টেকসই উন্নয়ন
এগিয়ে চলার ‘ওয়াইফাই’ মডেল
শৈলী আমার সহকর্মী ছিলেন এবিসি রেডিওতে। দুজনেরই কর্মস্থল পরিবর্তন হওয়ায় দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল না। হঠাৎ একদিন তাঁর ফোন। বললেন, তাঁর একটা এক্সিবিশন আছে। জানালেন, তিনি এখন নিজের নামেই একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন; যেটির ৮০ শতাংশ বিকিকিনি হয় অনলাইনে।
আমার শৈশবের বন্ধু সুলতানা সোনিয়াকেও দেখি ফেসবুকে বেশ সরব; বিশেষ করে তাঁর ব্যবসার খবরাদি নিয়ে- যেটি তিনি শুরু করেছিলেন অনলাইনভিত্তিক বিকিকিনি দিয়ে। এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও মধপ্রাচ্যেও পাঠান তাঁর ডিজাইন করা পোশাক।
এ রকম শৈলী সোনিয়ারা ভেতরে ভেতরে এক অন্যরকম পরিবর্তন সাধন করে চলেছেন-যেটি বদলে দিচ্ছে তাঁদের নিজেদের অর্থনৈতিক কাঠামো, ভূমিকা রাখছেন দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও।
২০১৫ পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য জাতিসংঘ যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে, তার ৫ (বি)ধারায়ও নারীর ক্ষমতায়নে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন বিষয়টি আলোচনায় আসছে যে, নারীর ক্ষমতায়নে তথ্যপ্রযুক্তি আসলেই কতটা ভূমিকা রাখছে বা এই ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো কী?
পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট শিল্প উদ্যোক্তার মধ্যে ১০ শতাংশের বেশি নারী। তারা বুটিক, পার্লারের মতো ছোট উদ্যোগ থেকে শুরু করে চামড়া, হিমাগার, তথ্যপ্রযুক্তিসহ নানামুখী ব্যবসায়িক উদ্যোগ নিচ্ছেন।
যদিও তাদের নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির বাইরেও একটা বড় চ্যালেঞ্জ পরিবার ও সমাজের বৃহত্তর অংশের মানসিকতা। অর্থাৎ পরিবারের একজন নারী সদস্য ব্যবসা করবে, এটি এখনো বেশির ভাগ পরিবারের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
আবার অনলাইন বা ইন্টারনেটনির্ভর ব্যবসার ক্ষেত্রে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বিশেষ করে এখনো দেশে অনলাইনভিত্তিক পেমেন্টে গেটওয়ে তৈরি করা সম্ভব হয়নি। ফলে অর্থের লেনদেন এখনো খুব সহজ নয়। বিদেশ থেকে অনেকেই ক্রেডিট কার্ডে অর্থ পরিশোধে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। আবার ‘বিকাশ’ বা এ রকম পদ্ধতিতে অর্থের লেনদেন করলেও ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে এখনো পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়নি। অনেকের মধ্যেই এ রকম সংশয় থাকে যে, টাকা পরিশোধের পরে সঠিক সময়ে পণ্য হাতে পাওয়া যাবে কি না। অনলাইনে পণ্যের যে ছবি দেখেছেন, হুবহু সেই রকম ও সেই মানের পণ্যটি হাতে পাবেন কি না।
এর বাইরে পণ্য পরিবহনে ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা রাজধানীর যানজট। এখনো অনলাইনে বেচাকেনা বস্তুত রাজধানীকেন্দ্রিক। ঢাকার বাইরে এটি জনপ্রিয় হতে আরো সময় লাগবে। কারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লেও অনলাইনে ক্রেতার সংখ্যা এখনো সেই হারে বাড়ছে না। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তি আরো সহজ হতে হবে। আবার সব নারী উদ্যোক্তাই যে তথ্যপ্রযুক্তিতে খুব সাবলীল তাও নয়। সেই ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যবসায় গতি আনার জন্যও এখন আইসিটিতে তাঁদের দক্ষতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।
উদ্যোগী নারীদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন সম্ভাবনা জাগাচ্ছে জাতিসংঘের ওয়াইফাই (Women and ICT Frontier Initiatiev-WIFI) মডেল। এর উদ্দেশ্য, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে এশিয়া ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে নারীদের উদ্যোগী হতে আগ্রহী করে তোলা। তথ্যপ্রযুক্তিতে নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বাড়ানো, যাতে তাদের প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। আর এর সামগ্রিক লক্ষ্য নারী উদ্যোক্তা, তাদের পরিবার এবং সর্বোপরি জাতীয় অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়া।
ওয়াইফাইয়ের আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে লিঙ্গ সমতাভিত্তিক নীতি ও প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে সরকারের নেতৃত্ব ও নীতিনির্ধারণের দক্ষতা তৈরি করা। বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো রাষ্ট্রের নারী উদ্যোক্তাদের কী ধরনের সমর্থন দিচ্ছে, তাও নজরে রাখা।
আগামী ৯-১০ জুন দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচন শহরে এই প্রকল্পের উদ্বোধন হবে এবং এরপর এটি এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় ছড়িয়ে যাবে। স্বভাবতই বাংলাদেশেও ওয়াইফাই নিয়ে কাজ শুরু হবে এবং এর মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তারা আরো বেশি দক্ষ হয়ে উঠবেন বলে আশা করা যায়। এই প্রকল্পে বাংলাদেশের মূল অংশীদার বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল। তবে এর বাইরে এসএমই ফাউন্ডেশনসহ নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনও এই প্রকল্পের আওতায় আসবে বলে ধারণা করা যায়।
যেসব নারী উদ্যোক্তা তাদের ব্যবসায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করেন তাঁরা তো বটেই-এমনকি অন্য উদ্যোক্তারাও এই প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁদের দক্ষতা বাড়াতে পারবেন বলে আশা করা যায়। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যেসব চ্যালেঞ্জ প্রতিনিয়তই নারী উদ্যোক্তাদের পথচলাকে কঠিন করে তোলে, যেমন পণ্য বিকিকিনিতে যেসব সমস্যার কথা আগে বলা হয়েছে-সেসব চ্যালেঞ্জ উত্তরণেও ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
এ কথা অস্বীকার উপায় নেই যে, আইসিটি খাতে নারীদের সম্ভাবনা যথেষ্ট। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশে এই সম্ভাবনা আরো বেশি। কারণ অর্থনীতিতে তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা দেশের নারীরা আইসিটি খাতের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার গুরুত্ব বুঝতে পারছেন এবং এ খাতেই ক্যারিয়ার গড়ার কথা ভাবছেন। এর একটা বড় কারণ, ওয়েবভিত্তিক অনেক কাজ ঘরে বসেই করা যায়। সেই ক্ষেত্রে রক্ষণশীল পরিবারের নারীরাও নিজেদের ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখতে পারেন আইসিটি বা তথ্যপ্রযুক্তিতে নিজেদের দক্ষ করে তোলার মাধ্যমে। অর্থাৎ যেসব নারী ঘর থেকে বের হতে চান না বা চাইলেই বেরোতে পারেন না, তাঁরাও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ পেলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসে আউট সোর্সিং ও ফ্রিল্যানসিং করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারেন।
নারী উন্নয়নে এরইমধ্যে বিশ্বে বাংলাদেশ একটি মডেল, নারীর ক্ষমতায়নে তো বটেই। সেই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের এই ওয়াইফাই মডেল নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে একটা নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর