প্রতিক্রিয়া
আমাদের বাবু ভাই, মিতু ভাবি
মাগুরা শহরের ভায়না মোড়ের পর গোরস্থান রোডে আমাদের বাসার পাশে চয়নদের দালানের দোতলায় তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন আবদুল ওয়াদুদ দম্পতি। আমার মা বলত, ‘দেখো, ওই ছেলেমেয়েগুলো সারা দিন শুধু পড়ে।’
আমি জানতাম না ওরা কারা। একদিন ওই বাসায় গিয়ে দেখি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের একগাদা কালেকশন, আর ঘরভর্তি বিদেশি ম্যাগাজিন। খুব বিনয়ী একজন মানুষ, নাম সাবু, তিনি আমাকে সেই বিদেশি ম্যাগাজিনের কয়েকটা সংখ্যা আর কিছু পোস্টার একেবারে দিয়ে দিলেন।
কিন্তু ওই সাময়িকীগুলোর মালিক ছিলেন সাবু ভাইয়ের বড় ভাই বাবু, যার পুরো নাম বাবুল আক্তার। তখন বাবু ভাই কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে পড়ালেখা করেন। বাবু ভাই ওখান থেকে অনার্স-মাস্টার্স করে কিছুদিনের জন্য আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা করেন। তার আগে কিছুদিন পত্রিকায় লেখালেখি করেন।
এর মধ্যে স্পোকেন ইংলিশের ওপর তাঁর লেখা একটা বই বের হয়। আমি ঢাকায় গিয়ে নীলক্ষেতে দেখি সেই বইয়ের খুব কাটতি। ওই সময়ে আমাদের কাছে বই বের হওয়া মানে বেশ একটা বড়সড় ব্যাপার ছিল। সাবু ভাইয়ের সঙ্গে আমার বেশ সখ্য হয়ে যায়, কারণ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করতেন, দৈনিক ইত্তেফাকের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি। যখন কোনো সংবাদের নিচে নাম দেখতাম ‘সাহাবুল হক’, মনে হতো যেন আমার নিজের লেখা। সাবু ভাইয়ের এসব লেখা দেখে আমার নিজের মধ্যে কীভাবে যেন গণমাধ্যমে কাজ করার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
আমার আকর্ষণ ছিল সাবু ভাইয়ের সাংবাদিক বন্ধুদের প্রতি। সে সময়ে প্রথম আলোতে ছিলেন বোরহানুল হক সম্রাট, ভোরের ডাকে সুজন মেহেদী। সুজন ভাইয়ের সঙ্গে পরে আমার দেখা হয়েছিল চ্যানেল ওয়ানে। আর সাবু ভাই ইত্তেফাকে কিছুদিন স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করে পরে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
এর মাঝে বাবু ভাই একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি নেন, পাশাপাশি বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। বাবু ভাই ব্যাংকে ঢোকার পর ওয়াদুদ চাচার পুরোনো সহকর্মী বরিশালের পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ সাহেবের মেয়ে মিতুর সঙ্গে ঠিক হয়ে যায় বাবু ভাইয়ের বিয়ে।
বাবু ভাইয়ের বিয়ের সময় মনে হচ্ছিল, পুরো পাড়াটা যেন ‘পারিবারিক’ হয়ে গেছে। একগাদা মেহমান পাড়ার এ-বাড়ি ও-বাড়ি মিলিয়ে থাকছে। মিতু ভাবি বরিশালের মেয়ে, এ নিয়ে বিয়ের সময় সবার মনে একটু খুতখুতানি ছিল। বিয়ের পরদিন দেখা গেল, ভাবি সকালে উঠে সব রান্না একা একা করে ফেলছেন। সবাই বুঝে ফেলল, বউমা কাজের আছে!
এর কিছুদিন পরে শুনি, বাবু ভাই বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে সহকারী পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে যোগ দিয়েছেন। ২০০৫ সালে আমি তখন কলেজে পড়ি; ২০০৭ সালে যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু করি, বাবু ভাইয়ের পোস্টিং তখন র্যাবে।
আমাদের প্রজন্মের মধ্যে একটা নাক সিটকানো ভাব ছিল বিসিএস নিয়ে। কেউ সরকারি চাকরি করবে না, করবে ‘জব’! তারা স্মার্ট ও ড্যাশিং হতে চায়। টিফিন ক্যারিয়ার হাতে ধুলোমাখা ফাইল পত্রিকা ওল্টানো সরকারি কর্মচারী হয়ে নচিকেতার গানের চরিত্র হতে চায় না কেউ।
আমার বাবা অন্য বাবাদের মতোই তাগাদা দিতেন বিসিএস দিতে, বলতাম কী হবে? ঘুষ-দুর্নীতি-দলবাজি এগুলোর মাঝে আমি নাই। বাবা বলতেন, বাবু-সাবুকে দেখো।
বাবু ভাই নাকি পড়তে পড়তে পাগল হয়ে যেতেন! সেই বাবু ভাই পুলিশ থেকে র্যাবে, র্যাব থেকে গোয়েন্দা বিভাগে একের পর এক দায়িত্ব পালন করছেন। যখন শুনতাম বাবু ভাই পুলিশে একটা বড় জায়গায় আছেন, তখন মনে হয় বিপদে পড়লে সাহায্য পাওয়া যাবে!
তবে তেমন বিপদ কখনো হয়নি, ২০১৪ সালে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু ওখানে গিয়ে থাকব কোথায়? মনে পড়ল, বাবু ভাই চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে আছেন। ফোন দিয়ে চলে গেলাম চট্টগ্রাম জিইসি মোড়ের ওয়েল পার্কের সামনে তাঁর ভাড়া বাসায়। তাঁদের দুই ছেলেমেয়ে চোখ বুজে ডিম খেয়ে সকালে স্কুলে যায়, ভাবি নিজেই রান্না করেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত রান্না একা করেন কেন? যে মেয়েটা বাসার কাজ করে, ও করলেই তো পারে।’ ভাবি হেসে বললেন, ‘এইটুকু না করলে তোমার ভাই আমাকে রাখবে?’
ভাবি একমনে বলতে থাকেন, বিয়ের সময় তোমরা কতটুকু ছিলে সবাই সানি-চয়ন-নয়ন, এখন সবাই কত বড়! এর মধ্যে বাসায় যে আসছে তাকে আমার কথা বলছেন, আমি তাঁর দেবর, বাবু ভাইয়ের ছোট ভাই। বাচ্চারা স্কুলে যায়, বাবু ভাই সকালে সকাল চলে যান আইইএলটিএসের মক টেস্ট দিতে, এইসব নাকি মিশনে অগ্রাধিকার দেয়।
বাবু ভাই একাধিকবার রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত অফিসার, এটা অনেকেই পায়; কিন্তু তিনি আলোচিত হন হাটহাজারীর জঙ্গি দমনে। হেফাজতের উত্থানকালে সমালোচিত ‘বাঁশের কেল্লা’ ফেসবুক পেজে বাবু ভাইকে ছাত্রলীগের ক্যাডার বলে উল্লেখ করে হুমকিও দেয়। অথচ আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি, বাবু ভাই কখনোই রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন না। বাবু ভাইদের পরিবারকেও দেখেছি সব সময় ধর্মভীরু।
পুলিশে যোগ দেওয়ার আগে বাবু ভাই কাউকে কখনো ধমকও দেননি, হয়তো যে দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেখানে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করার কারণে জঙ্গিদের কাছে ত্রাসে পরিণত হন। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন, নায়কোচিত ব্যাপার বটে।
আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনের সময় ডিকেন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। উনি তখন চট্টগ্রামের কর কর্মকর্তা। ডিকেন ভাইকে বাবু ভাইয়ের কথা বললাম। ডিকেন ভাই বলল, ‘খুব এফিশিয়েন্ট কপ।’ ওই সময়ে বাবু ভাইকে নিয়ে পত্রিকায় খবর ছাপা হচ্ছে। তরুণদের আদর্শে পরিণত হয়েছেন তিনি। সবাই দেখি বলে, ‘আমি বাবুল আক্তার হতে চাই।’
আমি যখন চট্টগ্রাম গিয়েছি তখন শুনেছি, বাবু ভাইয়ের ওপর হত্যার অনেক হুমকি আছে। তাঁর বাচ্চা দুটোকে অপহরণ করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। হয়তো এসব হুমকি অত সিরিয়াসলি নেননি তিনি।
গত শনিবার রাতে বান্দরবান থেকে বিজ্ঞাপনের শুটিং শেষ করে চট্টগ্রামের কোনা ছুঁয়ে ফিরছিলাম। রোববার সকালে বাসায় ফিরে অনেক দিন পর যখন ইলেকট্রিসিটি আর মোবাইল নেটওয়ার্ক পেলাম, মোবাইলের স্ক্রিনে তখন দেখি, পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীকে হত্যার খবর।
সেই পুলিশ কর্মকর্তাকে চিনি, তাঁর স্ত্রীকেও চিনি। পরিচিতজনের এ রকম মৃত্যুসংবাদ কেমন লাগা উচিত? যখন খবরটা দেখলাম, আমার চোখে ভাসল পাশের বাসা, কাউন্সিলপাড়ায় বাবু ভাইদের নতুন বাসা। লাবণী আপু, আজাদ দুলাভাই, লাবু, বাবু ভাইয়ের রত্নগর্ভা মা, আমার চট্টগ্রামযাত্রা, ঢাকায় শাইনপুকুরের বাসায় বাবু ভাইয়ের র্যাবের হ্যামার গাড়িতে করে আসা, পিচ্চি মাহিরকে নিয়ে আমাদের মাগুরার বাসায় যাওয়া।
চলচ্চিত্রের কাহিনীর মতো পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা, এটা মেনে নেওয়া যায় না। স্ত্রীর মৃতদেহ দেখে যেভাবে তিনি কাঁদছিলেন, ছেলেটা চোখের সামনে মাকে খুন হতে দেখেছে, এই ট্রমা থেকে তো ও কোনোদিন ফিরতে পারবে না।
বাবার তাগাদায় আমিও একসময় বিসিএস দিয়েছি, পুলিশ হতে চেয়েছি। আমার মনে হতো, পুলিশ মানুষকে নিরাপত্তা দেয়, পুলিশকে কে নিরাপত্তা দেবে? বাবু ভাই পুলিশ কোয়ার্টারে না থেকে ভাড়া বাসায় থাকতেন। দায়িত্ব পালন শেষে রাতবিরাতে কখন ঘরে ফেরেন, ঠিক ছিল না। নিজের পরিবারে এমন ঘটবে, হয়তো কখনো চিন্তা করেননি। কিন্তু এ ঘটনার পর কেউ কি আর বাবুল আক্তার হতে চাইবেন?
লেখক : চলচ্চিত্রকর্মী