সোজা কথা
জঙ্গিবাদ ও পুলিশের গ্রেপ্তার
একের পর এক খুন। প্রকাশ্যে রাজপথে, কখনো বা ঘুরে ঢুকে নৃশংসভাবে খুন করে পালিয়ে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। একসময় ধারণা জন্মাল যে খুন হচ্ছে প্রগতিশীল লোকেরা কিংবা যারা ধর্ম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে তারা। কিন্তু এই ধারণা পাল্টাতে বেশি সময় লাগল না। খুনিরা এবারে এলোপাতাড়ি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ হত্যা করতে শুরু করল।এসব খুন নিয়ে নানা জনমত, নানা তর্ক বিতর্ক। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা বাংলাদেশে নিরাপদ নয় এমন একটু ধোয়াও উঠতে শুরু করল।আসলেই কি তাই? কারা খুন করছে কেন খুন করছে এই বিষয়গুলো নিয়ে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারি বাহিনীর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে গতবাধা কতগুলো বক্তব্য একঘেয়ে সুরে বেজেই চলল। “আমরা তথ্য পেয়েছি”, খুনের মোটিভ সম্পর্কে জানতে পেরেছি, খুনির খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি আমরা, তদন্তের স্বার্থে এখন কিছু জানাতে পারছি না ইত্যাদি নানান বাক্যবাণের পর আরেকটা কোনো নতুন ঘটনা আসে আর পুরনো খুনের কথা চাপা পড়ে যায়। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী যেন শুধু অপেক্ষায় থাকে কবে সাধারণ মানুষ ঘটনাটা ভুলে যাবে। কিন্তু এবারে যখন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী দিনেদুপুরে রাজপথে ঘাতকের হাতে প্রাণ হারালেন হতভম্ব হয়ে গেলেন পুলিশরাও। একে তো সাধারণ মানুষ এই ঘটনায় চরমভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেছে তার ওপর কারো ওপর ভরসা করার শক্তিও হারিয়ে ফেলছে যেন।
একই ভাবে রাস্তার ওপর হত্যা করা হয়েছে পাবনার এক ধর্মশালার সেবককে। তাদের হত্যাকাণ্ডের পরই মূলত বিশেষ পটভূমিতে সারা দেশে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান চলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কারণ ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডগুলো সচেতন মহলে সাড়া পড়ছে। এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে জঙ্গিরা। এ ধারণার ওপর ভিত্তি করেই সরকার জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালানোর ঘোষণা দেয়। এই সরকারের আমলে জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলা হলেও কার্যত কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নড়েচড়ে বসেছে। ঘোষণা দিয়ে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়। কিন্তু যেহারে গণগ্রেপ্তার শুরু হয় তাতে স্বস্তির বদলে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অভিযোগ আসতে শুরু করল সাঁড়াশি অভিযানের সুযোগ নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা গ্রেপ্তার বাণিজ্য শুরু করেছে। ফলে অভিযানের মধ্য দিয়ে কতজন জঙ্গি তারা ধরতে সফল হলো সেই প্রশ্নটির কোনো সমাধান হলো না।
গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরিপন্থী কোনো কিছু ঘটছে বলেও নানা মহলে কথা হচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আদালতের নির্দেশনার বিষয়ে একটা স্বাভাবিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা প্রশ্ন ওঠতে পারে এবং ওঠা স্বাভাবিক। পুলিশের চলমান জঙ্গি নির্মূল অভিযান প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলে মিডিয়ায় অনেক লেখালেখি এবং কথা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে জেলাওয়ারি গণগ্রেপ্তারের বিশদ বর্ণনা উঠে আসছে। এ ঘটনায় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ‘ক্ষমতার অপব্যবহারের’ আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।অনেকেই বলছেন, গণগ্রেপ্তার করে পুলিশের কিছু সদস্য বাণিজ্য করছে। অপরদিকে এ ধরনের গ্রেপ্তারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষিত হচ্ছে বলেও ইতিমধ্যে অনেকেই বলাবলি করছে। প্রশ্ন ওঠছে চলমান সাঁড়াশি অভিযানে সরকার কতটা সফল হচ্ছে। সমালোচনার ঝড় ওঠায় ইদানীং গ্রেপ্তার কমানোর একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে কিন্তু সেটা তো আসল ইস্যু নয়। আসল বিষয়টি হচ্ছে গ্রেপ্তার ও তার পরের প্রক্রিয়া নিয়ে।
পুলিশ যদি সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পরে আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এবং সেটা না করতে পারলে যদি জবাবদিহি আদায় করা যায়, তাহলেই অহেতুক ও হয়রানিমূলক গ্রেপ্তারের সংখ্যা কার্যকরভাবে হ্রাস পেতে পারে। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের চিঠিটি প্রমাণ করে যে আইনের অপব্যবহার সম্পর্কে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সচেতন এবং এটা বন্ধ করতে তাঁদের অন্তত কেউ কেউ কখনো কখনো আন্তরিকতার পরিচয় দেন। কিন্তু এই আন্তরিকতার বিষয়টি সব পুলিশ সদস্যদের মধ্যে নিশ্চিত করা জরুরি।
দেশের অন্যতম বিরোধীদল বিএনপি প্রায় প্রতিদিনই জোরগলায় বলছে সরকার সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযানের নামে বিএনপির নেতা-কর্মীদের দমনের চেষ্টা করছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী ও জঙ্গি দমনের নামে এ ধরনের অভিযান চালিয়ে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের অন্যায়ভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এখন সাঁড়াশি অভিযানের একটি সুযোগ হচ্ছে পুলিশ আর কাউকে গ্রেপ্তারে ৫৪ ধারা দেখায় না, ‘সন্দেহজনক’ ব্যক্তি গ্রেপ্তার হবেন, তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।কিন্তু তার বদলে পুলিশ যদি নির্বিচারে গ্রেপ্তার বাণিজ্য করে, সেটা দেশে ত্রাস সৃষ্টি করবে।
আমরা বিশ্বাস করি, সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন, যাঁরা সত্যিই সন্ত্রাসবাদ দমনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে আন্তরিক। সচেতন কেউ নিশ্চয় অপরাধ দমনে কোনো শৈথিল্য দেখানোর পক্ষে নন, কিন্তু সমস্যা তারপরও হচ্ছে, বিশেষ করে যখন জঙ্গি ধরতে গিয়ে যদি সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত হয়, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে আর সন্ত্রাস দমনের নামে যদি রাষ্ট্রযন্ত্র বিচারবহির্ভূত অপরাধ দমন প্রক্রিয়াকে অনিবার্য বা তাদের নিয়তি হিসেবে গণ্য করেই ফেলে, তাহলে সেটা কি কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে? আর এই কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাবার পরও যদি অপরাধ বা সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গি দমন না হয়, তাহলে এরপর রাষ্ট্র কী করবে?
অন্যদিকে পুলিশের উচিত গ্রেপ্তার বাণিজ্যে যেন কোনো পুলিশ সদস্য জড়িয়ে না যান সেদিকে লক্ষ্য রাখা। পুলিশের গণগ্রেপ্তার বন্ধ করে প্রকৃত অপরাধী ধরার অভিযান চালানোর দিকে ঊর্ধ্বতন মহলের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।।সর্ষের মধ্যে ভূত তাড়াতে না পারলে সন্ত্রাস দমন ইস্যুতে সরকারকে চরমভাবে ব্যর্থ হতে হবে। আর এতে হুমকির মুখে পড়বে দেশের সার্বভৌমত্ব কারণ এ দেশের মানুষ আর যাই হোক জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদ পছন্দ করে না। কোন উগ্রতাকেই তারা সমর্থন করেনা।বাইরে থেকে আমদানি করা এসব জঞ্জাল থেকে সবাই মিলে বের হবার পথ খুজতেঁ হবে খুব শিগগিরই। সময় হাতে খুব অল্প।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ।