প্রতিক্রিয়া
পরীক্ষায় জিপিএ ৫ ও শিক্ষার মান
জিপিএ ব্যাধিটা খানিকটা সংক্রামকই মনে হচ্ছে আজকাল! দিনের পর দিন এর অত্যাচার যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে কখনো আপনার চোখটা আটকে যেতে পারে এমন সংবাদে, ‘সন্তানের জিপিএ পাঁচ না পওয়ায় বাবা-মায়ের আত্মহত্যা!’ ভাবছেন বাড়িয়ে বলছি কি না? মোটেও না। বিষয়টা নিয়ে আজ শুধু ভাবার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এটা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। আজকাল যেকেনো পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের সাথে সাথেই শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা দেখলেই বোঝা যায় জিপিএ ৫ না পেলে আমাদের শিক্ষার্থীরা কী ধরনের মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকে। হালের নতুন সংযোজন গোল্ডেন জিপিএ পেতে হবে! পেলে তো ভালোই। ভালো রেজাল্ট করলে সেটা মঙ্গল। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়।
কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা এই জিপিএর দৌড়ে শামিল সেটা লক্ষ করা প্রয়োজন। আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই সৃজনশীলতা বৃদ্ধি, সক্ষমতা বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে, দেশীয় সংস্কৃতির লালন আর দেশপ্রেমের চেতনার কোনো প্রতিফলন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কিংবা এর ফলাফলের ওপর দেখতে পেতাম তাহলে সেটা ভলোই হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার খানিকটা লোক দেখানোর জন্য ফলাফল বাড়িয়ে দেওয়া আরো নানাবিধ অপ্রাসঙ্গিক কারণে যাচ্ছেতাই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করার যে ধারা বর্তমান; সেটা শিক্ষার গুণগত মানে কোনো পরিবর্তন আনছে না।
পরিসংখ্যান বলছে পাসের হার বাড়ছে এবং সেটা বাড়ছে বেশ দ্রুত গতিতে। অদূর ভবিষ্যতে ১০০ ভাগ পাসের কোনো ফলাফল দেখলেও চমকিত হওয়ার কিছু থাকবে না। এটা নিশ্চিত কোনো দেশের প্রকৃত উন্নয়নের জন্য ১০০ ভাগ শিক্ষার প্রয়োজন আছে তবে পাসের নয়। আর পাস করার এ দায় সবটুকু কেন রাষ্ট্র নেবে? পরীক্ষায় পাস করার জন্য আমাদেরও কিছুটা দায় নিতে হবে। পড়াশোনা করতে হবে। নইলে শুধু সরকার পাস করিয়ে দিলেই একশত ভাগ শিক্ষা নিশ্চিত হবে না। একই বৃত্তে বন্দি থাকব আমরা। সার্টিফিকেট পাব কিন্তু শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। পাবলিক পরীক্ষায় বসলেই, উপযুক্ত হোক আর নাই হোক, তাকে পাস করাতেই হবে। এই যে মানসিকতা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চলেছি; সেটাতে শিক্ষার গুণগত মানের বেহাল দশা প্রকাশ পাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটু পরিসংখ্যানে চোখ বুলিয়ে আসা যাক। ১৯৯০ সালে এসএসসিতে পাস করা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ছিল ৩১ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর এবারের এসএসসি পরীক্ষায় পাস করা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৮৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। পার্থক্যটা চোখে পড়ার মতো। আর সবমিলিয়ে এবারের জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা এক লাখ ৯ হাজার ৭৬১ জন। মোট ১৬ লাখ একান্ন হাজার ৫২৩ জন শিক্ষার্থী এবারের এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। যেখানে, ২০০১ সালে জিপিএ ৫ পেয়েছিল মাত্র ৭৬ জন! শিক্ষার্থীদের সংখ্যাটাও ওঠানামা করেছে তত দিনে। কিন্তু অনুপাতটা বোধ হয় আকাশ পাতাল ফারাক। এটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কেউ কেউ বলে বসতে পারেন। তখন কেউ বিষয়টা বুঝে উঠতে পারিনি বলে এই সমস্যা। কথাটা ঠিক তখন জিপিএ বিষয়টা অনেকেই বুঝত না। আজকাল সবাই এটা বোঝে। আর এই বোঝাটাই হয়েছে কাল। এজন্যই শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অভিভাবক সবাই আজ শুধু জিপিএর পিছনে ছুটে চলেছে। ঠিকমতো না পড়লেও চলবে! রেজাল্টের শেষে জিজ্ঞেস করবে জিপিএ কত? উত্তরটা পজেটিভ হলেই হয়। জিপিএ ঠিক তো, সাত খুন মাফ!
এভাবে চলাটা নিরন্তর, থামছেই না! এজন্য প্রশ্নপত্র ফাঁস থেকে শুরু করে যা করা যায় সেটা করতে প্রস্তুত সবাই। গত কয়েক বছরের প্রশ্নপত্র ফাঁসের চিত্র দেখলে আমাদের কাছে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ কাজের সাথে পারিবারিক একটা যোগসূত্র থাকে। যেখানে পরিবারই একজন শিক্ষার্থীকে অনৈতিক হতে শেখায়। আর এটা জিপিএ ভালো করতে, অন্যকিছুর জন্য নয়। প্রসঙ্গক্রমে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক প্রধান শিক্ষক খুব আক্ষেপ করে বললেন, পরীক্ষার আগের রাতে পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী যদি বলে; স্যার, আগামীকাল পরীক্ষার প্রশ্নটা একটু ম্যানেজ করে দেন না? তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। সারাটা বছর স্কুলে শিক্ষকরা মিলে কী করলাম! ধমক দেওয়ার পর উত্তর আসে- স্যার, আমি তো চাইনি আপনাকে ফোন দিতে, বাসা থেকে বলল তাই।
জিপিএ খারাপ হলে পরিবারের মানহানি হবে এজন্যই এ ধরনের অসাধু পথে পা বাড়াচ্ছেন অনেকে। যদি সেটা প্রশ্নপত্র চুরিও করতে হয়, টাকা দিতে রাজি আছে পরিবার। শিক্ষার্থীরাও তাই সহজে ভালো রেজাল্ট করছে। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান আর নৈতিকতা কোথায় যাচ্ছে- সেটা কেউ ভাবছে কি? এ প্লাস তোমাকে পেতেই হবে। যে ভাবে হোক সেটা না হলেই নয়। এসব এ প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থীদের পরের হালটা হয় আরো ভয়ংকর। কোনো ভালো কলেজে না পায় পড়ার সুযোগ না করে পরবর্তী সময়ে ভালো ফল। ওখানে আরেক সংকট। সাথে যোগ হয় এইচএসসি পাসের পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা একের পর এক ডাব্বা! বিষয়গুলো সবার সাথে ঘটছে বা গড়পড়তা সবাই এটার জন্য দায়ী সেটা বলা যাবে না। কিন্তু একটা শ্রেণী যে এ চক্রের মধ্যে পড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে সেটা বলতেই হবে।
এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর কয়েক ঘণ্টা না পেরুতেই বরিশালে এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। সমবেদনা ও পরিবারের জন্য। এই আত্মহত্যার দায়ভার কার? পরিবারের না রাষ্ট্রের? একই কারণে প্রতিবছর বেশ কিছু শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করলেও, কার্যত কোনো পদক্ষেপ নিতে আমরা ব্যর্থ। এটা জীবন সংশ্লিষ্ট বলে সামনে চলে আসে। কিন্তু শুধু জিপিএ কম হওয়ার কারণে আরো অনেক মানসিক সমস্যায় পড়ছে শিক্ষার্থীরা অথবা একটা খারাপ করলেই হায় হায় রব পড়ছে চারপাশে। কিন্তু কেন? খারাপ করলে সে যে আগামীতে ভালো করবে না সেটা তো নয়। পরিচিত এক পরিবারের সন্তানটি গোল্ডেন এ প্লাস না পাওয়ার আক্ষেপে মন খারাপের খবরটা ছড়িয়ে পড়ল আত্মীয়স্বজনের মধ্যে। অন্যদিকে সারাদিন কাজের পর নৈশ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী যে কি না পাস করার মহানন্দে আকাশে উড়ছে। এই দুটা পাশের মধ্যে আপনি কোনটাকে কীভাবে মূলায়ন করবেন সেটা বলা যায় না। কিন্তু আপাতত দৃষ্টিতে মনে হয় নৈশ বিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থীই জয়ী। নিজের প্রয়োজনে সে শিখেছে এবং এ শিক্ষা তাকে পরমানন্দে আন্দোলিত করেছে। প্রকৃত শিক্ষা এটাই যেটা মানুষের বাস্তব জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে।
শিক্ষার হার ক্রমেই বাড়ছে সেটা মানতেই হবে। কিন্তু মানের ক্ষেত্রে আপস হলে সেটা কোনো ভাবেই কাম্য নয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বাস্তবমুখী শিক্ষা ও মূল্যায়ন যতটুকু প্রয়োজন। তার থেকেও বেশি প্রয়োজন পদ্ধতিগত জটিলতা মুক্ত রাখা। যেখানে শুধু পদ্ধতিটাই মুখ্য হয়ে না দাঁড়িয়ে শিক্ষাটাই সামনে চলে আসবে। এ ক্ষেত্রে জিপিএর দৌড়ে পা না রেখে শিক্ষার গুণগত মানের দিকে নজর আরো বাড়াতে হবে। মূল্যায়ন পদ্ধতিটাও সংস্কার আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতার চর্চাটা আরো বাড়াতে পারলে প্রশ্ন ফাঁসের মতো জঞ্জাল কমানো সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা আর দায়িত্বশীলতা। আগামী সুন্দর প্রজন্ম গড়তে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি লক্ষ রাখা আজ সময়ের দাবি।
লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়