প্রতিক্রিয়া
‘আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ’
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার হাল নিয়ে দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদ-ভিডিও ভার্চুয়াল জগতে গতকাল ভাইরাল হয়ে গেল। এদিন ভার্চুয়াল জগতের পুরোটাজুড়েই ছিল ওই সংবাদটি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সরব আলোচনা। কেউ কেউ আবার ভিডিওতে শিক্ষার্থীদের ছবি প্রদর্শনের তীব্র সমালোচনাও করেছেন। ভিডিওতে দেখা গেছে, জিপিএ ৫ পাওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নানা মৌলিক প্রশ্ন করা হলে তারা সেগুলোর সঠিক জবাব দিতে পারেনি। বরং তারা এমন সব জবাব দিয়েছে, যেগুলো রীতিমতো আতঙ্কের (কারো কাছে হাস্যরসের) সৃষ্টি করেছে। কেউ নেপালের রাজধানী বলেছে নেপচুন। ‘আমি জিপিএ ৫ পেয়েছির’ ইংরেজি বলেছে, আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ।
ভিডিওটি আমিও দেখেছি। শিশুদের শিক্ষার এমন চিত্র দেখে অভিভাবক হিসেবে আমিও আতঙ্ক বোধ করেছি। শিক্ষার্থীরা সব মৌলিক বিষয় জানবে, এমনটা আমি মনে করি না। আমি নিজেও অনেক কিছুই জানি না। এই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর কথা না-ও জানতে পারে; তাই বলে, জাতীয় সংগীতের রচয়িতা কে, বা জাতীয় শহীদ মিনার কোথায়? এমন মৌলিক প্রশ্নের উত্তর জানবে না! বিশেষ করে এই স্তরের শিক্ষার্থীরা যারা কি না মেধার ভিত্তিতে নিজেরা জিপিএ ৫ পেয়েছে!
শিক্ষাব্যবস্থার ওই ভিডিও দেখে আমার শৈশব-কৈশোরের কথা মনে পড়ে গেল। সেই শৈশবে পরীক্ষার রেজাল্টকে আমরা বলতাম ‘ফল’। বলতাম, বার্ষিক পরীক্ষার ফল বের হবে, ষান্মাসিক পরীক্ষার ফল বের হবে। এসএসসি-এইচএসসিতে বোর্ড স্ট্যান্ড ছিল, ছিল স্টার মার্কস! আহা! সে কি দেশকাঁপানো ফল!
ফল মানে শাব্দিক অর্থেই ফল। গাছের চারা লাগিয়ে যত্ন করে গাছ বড় করা, সেই গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করা। ঠিক তেমনই সারা বছর পরিশ্রম করে পড়ালেখা করা, বছর শেষে পরীক্ষার পর যা মিলত তা ফলের চেয়েও ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ, ‘সুমিষ্ট’ ও ‘পুষ্টিকর’।
এখন চাপিয়ে দেওয়া সৃজনশীল জিপিএ ৫-সহ কোচিং-নোটবইসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থার সব ক্ষেত্রে যা বের হয়, সেটাও ফল। তবে সেটা ফরমালিনযুক্ত ফল। যেটাকে শিক্ষার্থীরা গর্ব করে বলে থাকে ‘রেজাল্ট।’ এ যুগের আম-কলা-কাঁঠালে যেমন স্বাদ, গন্ধ, পুষ্টি নেই; উপরন্তু ‘ফ্রি’ হিসেবে আছে ফরমালিন, কার্বাইড নামের বিষ, ঠিক এ যুগের শিক্ষার পরীক্ষার ফলও বিষযুক্ত। পুষ্টিহারা শিক্ষা নিয়ে একটি জাতি যদি এভাবে বেড়ে ওঠে, সে জাতি কোনোদিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। যেখানে খোদ শিক্ষাবিশেষজ্ঞরাই বলছেন, সৃজনশীল পদ্ধতির বই শিক্ষকরাই বোঝেন না। ভয়াবহ তথ্য এটি! একটি জাতির জন্য এরচেয়ে বড় বিপদসংকেত আর হতে পারে না।
শুধু শিশুশিক্ষার্থীদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েই কি সমস্যা? ভার্সিটিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথমরাই শুধু শিক্ষক হন; এটা কি যথাযথ-যথার্থ ব্যবস্থা? জিপিএ ৫ অর্জনের মতো এই প্রথম হওয়ার দৌড়ে অনেকে টিউটোরিয়াল শিক্ষকের কাঁচাবাজারের ব্যাগও টানেন (সবাই না কিন্তু)। যে শিক্ষার্থী প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হলো, সে ভালো পড়াতে পারলেও শিক্ষকতার সুযোগ পান না। এটাকে কি উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা বলা যায়? পারফরমেন্স বিবেচনায় না নিয়ে শুধু অ্যাকাডেমিক শিক্ষার সনদই কি শিক্ষক হওয়ার জন্য যথেষ্ট?
ধরুন, ভার্সিটি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট ৬০ শতাংশের বেশি, তিন মাস বা ছয় মাস পড়ানোর পারফরমেন্স মার্কস ৪০ শতাংশ সব মিলিয়ে (৬০+৪০)=১০০ শতাংশ মার্কস গড় করে সর্বোচ্চ নম্বরধারীকে নিয়োগ দেওয়া হলো। পারফরমেন্স ভোট দেবেন শিক্ষার্থীরা। আমার মতে, এটাই হতে পারত যথাযথ নিয়োগব্যবস্থা। প্র্যাকটিক্যালি। কারণ, অনেককেই দেখা যায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও ভালো পড়াতে পারেন না। কিন্তু তিনি শিক্ষক হিসেবে বর্তে যান, পড়াতে না পারলেও চাকরিতে ইস্তফা দেন না।
শৈশবে গল্প শুনেছি, আমাদের গ্রামের নিজাম উদ্দিন ফকির প্রবেশিকা পাস করে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। সুদর্শন এই ছাত্রটিকে দেখতে সুদূর মধুপুর গড় এলাকা থেকে ছুটে এসেছিল মানুষজন। সে যুগে শিক্ষার একটি মানদণ্ড ছিল। আজকের মতো সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থার চেয়ে সে যুগে একজন সৃজনশীল শিক্ষকের ওপর গুরুত্ব বেশি দেওয়া হতো।
আগে আমাদের সময়ে শিক্ষকদের দেখতাম দিনে পড়ানোর পাশাপাশি রাতে গ্রামে গ্রামে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের খোঁজ নিতেন। দেখা যেত কোনো সন্ধ্যায় কোনো ছাত্র তার ঘরে পড়তে বসেছে, কয়েক মাইল দূর থেকে হেঁটে এসে স্যার জানালা দিয়ে ডেকে বলছেন, ঠিকমতো পড়ছ তো? সমস্যা হলে কাল ক্লাসে জিজ্ঞেস করো। আহা! কি মধুর সেই সম্পর্ক। আজকের যুগের প্রাইভেট টিউটর-কোচিং টিচারের সম্পর্কের মতো কোনো আর্থিক যোগ নেই সেই সম্পর্কে। একেবারে খাঁটি আর নির্ভেজাল সেই সম্পর্ক।
সেই দিন গেছে। শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি সেসব সৃজনশীল মানবিক শিক্ষকদের এ যুগে দেখা মেলে না। যারা আছে তাদের বেশির ভাগই টিউশনি, আধুনিক যুগের কোচিং ব্যবস্থার শেকল তৈরি করেছে। সৃজনশীলের জট ছাড়াতে শিক্ষার্থীদের হাতে তারা নোটবই তুলে দেয়। কোচিং-নোট ঘিরে চলে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য। সরকারের মন্ত্রীরা ওই শিক্ষাব্যবসায়ীদের নানা অনুষ্ঠানে হাজির হন। এ এক কঠিন শেকল। এই শেকল না ভাঙলে শিক্ষা মুক্তি পাবে না। স্বাধীনভাবে শিক্ষার্থীরা চিন্তা করতে না পারলে সেই শিক্ষায় শুধু বছরান্তে জিপিএ ৫ বাড়বে, সুশিক্ষিত বই পড়া প্রজন্ম তৈরি হবে না।
অবশ্য রাজনীতিকদের এ রকম একটা মেরুদণ্ডহীন, অসচেতন, মূর্খ জাতির দরকার আছে। কারণ এ রকম মূর্খ, অসচেতন আর মেরুদণ্ডহীন জাতিকে যে কোনো হুজুগ তুলে তাদের সহজেই পরিচালনা করা সম্ভব। এসব কারণেই কোনো সরকারের আমলেই সাধারণ মানুষদের কল্যাণে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তাদের যত্নশীল উদ্যোগ ছিল না। এ কারণেই রাজনীতিক, সুবিধাভোগী, ধনীক শ্রেণি, তাঁদের সন্তানদের এ দেশে পড়ালেখা করান না। তাঁদের সন্তানরা পড়ে পশ্চিমা দেশে, যুগোপযোগী আধুনিক এবং সেই দেশ-উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থায়। আমরা যারা সাধারণ, আমাদের সন্তানদের এই ফরমালিন শিক্ষাই ভরসা হয়ে উঠেছে।
কিন্তু এই ফরমালিন শিক্ষা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের অভিভাবকদেরই আগে উঠে দাঁড়াতে হবে। প্রজন্মকে রক্ষা করতে, দেশের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষা দিতে এর বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, অসার জিপিএ ৫ তারা অর্জন করেনি। তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আর এটা যদি আমরা অভিভাবকরা করতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদের সন্তানরা বলতেই থাকবে, ‘আই অ্যাম এ জিপিএ ৫’। শুধু তাই না, তারা ‘বিদ্যুৎ চমকায় কেন?’ প্রশ্নের উত্তর লিখবে, যাতে নায়িকারা নায়ককে জড়িয়ে ধরতে পারে। বা ‘দেব’ (কলকাতার নায়ক দেবের অর্থে নয় কিন্তু) এর স্ত্রী লিঙ্গ হিসেবে তারা বলবে ‘শুভশ্রী’।
আমার এ লেখা হতাশা ছড়ানোর জন্য নয়; সমস্যার সমাধানে সমস্যা নিয়ে খোলাখুলি উন্মুক্ত আলোচনার জন্য। এটা স্বীকার করে নেওয়াও শুভবুদ্ধির লক্ষণ ও জরুরি। যেহেতু শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ডের অবস্থা খারাপ হলে দেহের অবস্থা কী হতে পারে, আমরা সবাই সেটার ভয়াবহতা জানি।
নচিকেতার একটি গানের কয়েকটি লাইন দিয়ে শেষ করছি :
....আজকে যিনি কয়লামন্ত্রী কালকে তিনি শিক্ষা,
তাই, কয়লাকালো শিক্ষা নিয়ে মানুষ করে ভিক্ষা।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন