নাগরিক যন্ত্রণা
শান্তিনগরের পানি ও উন্নয়নের গর্ত
‘স্বাধীনতার পর এই শান্তিনগরের পানি কেউ সরাইতে পারে নাই’; জলাবদ্ধতায় নাকাল রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার একজন বাসিন্দা আজ দুপুরে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে এই যে প্রতিক্রিয়া দেখালেন, তাতে একটা বিষয় খুব পরিষ্কার যে, শান্তিনগরের শান্তি অনেক আগেই বিনষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে যখন এক পশলা বৃষ্টি হয়, তখন এই এলাকার শান্তির প্রকৃত চিত্র উদ্ভাসিত হয়।
শুধু শান্তিনগর নয়; বৃষ্টি হলে রাজধানীর অন্যান্য অলিগলি এমনকি রাজপথও চলে যায় গোড়ালি পানির দখলে। যেমন আরামবাগ, মতিঝিল, মিরপুর, বাড্ডা, তেজতুরী বাজার, নাখালপাড়াসহ বিভিন্ন জায়গায় কোমরপানি জমে যায়। নানাবিধ উন্নয়নের গর্তে পড়ে যায় যানবাহনের চাকা, কদাচিৎ মানুষও। রাস্তার পাশের বাসাবাড়ির নিচতলা ও দোকানে ঢুকে পড়ে নোংরা পানি। তখন কবির সুমনের সেই গানটিই হয়তো নাগরিকদের কানে বাজে-‘ঘর বেঁধেছে পথের ধারে যাদের দল, তাদের ঘরে মেঘ মানেই নোংরা জল; সেই জলেতে বেদম ভিজে একটা লোক, মেঘদূতের নাম রেখেছে আহাম্মক।’
বৃষ্টির এই দুর্ভোগ একটু বেশি ভোগান্তিতে ফেলে পুরান ঢাকার মানুষকে। যেহেতু ওখানের রাস্তাঘাট সরু এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভালো নয়। এ কারণে দেখা যায় বংশাল, মালিটোলা, সদরঘাট, লক্ষ্মীবাজার, কুলুটোলা, হেমেন্দ্র দাস রোড, সূত্রাপুর, কাগজিটোলা, রূপচান লেন, গেণ্ডারিয়া, মিলব্যারাক, আরসিন গেটসহ আশপাশের এলাকার অলিগলি ছোটখাটো খালে পরিণত হয়। ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ লাইন উপচে পড়ে মলমূত্র। তার মধ্যে একাকার যানবাহন, নাগরিকের শরীর।
খোদ রাজধানী শহরের কেন এই দুরবস্থা, যেখানে বছর বছর উন্নয়ন বাজেটের আকার বাড়ে? বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির টাকা পুরোটা খরচ করতে না পারায় যখন টাকা ফেরত যায়, তখন কেন এই মহানগরীর মানুষকে এই একই যন্ত্রণার বৃত্তে ঘুরপাক খেতে হয়?
অধিকাংশই হয়তো বলবেন ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার দুর্বলতার কথা। কেউ হয়তো বলবেন সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীন গর্ত খোঁড়াখুঁড়ির কথা। কেউ হয়তো দায়ী করবেন নাগরিকদের অসচেতনতাকে। দায়ী করবেন পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রীর যথেচ্ছ ব্যবহারকে; কেননা রাজধানীর অধিকাংশ সুয়ারেজ লাইন অকেজো হয়ে পড়েছে পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রীর বর্জ্যে। এ কারণে সঠিকভাবে পানিনিষ্কাশন হচ্ছে না। সামান্য বৃষ্টিতে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। প্রতিদিন সকালে সুইপার দিয়ে পরিষ্কার করেও লাভ হয় না। সাংবাদিকরা যখন সিটি করপোরেশনের কর্তাদের জলাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন করেন, তখন তাঁদের জবাবগুলো মোটামুটি এরকমই।
কিন্তু এর বাইরে সবচেয়ে বড় সমস্যার নাম সম্ভবত ‘সুশাসন’ ও ‘জবাবদিহিতা’। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা সব সময়ই প্রশ্নাতীত ব্যাপার। নাগরিক সেবায় ফায়ার সার্ভিস ছাড়া অন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ৱপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে। ফলে নাগরিক কল্যাণের ভাবনাটা অনেকের মাথায় আসারও সময় পায় না। ফলে একই সড়কে ওয়াসা গর্ত খোঁড়ার পর সেখানে গর্ত করে টিঅ্যান্ডটি; সেই গর্ত ঠিক করার জন্য দায়িত্ব যাদের, তাদের এর বাইরে আরো অনেক কাজ থাকতে পারে, সুতরাং সেই গর্তে পড়ে কোন আবদুর রহিমের ঠ্যাং ভাঙল, তাতে জনগণের সেবকদের কিছু যায়-আসে না। কারণ গর্তে পড়ে কোনো নাগরিকের আহত হওয়ার দায়ে কখনো কারো চাকরি গেছে বা ন্যূনতম কাউকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছে বলেও শোনা যায় না।
রাজধানী ঢাকার বয়স বলা হয় কমপক্ষে চারশো বছর। কোনো কোনো গবেষণা বলছে আরো বেশি। কিন্তু এত বছর পরও এই শহর এখনো নির্মাণাধীন। ফলে প্রশ্ন ওঠে, এই শহরটি আর কত বছর এভাবে নির্মাণাধীন থাকবে। আর কত বছর এই শহরে ভবন উঠতেই থাকবে। আর কত বছর রাস্তা-অলি-গলি খুঁড়ে একবার পানির পাইপ, একবার গ্যাসের লাইন আর একবার স্যুয়ারেজ লাইন সংস্কার/উন্নয়ন করা হবে? এই শহর কি আদৌ পূর্ণতা পাবে কোনোদিন? নাকি একদিন হঠাৎ করে কোনো এক দুর্বিপাকে ইতিহাস হবে এই তিলোত্তমা নগরী?
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর