গণপরিবহন
নগরে চলাচল আরো কঠিন হয়ে উঠছে
দুপুরের গনগনে রোদে ষোলো মাসের মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি গ্রিন রোডে। যাব আজিমপুর শেখসাহেব বাজার। একে একে জনাদশেক রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করলাম, আজিমপুর যাবেন? সবার না-সূচক উত্তর। তারপর চেষ্টা সিএনজি অটোরিকশার। একে একে তাও জনাদশের চালককে একই প্রশ্ন এবং যথারীতি উত্তরও অভিন্ন।
কিছুদিন আগেও এখান থেকে সহজেই আজিমপুর যেতে রাজি হতেন রিকশাচালকরা। ভাড়া কখনো ১০ টাকা এদিক-সেদিক হতো। কিন্তু এভাবে মুখের ওপর না বলতেন না কেউই। এখন তাঁদের কেন এই আচরণ? জানা গেল সায়েন্স ল্যাবরেটরির উল্টোদিকে ল্যাবএইড হাসপাতালের পরে দক্ষিণ দিকে এখন আর রিকশা যেতে দেওয়া হয় না। ওই সড়কটিও নাকি ভিআইপি হয়ে গেছে। রিকশা যেহেতু ‘ছোটলোকের’ বাহন, অতএব ভিআইপিদের সড়কে তার প্রবেশাধিকার নেই।
বাধ্য হয়ে ল্যাবএইড পর্যন্ত রিকশা নিয়ে আসি এবং তখন সেখানে দেখা গেল পুলিশের সঙ্গে বাহাস করছেন দুজন ছাত্রী। কাছে গিয়ে জানা গেল, তাঁরা ইডেন কলেজে পড়েন এবং অনার্স ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষার সিট পড়েছে ঢাকা কলেজে। কিন্তু রিকশা আটকে দিয়েছে। এখন রাস্তা পার হয়ে বাকি পথটুকু হেঁটে যেতে হবে।
তপ্ত রোদ মাথায় নিয়ে মানুষের ঠেলাগুঁতো খেয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরির ওভার ব্রিজ পার হই এবং তারপর আরো মিনিট বিশেক চেষ্টার পর একজন রিকশাচালককে শেখসাহেব বাজার যেতে রাজি করাতে সক্ষম হই। গ্রিন রোড থেকে যেখানে শেখসাহেব বাজার আগে সরাসরি যাওয়া যেত ৬০ থেকে ৭০ টাকায়; সেখানে যেতে দুই দফায় রিকশাচালককে দিতে হলো ১৩০ টাকা।
শুধু এই সড়কটিই নয়, ঢাকার বিভিন্ন সড়কেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে রিকশা চলাচল। কম গতির এই বাহন, বড়লোকের দ্রুতগামী চার চাকার গাড়ি চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে বলে বিভিন্ন সড়কের গায়ে ভিআইডি তকমা লাগিয়ে সেখানে রিকশা প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। একটা অদ্ভুত সাইনবোর্ড চোখে পড়ে সাত রাস্তার মোড় থেকে নাবিস্কো যেতে। সেখানে লেখা রয়েছে, ‘রিকশা মেইন রাস্তায় উঠলেই আটক’।
ঢাকার যানজটের জন্য অনেক সময়ই দায়ী করা হয় এই রিকশাকে। বলা হয়, অশিক্ষিত রিকশাচালকরা নিয়ম মানে না- ‘আউলা-ঝাউলা ঢুকে পড়ে ফাঁকে-ফোঁকে’, ফলে অন্য যানবাহনের গতি রুদ্ধ হয়। প্রশ্ন হলো, রিকশার দূরত্বে মানুষ এখন যাবে কিসে?
অল্প দূরত্বে সিএনজি অটোরিকশা যেতে চায় না। মিটারে চলতে বাধ্য থাকবে বলে সরকার বাহাদুর হম্বিতম্বি করলেও তাকে থোড়াই কেয়ার করেন চালকরা। সম্ভবত ঢাকার রাস্তায় কোনো সিএনজি অটোরিকশাই এখন আর মিটারে যায় না। গেলেও শর্ত, মিটারে যা উঠবে তার চেয়ে ২০ টাকা বেশি। আবার অধিকাংশ সময়েই এই ২০ টাকা বেশি দেওয়ার কথা বললেও তাঁরা যেতে চান না। তাঁরা নিজেদের পছন্দের দূরত্বে যাবেন। খুব ভাগ্যবান না হলে একজন দুজন চালককে জিজ্ঞেস করার পরই তিনি যাত্রীর কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে যেতে রাজি হয়েছেন, এর উদাহরণ বিরল। ভাবটা এমন যে, রাস্তায় বেরিয়ে আপনি বিপদে পড়েছেন, অতএব সিএনজি অটোরিকশা এবং রিকশাচালকদের হাতে-পায়ে ধরে আপনাকে গন্তব্যে যেতে হবে। যদিও আপনি ন্যায্য ভাড়ার চেয়েও বেশি টাকা দিতে রাজি আছেন।
ঢাকার গণপরিবহন নিয়ে মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের খেদ বহু পুরোনো। যেসব রুটে পাবলিক বাস আছে, সেখানেও খুব আরামে চলার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিশেষ করে সকালে-সন্ধ্যায়। যদিও প্রাইভেট কার বা ব্যক্তিগত গাড়ির অভাব নেই। প্রতিদিনই রাস্তায় নামছে নিত্যনতুন গাড়ি। কিন্তু বাড়ছে না সড়ক। উন্নত হচ্ছে না সড়ক ব্যবস্থাপনা। নেই সড়ক আইন মানার প্রবণতা।
একটি শহরের মেগাসিটি হয়ে ওঠার বড় শর্ত, সেখানে সহজ গণপরিবহনব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু এই শহরে এখনো ওই অর্থে কোনো কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে বাধ্য হয়ে মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্ন মধ্যবিত্তরাও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বা জায়গা-জমি বিক্রি করে একটা প্রাইভেট কার কেনেন এবং বাড়তে থাকা যানজটে নতুন মাত্রা যোগ করেন।
নারীনেত্রী ফরিদা আখতার একবার এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘ঢাকা শহরে প্রাইভেট কারের জন্মনিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এই শহর থেকে ট্রাফিক জ্যাম কস্মিনকালেও দূর হবে না।’ কিন্তু প্রাইভেট কারের জন্মনিয়ন্ত্রণ কে করবে? এ দেশে গাড়ি কিনতে সরকারের অনুমতি লাগে না। যে কেউ যেকোনো সময় শোরুমে গিয়ে গাড়ি নিয়ে আসতে পারেন। অথচ উন্নত বিশ্বে গাড়ি কেনার আগে সরকারের অনুমতি লাগে। কারণ পর্যাপ্ত এবং আরামদায়ক গণপরিবহনের ব্যবস্থা থাকার পরও একজন নাগরিক কেন ব্যক্তিগত গাড়ি কিনবেন, সেটিই বরং সরকারকে চিন্তিত করে। যে কারণে আমরা অনেক সময়ই দেখি, অনেক দেশের সরকারপ্রধান ট্রেনে চড়ে এমনকি বাইসাইকেল চালিয়ে অফিসে যাচ্ছেন। কিন্তু ঢাকা শহরে আপনি কোথায় বাইসাইকেল চালাবেন?
ঢাকার মানুষের যাতায়াত সমস্যার একটা সমাধান হতে পারত চওড়া ফুটপাথ। কিন্তু সংসদ ভবন এলাকা ছাড়া রাজধানীর আর কোনো এলাকায় এমন ফুটপাথ আপনি পাবেন যেখানে হাঁটা যায়? এ রকম ফুটপাথ থাকলে অন্তত দুই কিলোমিটার পর্যন্ত পথ মানুষ হেঁটেই যেতে পারত। তখন অল্প দূরত্বে আর রিকশারও প্রয়োজন হতো না। সেই ফুটপাথ কোথায় বানাবেন আর বানানোর পর সেটি যেভাবে দখল হবে, তা কে ঠেকাবে?
অতএব স্বল্প আয়ের যেসব মানুষ, যেসব ‘ছোটলোক’ গাড়ি কেনার সামর্থ্য রাখেন না, আবার পাবলিক বাসের ঠেলাঠেলিও সইতে পারেন না, তাদের কপালে দুর্গতিই সার। কেননা একে একে সব প্রধান সড়কেই রিকশা চলাচল বন্ধ হবে। আবার অল্প দূরত্বে সিএনজি অটোরিকশাও যাবে না। গেলেও যে ভাড়া হাঁকবে, তা শুনে মাথা গরম হবে। অতএব প্রাইভেটকারবিহীন এই জনগোষ্ঠী কীভাবে ঢাকার রাস্তায় চলাচল করবে? হয়তো একসময় নানা রকম আন্দোলনের মতো ‘ছোটলোকমুক্ত ঢাকা চাই আন্দোলন’ শুরু হবে; যাতে তারা বড়লোকের চলাফেলার কোনো ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি করতে না পারে।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।