অভিমত
‘তনু হত্যার কোনো বিচার হবে না’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান মাঝে মধ্যে এমন সব সত্য কথা বলেন, যাতে রাষ্ট্রযন্ত্র বিব্রত হলেও তাদের কিছু বলার থাকে না। তাঁর ও তাঁর প্রতিষ্ঠানের নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও র্যাবের গুলিতে পা হারানো ঝালকাঠির কলেজছাত্র লিমন ন্যায়বিচার পেয়েছিলেন বস্তুত ড. মিজানের ব্যক্তিগত তৎপরতায়-এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সবশেষ তিনি কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যার বিষয়ে বলেছেন, ‘তনু হত্যার বিচারের পথ ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা বন্ধ করে দিয়েছেন। বিচারক কিসের ভিত্তিতে বিচার করবেন? সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। ময়নাতদন্ত দুবার করানো হয়েছে, মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করতে পারেনি। আর কতবার ময়নাতদন্ত করাবে?’
মিজানুর রহমান আরো বলেন, ‘দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের পর এখন আর বোধ হয় রাখঢাক করে বলার দরকার নেই, স্পষ্ট করেই বলতে পারি, তনু হত্যার আর কোনো বিচার হবে না। সুধী, নাগরিক সমাজ, মানবাধিকারকর্মী যতই চিৎকার করে বলি না কেন, ডাক্তার সাহেবরা সে পথ বন্ধ করে দিয়েছেন।’
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্রী তনু খুন হন গত ২০ মার্চ। ওই রাতে কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরের একটি ঝোপ থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় তনুর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন থানায় মামলা দায়ের করেন। তিন মাসেও খুনিদের শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
এ ঘটনায় শুরুর দিকে কুমিল্লা ও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ-মানববন্ধন হলেও এখন এসব কর্মসূচি খুব কম চোখে পড়ে না। কেননা তনুর পরে আরো অনেক ইস্যু চলে এসেছে।
বাংলাদেশ এক অদ্ভুত ইস্যুর দেশ। এখানে একটি ইস্যুর সুরাহা না হতেই অন্য ইস্যু এসে হানা দেয় এবং সঙ্গত কারণেই গণমাধ্যমের চোখ তখন সেই নতুন ইস্যুতে নিবদ্ধ হয়। চাপা পড়ে আগের ইস্যু। কিন্তু পরপর দুটি ইস্যু অনেকটা একরকম হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিক্রিয়া একেবারেই বিপরীত। যেমন চট্টগ্রামে একজন পুলিশ সুপারের স্ত্রী খুন হওয়ার পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে তৎপরতা দেখিয়েছে এবং দেখাচ্ছে, যেভাবে সারা দেশে গণগ্রেপ্তার করছে, তনু হত্যার পর তার সিকিভাগ তৎপরতাও আমরা দেখিনি। বরং এখনো তনুর পরিবারকে নানাভাবে হুমকির খবর আমরা শুনি। যারা এই হত্যার বিচার দাবিতে সরব, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে তাদের অনেককেই হুমকি দেওয়া হয় বলে আমরা শুনতে পাই।
সংবিধান-আইনের দৃষ্টিতে সবার ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারের নিশ্চয়তা দিলেও, একজন পুলিশ সুপারের স্ত্রী এবং একজন কলেজছাত্রী খুনের বিচারে আমরা তার কোনো নমুনা দেখি না। এমনকি খুন-ধর্ষণের প্রতিবাদে সাধারণ মানুষের মানববন্ধনের দৃশ্য স্বাভাবিক হলেও, আমরা দেখলাম, চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মানববন্ধন করেছেন খোদ পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা। জঙ্গি দমনে চুয়াডাঙ্গায় স্থানীয়দের হাতে লাঠি ও বাঁশ তুলে দিয়েছেন খোদ পুলিশ সুপার।
হতে পারে একজন সহকর্মীর স্ত্রীর মৃত্যুতে অনেক বেশি ব্যথিত হয়েছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা, যে কারণে তাঁদের প্রতিক্রিয়া অন্য ঘটনাগুলোর চেয়ে আলাদা। কিন্তু মনে রাখা দরকার, তাঁদের বেতন হয় সাধারণ নাগরিকের করের পয়সায়। সুতরাং কুমিল্লায় কোনো একজন কলেজছাত্রী ধর্ষিত এবং খুন হওয়ার পর তাঁরা একজন অপরাধীকেও ধরতে পারবেন না, অথচ তাঁদের একজন সহকর্মীর স্ত্রী খুনের সঙ্গে সঙ্গে হাজারো লোক গ্রেপ্তার ও আটক করবেন- সেটি খুবই দৃষ্টিকটু এবং এটি স্পষ্টত আইনের শাসনের লঙ্ঘন ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরাও চাই পুলিশ সুপারের স্ত্রী হত্যার বিচার হোক। অপরাধীরা সর্বোচ্চ সাজা পাক। সেই সঙ্গে তনু হত্যার বিচারও আমরা চাই, কিন্তু অবস্থাটা এখন এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, দেশের মানুষ কয়টা হত্যার বিচার চাইবে? কেননা, খুন তো প্রতিদিনিই হচ্ছে। আড়ালে-আবডালে ধর্ষণও কম হয় না। গণমাধ্যমে দু-চারটি আসে। অনেক ঘটনার খবর হয় না। কিন্তু কয়টা খুনের বিচার হয়? কতজন ধর্ষকের ফাঁসি হয়?
স্বাধীনতার ৪৫ বছরে বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন, তার মধ্যে এটিও একটি যে এখানে যাদের টাকা আর রাজনীতির জোর আছে, ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার কেবল তাদেরই। এখানে বিচার চেয়ে যে কোনো লাভ নেই, সে কথা সবচেয়ে ভালো বুঝেছিলেন জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক এবং সে কারণে তিনি সন্তান হত্যার বিচার চাননি। কিন্তু আমরা তাঁর মতো এত বিচক্ষণ নই বলে বারবার হত্যা ও ধর্ষণের বিচার চাই। যেকোনো অমানবিকতার বিরুদ্ধে কলম ধরি, রাজপথে নামি, গলা ফাটাই। আমরাও জানি, এই দেশে তনুরা ধর্ষিত হবে, মরবে কিন্তু বিচার হবে না।
লেখক : সাংবাদিক