ঈদে বাড়ি ফেরা
‘বাড়ি যাই, দ্যাশে যাই’
ঢাকা শহরে যাঁরা ভাড়া থাকেন, তাঁরা ঈদের সময় বাড়ি যান। আবার ঢাকায় যাঁদের বাড়ি বা নিজস্ব ফ্ল্যাট আছে, ঈদের সময় তাঁরাও বাড়ি যান। তাঁরা বলেন, ‘দ্যাশে যাই’। তার মানে ঢাকা আসলে তাদের দেশ নয়। তাদের দেশ অন্য কোথাও। সুদূর কাঞ্চনপাড়া গ্রামও তখন একটি দেশ, ঝালকাঠি শহর একটি দেশ, উলিপুর উপজেলাও একটি দেশ।
এই সময়ে গণমাধ্যমের খুব কমন শিরোনাম, ‘নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা’। অর্থাৎ এই যে নাড়ির টান, সেটির নামই বাড়ি, সেটিই দেশ। দেশের ভেতরে থেকেও মানুষ ওই নাড়ির টানে প্রকৃত দেশে যায়। এখানে দেশ মানে আলাদা ভূখণ্ড নয়। আলাদা মানচিত্র নয়। পাসপোর্ট ভিসা লাগে না। বরং ট্রেনের ছাদে চড়ে, লঞ্চের ডেকে গাদাগাদি করে, বাসের রডে ঝুলে, ঘামে সিক্ত হয়ে, হাঁপাতে হাঁপাতে তারা বাড়ি যায়, মানে দ্যাশে যায়, মায়ের কাছে যায়।
এখানে মা মানেই দেশ। এখানে বাড়ি মানে যেখানে মা থাকেন। যাঁর মা নেই কিন্তু মা ছিলেন; তিনি মায়ের কবরের কাছে যান। কারণ ওটাই তাঁর দেশ। ওখানে যাওয়ার জন্য তাঁর হাহুতাশ, মধ্যরাত থেকে সকাল অব্দি রেলস্টেশনে একটা টিকেটের জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা, একটা লঞ্চের কেবিনের জন্য এর কাছে ওর কাছে ধরনা দেওয়া; কারণ তিনি বাড়ি যাবেন।
বাড়ি ও দেশের প্রচলিত সংজ্ঞা বদলে যায় প্রতি ঈদেই। যে কারণে ঢাকা শহরে থাকা মানুষ পরস্পরকে জিজ্ঞেস করে, ঈদে বাড়ি যাচ্ছেন কবে? কেউ বলেন, কালই দেশে যাচ্ছি। বিশেষ করে গরিব মানুষ বাড়িকে দেশ বলে অভ্যস্ত। শহরে থাকা গরিব মানুষগুলো অন্যকে এভাবেই প্রশ্ন করে, ‘আপনার দ্যাশের বাড়ি কই?’ সেই ‘দ্যাশ’ হয়তো বরিশাল, সেই ‘দ্যাশ’ চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সেই ‘দ্যাশ’ শরীয়তপুরের মহিষার গ্রাম।
মানুষ বরাবরই শেকড়সন্ধানী। যে কারণে বছরের পর বছর বিদেশে থাকা মানুষও শেষ বয়সে এসে ভাবেন, আহা শেষ সময়টা যদি গ্রামের মানুষের সঙ্গে, সবুজ মাঠ, শান্ত খাল আর দূর থেকে ‘ভাইজান’ বলে ডাক দেওয়া লোকদের সঙ্গে কাটানো যায়- তাহলে কতই না ভালো হয়।
হয়তো ওই মানুষটি নিউইয়র্ক বা লন্ডনের মতো অভিজাত শহরেই বাস করেন দুই যুগ ধরে। হয়তো এখন তিনি সেখানেরই নাগরিক। কিন্তু হঠাৎ করেই তাঁর বুকের ভেতরে চিলিক দিয়ে ওঠে এক টুকরো গ্রাম। গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা কিছু সাদাসিধে মানুষ- যারা তাঁকে দেখলেই সালাম দিত। জীবনের একটা পর্যায়ে এসে তিনি হয়তো ভাবেন, সেই শেকড়ে ফিরে যেতে যেখানে তাঁর জন্ম। যেখানে মাটির নিচে তাঁর পূর্বপুরুষ শুয়ে আছেন। যেখানে কবরস্থানে পাতাবাহারের ঘনছায়ায় মায়ের কবরটা ঢাকা পড়ে গেছে। বাবার কবরটা বাঁধাই করা হয়নি। আগামী ঈদে সময় পেলেই বাড়ি গিয়ে কবরটা বাঁধাই করার ইচ্ছা আছে। মানুষ বস্তুত সেখানে ফিরতে চায়।
এই শহরে, অর্থাৎ রাজধানী ঢাকায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের অধিকাংশই এই শহরের উদ্বাস্তু-ভাড়াটিয়া। নানা পরিসংখ্যান বলে, এই শহরের ৮০ ভাগেরও বেশি মানুষ বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। বাকি ২০ ভাগ মানুষের নিজস্ব বাড়ি অথবা ফ্ল্যাট আছে। তার মানে এখানের ৮০ ভাগ বাসিন্দাই আসলে ঈদ বা এ রকম উৎসবে বাড়ি যেতে চান। কারণ এখানে তিনি থাকেন বাধ্য হয়ে। এখানে তাঁর দূরসম্পর্কের কিছু আত্মীয়স্বজন থাকলেও, স্বজন বলতে যা বোঝায়, তাঁরা দ্যাশে থাকেন।
ধারণা করা হয়, ঈদের সময় রাজধানীর ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ ঢাকা ছাড়েন। আবার দুই ঈদেই সবাই যেতে পারেন না। যদি তাই হতো, তাহলে এই সংখ্যাটি আরো বড় হতো। ফলে দেখা যায়, ঈদের আগে-পরে পুরো শহর ফাঁকা। রাস্তায় যানজট নেই। কেমন যেন একটা শূন্যতা। ফুটপাথে মানুষের ঠেলাগুঁতো নেই। যানবাহনের বিরক্তিকর হর্ন নেই।
এই যে নাড়ির টানের ফেরার ব্যস্ততা, সেটিই আসলে মানুষ হিসেবে তার অস্তিত্বের জানান দেয়। সে যে ইমোশনাল প্রাণী-অনেক প্রাচুর্য, ক্ষমতা আর ব্যস্ততার ভেতরেও তার বুকের ভেতরে খুব গোপনে যে দ্যাশ বা বাড়ির বসবাস-সেটিরই বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখি ঈদে। ফলে শহর-নগর-মহানগরের বাড়ি ফেলে মানুষ বাড়ি যায়, দ্যাশে যায়।
জীবিকার প্রয়োজন এই শহরের মানুষের শরীর বেঁধে রাখে ভাড়া বাসার চার দেয়ালে অথবা নিজস্ব ফ্ল্যাটের আভিজাত্যেই। কিন্তু তার মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও। সেই অন্য কোথাও হচ্ছে তার দ্যাশ। তার দ্যাশের বাড়ি।
লেখক : সাংবাদিক