স্মরণ
বিশ্ববাসীর ভালোবাসায় সিক্ত মোহাম্মদ আলী
দ্য গ্রেটেস্ট, দ্য ওয়ার্ল্ড গ্রেটেস্ট—যে নামেই ডাকা হোক না কেন, কোনো কিছুতেই যেন তাঁর আসল তেজোদ্দীপ্ত সত্তাটি প্রকাশ করা কঠিন। বিংশ শতাব্দীতে পুরো বিশ্বকে চমকে দিয়ে এক বক্সিং জাদুকরের আবির্ভাব ঘটেছিল। পরে শুধু নির্দিষ্ট যুগ নয়, সব যুগ আর কালের সেরা ক্রীড়াবিদের খেতাব জিতেছিলেন সেই বক্সিং জাদুকর। তিনি আর কেউ নন, বক্সিং কিংবদন্তি মোহাম্মদ আলী ক্লে।
১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকির লুইসভিলে জন্মগ্রহণ করেন বিশ্বখ্যাত এ বক্সিং সম্রাট। তাঁর বক্সিংয়ে আসার একটি ছোট্ট গল্প আছে। ১৯৫৪ সাল। তখন ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লের বয়স মাত্র ১২ বছর। তাঁর একটি প্রিয় সাইকেল ছিল। একদিন এক চোর তাঁর শখের সাইকেলটি চুরি করল। বালক ক্লে যান স্থানীয় একটি পুলিশ স্টেশনে মার্টিন নামের এক পুলিশ অফিসারের কাছে। তিনি তাঁর চুরি যাওয়া সাইকেলটি উদ্ধারের জন্য পুলিশ অফিসারকে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, সাইকেল উদ্ধার করতে পারলে এবং চোর ধরতে পারলে সে সেই চোরকে একটি ঘুষি মারবে। তখন সেই রসিক পুলিশ অফিসার বালক ক্লেকে বললেন, ঘুষি মারতে হলে তো প্রশিক্ষণ দরকার। আসলে মার্টিন ছিলেন স্থানীয় একটি বক্সিং ক্লাবের কোচ। সে জন্য তাঁর অধীনে চার বছর ক্লেকে বক্সিং শেখান। সেদিন বালক ক্লে তাঁর মনের ভেতরে শখের সাইকেল চুরির জেদের জন্য বক্সিংটি খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছিল। তার পর তাঁকে আর কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
১৯৬০ সাল থেকে বক্সিং শুরু করে ১৯৮১-তে এসে অবসর নেন আলী। তিনি মাত্র ১৫ থেকে ২০ বছরের বক্সিং জীবনে মোট ৬১টি লড়াইয়ে অংশ নিয়ে ৫৬টিতেই জিতেছিলেন, আর হেরেছিলেন মাত্র পাঁচটিতে। ১৯৬০ সালে প্রথম তিনি রোম অলিম্পিকে বক্সিংয়ে স্বর্ণপদক ছিনিয়ে নেন। এর পর আনুষ্ঠানিকভাবে হেভিওয়েট বক্সিংয়ে লড়েন ১৯৬৪ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে। আর সে সময়ই তিনি সুন্নি মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে মোহাম্মদ আলী ক্লে নাম ধারণ করেন। তারপর ১৯৬৪-৬৭, ১৯৭৪-৭৮ এবং ১৯৭৮-৮০ সময়ের জন্য তিনবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ছিলেন তিনি। ১৯৬৪-তে একবার ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৬৫-তে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের সরকার তাঁকে ভিয়েতনামে চলমান যুদ্ধে যোগ দেওয়ার কথা বললে ভিয়েতনামীরা তাঁকে কালো বলে গালি দেয়নি জানিয়ে তিনি সেখানে যেতে অস্বীকৃতি জানান। সে জন্য ১৯৬৭ সালে এক বছরের জন্য তাঁর খেতাব ও বক্সিং লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পরে আবার তা কর্তৃপক্ষ ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। তিনি একজন ক্রীড়াবিদ হয়েও ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় যুদ্ধে অংশ নেননি। এটি বিশ্ব রাজনীতির জন্য একটি বড় ধরনের বার্তা ছিল তখন। সে জন্য তিনি সারা দুনিয়ার অনেক মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা পেয়েছেন।
আমরা ইতিহাস থেকে জানি, যুগে যুগে সাদা চামড়া অধ্যুষিত এসব দেশে কালো মানুষদের অনেক নির্যাতন, নিপীড়ন ও নিগ্রহের স্বীকার হতে হয়েছে। আর এ ধরনের নিগ্রহ যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই হয়েছে, তা নয়। তাদের সমর্থন ও ছত্রছায়ায় থাকা দেশগুলোতেও এমন ঘটনা ঘটেছে সব সময়। সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রে মার্টিন লুথার কিং তাঁর জীবদ্দশায় এগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁর পুরো জীবন উৎসর্গ করেছিলেন কালো মানুষদের অধিকার আদায়ের জন্য। ব্রাজিলের আরেক ফুটবল কিংবদন্তি পেলেও রয়েছেন এসব সংগ্রামের মিছিলে। মোহাম্মদ আলী, মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা, পেলের মতো ব্যক্তিত্বের এসব সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়েই যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে বারাক ওবামার মতো কালো মানুষের সর্বোচ্চ প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়া সম্ভব হয়েছে। নেলসন ম্যান্ডেলা হতে পেরেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট এবং বিশ্বনন্দিত জাতীয় নেতার মর্যাদাও পেয়েছেন তিনি সে দেশের।
মোহাম্মদ আলী তাঁর বাংলাদেশি ভক্তকুলের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তখন তিনি লাখ লাখ ভক্তের সামনে গিয়াস উদ্দিন নামের ১২ বছরের এক বালক বক্সারের সঙ্গে একটি প্রতীকী লড়াইয়ে অংশ নিয়ে তিনি হেরে যাওয়ার অভিনয় করে কোটি কোটি বাঙালিকে সেদিন আপ্লুত করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তখন তিনি বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ও প্রাকৃতিক নিসর্গ দেখে আবেগাপ্লুত হয়েছিলেন। সে জন্য তিনি তাঁর দেশে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বর্গের সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং বলেছেন, কেউ যদি স্বর্গে যেতে চায়, তাহলে তাকে বাংলাদেশ সফর করতে পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশে আসার জন্য সে সময় তাঁকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি বক্সিং থেকে ১৯৮১ সালে অবসরের পর থেকে নিজস্ব ক্রীড়ানৈপুণ্য ছড়িয়ে দেওয়া এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি প্রায় ৩২ বছর পারকিনসন্স রোগে ভোগার পর ৩ জুন ২০১৬ সালে ৭৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
আলীর শেষকৃত্যানুষ্ঠান ১০ জুন ২০১৬ তারিখ শুক্রবার পবিত্র দিনে মুসলিম রীতি অনুযায়ী হচ্ছে। মোহাম্মদ আলীর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনসহ তাঁর পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, গুণগ্রাহী, ভক্তকুল উপস্থিত থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। আলী হেভিওয়েট বক্সিংকে দিয়েছেন অন্য রকম শিল্পের মাত্রা। কারণ, তাঁর বক্সিংয়ের যে একটি রিদম আছে, তাকে ‘প্রজাপতির মতো নাচব, মৌমাছির মতো হুঁল ফোটাব’ হিসেবে সারা বিশ্বে বর্ণনা করা হয়। তাঁর লড়াই দেখলে মনে হতো যেন একটি ছন্দে ও তালে তিনি নাচছেন। এখন টেলিভিশন খুললেই রেসলিংসহ আরো কত রকমের বক্সিং দেখা যায়, কিন্তু তা কখনো সে সময়ের ফ্লেভার দিতে পারে না। একই গুণে গুণান্বিত করে রেখে গেছেন তাঁর মেয়ে পেশাদার বক্সার লায়লা আলী, যাকে আমার সবাই চিনি। তাঁর ক্রীড়ানৈপুণ্য এবং কিছু সামাজিক মানবতাবাদী দায়দায়িত্বের কারণেই আজকে তাঁর মৃত্যুর পর বিশ্বময় তাঁকে নিয়ে এত আলোচনা। আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছেন তাঁর ভক্তবৃন্দ। আমাদের বাংলাদেশও এ থেকে বাদ যাচ্ছে না।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।