৫৪ ধারা বিতর্ক
কী রকম পুলিশ বাহিনী আমাদের প্রাপ্য
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার মতোই আরেকটি আতঙ্কের নাম ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা; যার ক্ষমতাবলে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় যেকোনো সময় যেকোনো নাগরিককে আটক করতে পারে। তবে হাইকোর্ট এই আইনের অপপ্রযোগ রোধে যেসব নির্দেশনা দিয়েছিলেন, গত ২৪ মে সেটি বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে ১৬৭ ধারার অপপ্রয়োগ রোধেও নির্দেশনা রয়েছে আদালতের।
আদালতের ওই আদেশের দিন তাৎক্ষণিকভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানান, আদালতের নির্দেশনা মেনে কাজ করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সংবাদ সম্মেলনে একই প্রতিশ্রুতি দেয় পুলিশও। আরো উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, আদালতের এই নির্দেশনার পর ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের পুরো দৃশ্যপটই বদলে যায়। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের খবর অনুযায়ী, আদালতের এই নির্দেশনার পরপরই রাজধানীতে বলতে গেলে শূন্যের কোটায় নেমে আসে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের ঘটনা।
প্রশ্ন হলো, আদালতের নির্দেশনা মেনে ৫৪ ধারার প্রয়োগ শুরু করায় পুলিশের ক্ষমতা ও রাজনৈতিক হয়রানি কি কমবে? পক্ষান্তরে অপরাধ কি বেড়ে যাবে? আসলে পুরোটাই নির্ভর করে আমাদের জাতিগত মানসকাঠামো কী রকম, তার ওপর। কেননা, রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী কেমন হবে, তারা নাগরিকদের ওপর কী রকম আচরণ করবে, তা কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যেমন, সেই রাষ্ট্রের জনগণ কেমন, তাদের সাংস্কৃতিক মান কতটা উন্নত, সে দেশের সরকার পুলিশ বাহিনীকে কীভাবে ব্যবহার করে, পুলিশের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা কেমন, সর্বজনীন মানবাধিকার সম্পর্কে পুলিশ কতটা সচেতন এবং নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ কী হবে, সে বিষয়ে তারা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পায় কি না ইত্যাদি। কারণ, পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সেই রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর ভেতর থেকেই উঠে আসেন। তাদের কাছ থেকে রাজনীতিবিদ, বেসামরিক প্রশাসন, জনগণের সামগ্রিক মূল্যবোধের ব্যতিক্রম কিছু আশা করা কঠিন।
ক্ষমতাসীনরা পুলিশকে বরাবরই প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। সেটি কী সামরিক সরকার, কী জনগণের ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার-পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহারে সবার আচরণ অভিন্ন। যে কারণে সব সময়ই বিরোধী দলগুলো পুলিশকে ‘সরকারের পেটোয়া’ বাহিনী বলে অভিহিত করে থাকে। আবার ক্ষমতায় গেলে তারাই বিরোধী দমনে পুলিশকে ব্যবহার করে। আর এ ক্ষেত্রে পুলিশের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার এই ৫৪ ধারা।
এখন পুলিশের হাতে কিংবা হেফাজতে কেউ মারা গেলে তার তদন্তের এখতিয়ার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের। ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধ বা পুলিশ হেফাজতে কারো মৃত্যু হলে তা আইনসঙ্গত ছিল কি না তাও তদন্ত করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু পুলিশ নির্বাহী হাকিমদের মাধ্যমে তদন্তের ঘোর বিরোধী। তাদের দাবি, নিজেদের ঘটনা নিজেরাই তদন্ত করবে। এ কারণে হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইন সংস্কারের দাবিও রয়েছে তাদের।
ফলে ৫৪ ধারার প্রয়োগে আদালতের নির্দেশনা মানতে গেলে পুলিশের সামগ্রিক ক্ষমতা কমবে কি না বা কমেছে কি না-সে প্রশ্নটি আসছে। যেমন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, সব সময় আগে থেকে মামলা করে অপরাধীদের ধরা সম্ভব হয় না। তা ছাড়া মামলা এবং পরোয়ানা জারির অপেক্ষা করে বসে থাকলে অপরাধী পালিয়ে যাবে। যেমন যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু রাজাকার গ্রেপ্তারের নির্দেশ শুনেই পালিয়ে গেছে। আবার পুলিশ যদি কারো গতিবিধি দেখে সন্দেহ করে যে, সে কোনো অপরাধের ছক আঁকছে বা পরিকল্পনা করছে, তখন তাকে গ্রেপ্তারের জন্য মামলা বা পরোয়ানা জারির অপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
দেখা যাক, ৫৪ ও ১৬৭ ধারা নিয়ে ২০০৩ সালে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, সেখানে কী কী নির্দেশনা রয়েছে :
ক. আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেওয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে না।
খ. কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে।
গ. গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে কারণ জানাতে হবে।
ঘ. বাসা বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেপ্তার ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে বিষয়টি জানাতে হবে।
ঙ. গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে তার পছন্দ অনুযায়ী আইনজীবী ও আত্মীয়দের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে।
চ. গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে কারাগারের ভেতরে কাচের তৈরি বিশেষ কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। ওই কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকট আত্মীয় থাকতে পারবেন।
ছ. জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে।
ট. পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবে। বোর্ড যদি বলে ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তাহলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা নেবেন এবং তাকে দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে।
তার মানে পুলিশ আগের মতোই ৫৪ ধারায় যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারবে, তবে উপরোক্ত নির্দেশনাগুলো মানতে হবে। আগে যেমন কাউকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর পরিবার জানতেই পারত না তাকে কে বা কারা ধরে নিয়ে গেছে; এখন এই নির্দেশনায় বলা আছে, কাউকে গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে এর কারণ জানাতে হবে এবং বাসা বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হলে এক ঘণ্টার মধ্যে তা পরিবারকে জানাতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেপ্তার করতে গেলেও পুলিশ পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। এখানে একটা জবাবদিহিতা নিশ্চিতের একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
একইভাবে ১৬৭ ধারার ক্ষমতাবলে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রেও আদালত যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন, সেটিরও যদি সঠিক প্রয়োগ হয়, তাহলে অভিযুক্ত এবং বিচারপ্রার্থীর মানবাধিকার রক্ষার কিছুটা সুযোগ তৈরি হবে। বিশেষ করে হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন এবং নির্যাতনের প্রমাণ মিললে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যব্স্থাও রাখা হয়েছে।
এখানে একটা সমস্যার কথা পুলিশের তরফে বলা হয় যে, অভিযুক্তকে রিমান্ডে নেওয়াই হয় স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য। সে ক্ষেত্রে তার সঙ্গে ভালো আচরণ করলে সব সময় সঠিক তথ্য বেরিয়ে নাও আসতে পারে। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা এ ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট।
পুলিশ এসব নির্দেশনা কতটুকু মানছে বা মানবে, তা হয়তো সব সময় তদারকি করা কঠিন। কেননা পুরো বিষয়টি নির্ভর করে রাষ্ট্রযন্ত্র পুলিশকে কীভাবে ব্যবহার করছে তার ওপর। কেননা বলাই হয়, পুলিশকে যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয় এবং তাদের ওপর কোনো ধরনের রাজনৈতিক চাপ না থাকে, তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যে দেশকে অপরাধমুক্ত করা সম্ভব। কারণ পুলিশ জানে কোথায় কী অপরাধ হয়। কারা এর সঙ্গে জড়িত। খুব ব্যতিক্রম বাদ দিলে যেকোনো অপরাধীকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধরে ফেলার সক্ষমতাও পুলিশের আছে। কিন্তু পুলিশ সব ক্ষেত্রে অপরাধ দমন ও অপরাধীদের গ্রেপ্তারে স্বাধীন নয়। প্রভাবশালীদের ফোনে সব সময়ই তাদের তটস্থ থাকতে হয়। সুতরাং ৫৪ ধারা এবং ১৬৭ ধারার প্রয়োগে আদালতের নির্দেশনাই শুধু নয়, যদি আদালত এই বিধান দুটি বাতিলও করে দেন, তারপরও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন নির্ভর করবে পলিটিক্যাল উইল বা রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর