ফুটবল
বাংলাদেশের ফুটবলীয় সৌরজগতের গ্রহ-নক্ষত্ররা
ভাবমূর্তি- শব্দটার ভার অনেক বেশি। ব্যাপ্তিও অনেক বড়। বাংলাদেশ কেন, বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনেও অনেক তারকা-মহাতারকা তাঁদের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পারেননি। তালিকা দিতে গেলে সেটা অনেক লম্বা হবে। মাঠে, জীবনযুদ্ধে অনেক কিছু অর্জন করেছেন তাঁরা। আবার ধরে রাখতে পারেননি। ব্যালান্স নষ্ট হয়েছে। জীবনের ভরকেন্দ্রে ভারসাম্যটা ঠিক থাকেনি। বা ঠিক রাখতে পারেননি। খ্যাতির ভারসাম্য হারিয়ে চূড়া থেকে গড়াতে গড়াতে অনেক নিচুতে নেমে গেছেন। হতাশা আর বিষণ্ণতা ছায়া সঙ্গী হয়ে গেছে তাঁদের। বাংলাদেশ ফুটবলের অনেক সাবেক তারকার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে; তাঁদের খ্যাতির ঝাড়লণ্ঠন বাতি নিভে গেছে। আর তার নিচে তাঁরা শুধু বিষণ্ণ নায়কের ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে।
গেল সপ্তাহে বাফুফের নির্বাচনের দিনে অনেক সাবেক তারকা ফুটবলারের আনাগোনা ছিল হোটেল রেডিসনে। পাঁচ তারকা সেই হোটেলে আরো কত তারকা। কিন্তু নির্বাচনী সেই উৎসবের মাঝেও অনেকে নিজেকে এমনভাবে মেলে মেলে ধরলেন, তা দেখে কষ্ট হলো! কারণ, এই লোকগুলোর খেলা দেখতে কত রোদ-ঝড়-বৃষ্টি-ঠান্ডা-কুয়াশা মাথায় নিয়ে মানুষ মাঠে হাজির হয়েছে। সেই লোকগুলোর কাউকে দেখে মনে হয়েছে উদ্ধত। কাউকে মনে হয়েছে অর্থলোভী! কাউকে দেখে মনে হয়েছে, কিছু মানুষের ক্ষমতা আর অর্থের কাছে অনেক শ্রম-ঘাম-রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সম্মানটুকু বিকিয়ে দিতেও দ্বিধা করছেন না! বাংলাদেশ ফুটবলে মাঠের দীনতা ফুটে ওঠার আগে মাঠের বাইরেই সেটা বেশি ফুঁটে উঠছিল! তা না হলে এই বাফুফে নির্বাচন নিয়ে এত কথা উঠবে কেন? কেন অভিযোগ উঠবে অর্থের ছড়াছড়ি আর ক্ষমতার দাপাদাপির। যাঁরা নির্বাচনে লড়লেন তাঁদের মধ্যে আপাদমস্তক সংগঠকের চেয়ে সাবেক ফুটবলারের সংখ্যাধিক্য। তাহলে কী ফুটবল ছেড়ে এঁরা সবাই এখন ফুটবল সংগঠকের বদলে ফুটবলীয় ক্ষমতার সাধক বনে যেতে চাচ্ছেন!
আসলে সবাই চেয়েছেন ক্ষমতা। ক্ষমতার অংশীদারত্ব। যাদের এই দুটোর কোনোটার সুযোগ নেই, তাঁরা চেয়েছিলেন অন্যদের ক্ষমতা থেকে টেনে নামাতে। আসলে কেউ ফুটবল নিয়ে বিশেষভাবে তেমন কিছু ভাবেননি। ‘অর্থ আর ক্ষমতা’ নামক দুটো স্যালাইন দিয়ে ফুটবলকে বাঁচানো যায় না। আবার এটাও সত্যি বাংলাদেশ ফুটবলের বর্তমান যে অবস্থা তাতে অর্থ এবং ক্ষমতা এই দুটোরই খুব দরকার!
অর্থ দরকার ফুটবলের মান উন্নয়নে। সংগঠক উৎপাদনে নয়। ক্ষমতা দরকার ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্য নয়। ক্ষমতার শীর্ষ থেকে ফুটবলের উন্নয়ন আন্তরিকভাবে চাইলে, বাংলাদেশ ফুটবলের চেহারা কিছুটা পাল্টাতে পারে। সেটা বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন দেখার জন্য নয়। ফুটবল প্রিয় জাতি হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে হলেও ক্ষমতাসীনদের এগিয়ে আসতে হবে। নতুন পরিকল্পনা, নতুন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে। বাফুফের নির্বাচনের দিন তিনেক পর সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন বেসরকারি এক টেলিভিশনে লম্বা সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বারবার বলছিলেন, ‘ফুটবলের মান উন্নয়নে সবার আগে দরকার সরকারের সহায়তা এবং আমাদের একটা দীর্ঘ পরিকল্পনা। যেমন, করছে চীন এবং এই ক্ষেত্রে চীনের রাষ্ট্রপতি নিজেই চীনা ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতিকে ডেকে বলেছেন, আমি-ই তোমার পরার্মশক। আমি-ই তোমার পৃষ্ঠপোষক। আমাকে পরিকল্পনা দাও। ওরা ২০৫০ সালকে সামনে রেখে একটা পরিকল্পনা করেছে। আমরা তেমন কিছু একটা পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে চাই।’
বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন কথাগুলো যেদিন বললেন, তার দুদিন পর সিএনএনে সারা দিন খেলার খবরে দেখা গেল, চীনা সরকার ফুটবল উন্নয়নে কী পরিকল্পনা করছেন,কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছেন এবং করবেন তা নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন। এবং বারবার সেটা প্রচার করা হলো! কাজী সালাউদ্দিনকে নিয়ে অনেক কথা বলা যেতে পারে, তাঁর সময়ে বাংলাদেশ ফুটবলের চেহারাটা তেমনভাবে পাল্টালো না কেন, এ রকম প্রশ্নও তোলা যাবে, তবে ওই দিন নতুনভাবে বেশ কয়েকটা বিষয় আবিষ্কার করা গেল। আর্ন্তজাতিক ফুটবল নিয়ে এ দেশে অন্য অনেকের চেয়ে তাঁর ধারণাটা স্বচ্ছ। পরিষ্কার এবং তিনি আন্তর্জাতিক ফুটবলের খোঁজ-খবরটা বেশি রাখেন। বাংলাদেশ ফুটবলে সালাউদ্দিনের সাম্রাজ্যটা এমনি এমনি গড়ে ওঠেনি। আকাশস্পর্শী জনপ্রিয়তাও তিনি হঠাৎ করে পাননি। সেই জনপ্রিয়তাও তিনি উপভোগ করতে জানেন। আর জানেন বলেই ফুটবল মাঠ ছেড়ে আসার পরও তাঁর নামটা এত প্রভাবশালী বাংলাদেশ ফুটবলে! তাঁর জনপ্রিয়তাও বাংলাদেশ ফুটবল অলিন্দে তীব্র আলোচিত।
সেটা জেনে এবং মেনে নিয়েই নিজের মনে আরো কিছু প্রশ্ন জাগে; তাঁর সমসাময়িক তারকাদের সঙ্গে কোথায় গিয়ে পার্থক্য হয়ে গেল সালাউদ্দিনের? সেই উত্তরের জন্য নিজেকে খুব বেশি কষ্ট করতে হলো না! ওই নির্বাচনের দিনই পেয়ে গেলাম। না ভোটারদের সিল মারা ব্যালটে নয়। পেলাম নির্বাচন চলার সময় রেডিসনে স্থাপিত বাফুফের অস্থায়ী মিডিয়া সেন্টারের বাইরে দাঁড়িয়ে। জুনিয়র এক সাংবাদিক সাবেক এক ফুটবলারকে বলছিলেন, ‘সালাউদ্দিন ভাইয়ের মতো কিংবদন্তি যদি হেরে যান, সেটা আপনাদের জন্যই লজ্জার!’ সেখানে এই লেখক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রোতা ছাড়া অন্য কিছু নন। কিন্তু যে উত্তর শুনলাম, তাতে বুঝলাম কেন, কাজী সালাউদ্দিন অন্যদের চেয়ে এগিয়ে! কারণ, কাজী সালাউদ্দিনেরই এক সময়ের ক্যাপ্টেন, খ্যাপাটের মতো বিরক্তি ছড়িয়ে বললেন, ‘সালাউদ্দিন যদি কিংবদন্তি হয়, তাহলে আমি মহাকিংবদন্তি।’
নিজেই যিনি নিজেকে ‘মহাকিংবদন্তি’ বলে গেলেন,তাঁকে মহাকিংবদন্তির তালিকায় না হলেও উঁচু মানের ফুটবলারের সারিতে রাখবেন অনেকেই এবং সেই অনেকের তালিকায় একটা নাম- কাজী সালাউদ্দিন। নির্বাচনের দিন তিনেক পর তাঁর দেখা বাংলাদেশের সেরা তিনজন ফুটবলারের নাম বলতে গিয়ে কাজী সালাউদ্দিন এই লেখককেই বলেছেন, ‘ওই অর্থে সেরা বলব না। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিনজন ভালো ফুটবলার বাছতে গেলে আমার তালিকাটা এ রকম: এক, এনায়েত। কারণ, ওর মধ্যে ভালো করার তাগিদটা সব সময় ছিল।দুই, পিন্টু ভাই এবং তিন, নান্নু।’ সত্যি বলতে কী, দ্বিতীয় নামটা শোনার পর চোখের সামনে ভেসে উঠল বাহাত্তর ঘণ্টা আগে হোটেল রেডিসনের সেই দৃশ্য! যে কারণে, কাজী সালাউদ্দিনের কাছে আর ‘কেন’ প্রশ্নটাও করা হলো না! কারণটা জানতে চাইছি না দেখে তিনিও কী একটু বিস্মিত হয়েছিলেন কী না জানি না! কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কাজী সালাউদ্দিন নিজে আর একটা নাম বললেন, ‘ আমি নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না, ওয়াসিম কেন বড় তারকা হতে হতেও হতে পারল না! এটা আমার কাছে এক রহস্য। ওর মধ্যে অনেক কিছুই ছিল! অথচ পারল না!’
আসলে সাফল্যকে ধারণ করার ধরনও একেক জনের একেক রকম। পার্থক্যটা হয়ে যায় সেখানেও। অনেকে বলেন প্রতিভাবানদের মধ্যে ভাগ্যও অনেক সময় পার্থক্য গড়ে দেয়। হয়তো তাই। হয়তো তা নয়। এখানে মন আর মননও একটা বড় ব্যাপার। তা না হলে বাফুফের নির্বাচনের সময় সমালোচনার বিষ যেভাবে গিলতে হলো একজনকে, তিনি তা গিলে নিয়ে আবার মন দিতে চাইছেন কাজে! অন্যরা বিষটা উগ্রে দিতে চাইতেন।
এ কারণে বোধহয় বাংলাদেশের ফুটবলীয় সৌরজগতে কে গ্রহ, কে নক্ষত্র, কে উপগ্রহ সেটা ফুটবল ঈশ্বরই ঠিক করে রেখেছেন। যে যার কক্ষপথেই ঘুরছেন।
শুধু অনেকে বুঝতে পারেন না ফুটবল জীবনে সাফল্য এসেছিল অদৃষ্টের আপন নিয়মে। আবার চলেও গেছে সেই একই নিয়মে। মাঝখানে ঈশ্বর শুধু তাদের মুখ দিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলিয়ে নিচ্ছেন, ‘আমি মহাকিংবদন্তি ’!
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি।