তখন অবশ্যই দুর্বল এবং যে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না এমন কাউকেই খুঁজে নেই। আর এ কারণেই এমন ঘটনার শিকার হচ্ছে শিশুরা।
এসব অস্বাভাবিক ও স্পর্শকাতর হত্যাকাণ্ডের জন্য দুর্বল পারিবারিক বন্ধন, ভোগবাদী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের অবক্ষয়কে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকার বনশ্রীতে মায়ের হাতে দুই শিশু হত্যার অভিযোগ ওঠার পর থেকেই পরিবার ও সমাজ কাঠামো নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়ছে পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক যোগাযোগ। এসব থেকেই জন্ম নিচ্ছে সহিংসতা, শিশুর প্রতি নির্মমতা।
স্বীকারোক্তিতে মা মাহফুজা জানিয়েছিলেন, হত্যার কারণ হচ্ছে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা। শুধু দুঃশ্চিন্তা থেকেই কি সন্তানকে কোনো মা হত্যা করতে পারে?
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য ভেদ করতে, জানতে হবে অভিযুক্তের শৈশব-কৈশোর, সামাজিক-পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনকে। এ ধরনের হত্যা ঠেকাতে আচরণ, নৈতিকতা ও ব্যক্তিত্ব গঠন বিষয়ে স্কুলগুলোতে সন্তান ও বাবা-মাদের নিয়ে কর্মশালা করার পরামর্শ দেন তাঁরা। যদি আমরা উত্তরার মুক্তির কথাই ভাবি, তিনি তাঁর পারিবারিক অশান্তির জেরে সন্তানকে বীভৎসভাবে খুন করতে পেরেছেন।
সম্প্রতি শিশু নির্যাতনের হার যতটা না বেড়েছে তার চেয়ে এর ধরন পাল্টেছে বেশি। সমাজবিজ্ঞানী, মানবাধিকারকর্মী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয়ই শিশু হত্যার বড় কারণ। দেশে বড় ধরনের ঘটনা ঘটলে তোলপাড় হলেও শিশুদের সুরক্ষায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আর একটি শিশু যখন তার নিজের ঘরেই বাবা-মায়ের কোলে নিরাপত্তা পাচ্ছে না তখন স্বাভাবিকভাবেই সরকারকে তাদের সুরক্ষার জন্য নতুন করে চিন্তা করতে হবে। তারা দায়ী করছেন, আকাশ সংস্কৃতি ও অনলাইন প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব, মাদক ও বিচারহীনতার কারণেই মানুষের ‘বিকৃত আচরণ’ বারবার ফিরে আসছে। বিশেষজ্ঞদের মতে নির্মম আচরণ থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হলে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে কাউন্সিলিং করতে হবে।
স্বামী-স্ত্রীর কেউ পরকীয়ায় জড়ালেও শিশুরাই হামলার শিকার হয়। আমরা পরিবারে সময় দিতে পারছি না। আগের দিনে দাদা-দাদি, নানা-নানি পরিবারে শাসন করতেন। এখন এককেন্দ্রিক হয়ে গেছি আমরা। বিশেষ করে এখন বিদেশি সিরিয়ালগুলোর প্রতি বেশি আকৃষ্ট সবাই।কিন্তু বিদেশি কোনো চ্যানেল ভালো মেসেজ দিচ্ছে না। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব পড়ছে দেশে। খুনোখুনির দৃশ্য বিভিন্ন সিরিয়ালে দেখে প্রভাবিত হচ্ছেন অভিভাবকরাও। তাদের কাছে খুন বিষয়টি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বর্তমানে বিদেশি চ্যানেল থেকে ডাবিং করে দেশি চ্যানেলগুলোও সিরিয়াল তৈরি করায় সরাসরি এ দেশের সংস্কৃতিতে এসব ঢুকে পড়ছে।
এদিকে শিশুদের নিয়ে যে প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তাদের কার্যকর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তাঁরা বলছেন, মানবাধিকার সংগঠন ও পুলিশ প্রশাসন শিশুদের নিরাপত্তায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। কেউ কেউ বলছেন, নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ এবং সভা-সেমিনারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে এনজিওর কার্যক্রম। এদিকে শিশুদের সহায়তা দিতে প্রতিটি থানায় ‘শিশু ডেস্ক’ চালু করার কথা থাকলেও এর বাস্তবায়ন হয়নি এখনো।
সামাজিক সহিংস মনোভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় শিশু নির্যাতন বেড়েছে। আমাদের সমাজে বৈষয়িক হতাশা এখন প্রকট। এর ফলে ক্রোধ, প্রতিহিংসাপরায়ণতাও বাড়ছে। বিজ্ঞান, ধর্ম বলে নিজের সন্তানকে কখনো মা হত্যা করতে পারে না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখছি মা নিজের সন্তানকে হত্যা করে আত্মঘাতী হয়েছেন। বৈষয়িক দ্বন্দ্ব-হতাশা থেকেই এমন ঘটছে। মানুষ নিজেকে যখন অনিরাপদ ভাবে তখন খুনের মতো ঘটনা ঘটাতে পারে। এর মধ্যে মাদক, ব্যক্তিগত স্বার্থ, আর্থিক স্বার্থ বিভিন্ন কিছু রয়েছে। এটা এখন একটি সামাজিক সমস্যা। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে হতাশার উৎসগুলো খুঁজতে হবে। প্রচার-প্রচারণার কারণে বিচার হওয়ায় যেমন এসিড সন্ত্রাস কমেছে তেমন সাম্প্রতিক সময় শিশুদের ওপর যে ঘটনা ঘটছে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে এসব ঘটনাও ঠেকানো যাবে বলে মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ