প্রতিক্রিয়া
ক্ষমতার কাছে শ্যামল কান্তিরা বড্ড অসহায়!
একান্ন বছর বয়সী শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত। তিনি দীর্ঘ ২২ বছর ধরে কেবল শিক্ষকতাই করেছেন। নারায়ণগঞ্জের মদনপুর ইউনিয়নের পিয়ার সাত্তার লতিফ হাই স্কুলের প্রধান এ শিক্ষককে স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমানের উপস্থিতিতে কান ধরে ওঠ-বস করিয়ে সাজা দেওয়ার আগে উত্তেজিত একদল লোক মারধর করে। স্কুলের পরিচালনা কমিটি নিয়ে বিরোধের জের ধরে তাঁর ওপর এই নির্যাতন চালানো হয়। অভিযোগ ছিল, উনি ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। ঠুনকো অভিযোগে তাঁকে জনতার সামনে কানে ধরে ওঠ-বস করানো হয়। আরো একবার দেখা গেল, ক্ষমতার দাপট কাকে বলে! শ্যামল কান্তির মতো শিক্ষকরা, যাঁরা সমাজে নীরবে-নিভৃতে আলো জ্বালিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের এভাবে জনসমক্ষে হেনস্তার খবর আজকাল বেশ সাধারণ ব্যাপার! আর কত নিচে নামলে আমরা সভ্য হব?
একজন জনপ্রতিনিধি, যিনি কি না ওই শ্যামল কান্তি ভক্তের মতো হাজার শিক্ষকের ভোটে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করে চলেছেন। আর তাঁর হাতেই পিতৃতুল্য এই শিক্ষককেই আবার হেনস্তার শিকার হতে হলো? শুধু তা-ই নয়, যেভাবে হেনস্তা করা হলো, সেটা একজন প্রবীণ শিক্ষকের জন্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রধান শিক্ষককে যেভাবে ছাত্রছাত্রী এবং জনসমক্ষে কান ধরে ওঠ-বস করানো হলো, তাতে একবার ভাবুন তো, ভদ্রলোকের কী অবস্থা? তাঁর শত শত ছাত্র, স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা সমাজের সামনে ওনার অবস্থান আজ কোথায়? ক্লাসে গিয়ে উনি এখন শিক্ষার্থীদের কী শিক্ষা দেবেন? এই বেঁচে থাকা তো মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর!
কী দোষ ছিল শ্যামল কান্তি ভক্তের? উনি নাকি ধর্মের বিরুদ্ধে উসকানি দিয়েছেন? কিন্তু প্রমাণ, মিলেছে কি? না, প্রমাণ মেলেনি। স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমানের যুক্তি, জনরোষ থেকে বাঁচাতে গিয়ে কানে ধরে ওঠ-বস ছাড়া নাকি আর উপায় ছিল না! ক্ষমতার কাছে এ ছিল একজন মানুষ গড়ার কারিগরের অসহায় আত্মসমর্পণ। মানসিক মৃত্যুর দিন! উনি হয়তো বা শারীরিকভাবে আরো বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকবেন; কিন্তু উনার আত্মা যে মরে গেছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই শ্রেণির মানুষ, যাঁরা এ সমাজটাকে সভ্যতার আলোয় আলোকিত করে দিনের পর দিন বিকশিত করে যাচ্ছেন; আজকাল, তাঁরা ক্ষমতার কাছে প্রায়ই এ রকম অসহায় আত্মসমর্পণ করে থাকেন।
একসময় এই জনপ্রতিনিধিরাই শিক্ষকদের সম্মান রক্ষা করে ইতিহাসের অংশ হয়েছেন। আর, আজ? তাঁরাই হচ্ছেন ইতিহাসের খলনায়ক। বাদশা আলমগীরের কথা মনে আছে? যিনি রাজপুত্রের জন্য নিয়োগকৃত গৃহশিক্ষককে তলব করেছিলেন, কেন রাজপুত্র তাঁর পায়ে হাত রেখে পানি ঢালেনি সে জন্য? সেদিন রাজপুত্রের শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালার দৃশ্যটি তাঁর ভালো লাগেনি বলে রাজদরবারে তলব করেছিলেন। পানি ঢালার সময় রাজপুত্রের নিজ হাতটা শিক্ষকের পায়ে হাত রেখে পা দুখানা ঠিকমতো ধুয়ে পরিষ্কার না করার বিষয়টি বেশ পীড়া দিয়েছিল বাদশা আলমগীরকে। রাজদরবারে শিক্ষককে ডেকে এ বিষয়টি নজরে আনলে শিক্ষক সবশেষ বলেছিলেন : ‘আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির/ বড়ই তুমি মহান উদার বাদশা আলমগীর।’
যথেষ্ট সন্দেহ হয়, শ্যামল কান্তি ভক্তের সামনে সেদিন ওই স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সন্তান উপস্থিত থাকলে কী করতেন উনি। হয়তো বা বলতেন, বাবা, ওই শিক্ষককে কী শাস্তি দেওয়া যায় বলো তো? তুমি যেটা বলবে, এই শিক্ষককে আমি সেই শাস্তি দেব! কী ভয়ংকর হতো ব্যাপারটা! তার থেকে কম কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে ওটা বাকি ছিল আর কী! নারায়ণগঞ্জ এলাকায় ওসমান পরিবারের দাপটের কথা সবাই জানে। কারো অজানা থাকার বিষয় এটা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, মানবিক মূল্যবোধের জায়গাগুলো কি এসব জনপ্রতিনিধির নেই? আর যদি সেটা না থাকে, তাহলে তাঁরা জনপ্রতিনিধি হন কেমন করে? পরিবার থেকে কি শেখানো হয়নি, কীভাবে শিক্ষকের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়? একটা বস্তির ছেলেও যদি সাংসদ নির্বাচিত হয়, তাহলে একজন সম্মানিত শিক্ষকের সঙ্গে এমন ব্যবহার করবে না, সেটা নিশ্চিত। অর্থ, লোভ আর রাজনৈতিকে ক্ষমতা যদি এক সুতোয় মিশে যায়, সেখানে মানবতা আর থাকে না। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় তখন বাড়তেই থাকে।
যদি শ্যামল কান্তি ভক্ত কোনো দোষে অপরাধী হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর বিচার হওয়ার প্রয়োজন আছে। কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধি যে কাজটি করলেন, সেটার কি বিচার হবে না? কোনো শিক্ষক যেন অকারণে আর হয়রানির শিকার না হন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে কেউ দেখবে না, ভাববেও না, কতখানি কষ্ট বুকে নিয়ে শ্যামল কান্তি ভক্তরা এ সমাজ ছেড়ে চলে যাবেন।
লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।