গুলশান হামলা
আমরা কি উদ্বিগ্ন হব?
ঢাকায় অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে না- ডিএমপি কমিশনারের এমন হুঁশিয়ারির দুদিন না যেতেই দেশবাসী দেখল এক অভূতপূর্ব সন্ত্রাসী হামলা এবং সেটি কোনো দূর মফঃস্বলে নয়; বরং খোদ রাজধানীর কড়া নিরাপত্তা বলয়ে থাকা কূটনীতিকপাড়ার একটি স্প্যানিশ রেস্টুরেন্টে।
এ পর্যন্ত পাওয়া খবরে, ওই হামলায় গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম এবং বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সালাউদ্দিন আহমেদ নিহত হয়েছেন। আর কমান্ডো অভিযানে নিহত হয়েছে ৬ হামলাকারী। আটক করা হয়েছে একজনকে।
শুক্রবার রাতের এই হামলার ১২-১৩ ঘণ্টা আগে শুক্রবার ভোরে ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় মঠের এক সেবায়েতকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর এই ২৩ দিন আগে ৭ জুন ঝিনাইদহ সদর উপজেলারই মহিষাডাঙ্গা গ্রামে মহিষের ভাগাড় মাঠে কুপিয়ে হত্যা করা হয় এক হিন্দু পুরোহিতকে। তার মানে জঙ্গিরা একটি সম্মিলিত পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে এবং তারা সম্ভবত এই বার্তাটিই দিতে চেয়েছে যে, ঝিনাইদহ থেকে কূটনীতিকপাড়া- সবখানেই তারা হামলা চালাতে সক্ষম।
ফলে আমরা উদ্বিগ্ন, আতঙ্কিত ও ভীত। এই ভয়ের সবচেয়ে বড় কারণ যারা এ ধরনের হামলা চালায়, তারা নিজেদের জীবন নিয়ে ভীত নয়। তারা এমন এক ধরনের মগজ ধোলাই, এমন বিশ্বাস ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এসব কাজ করে-যাতে তারা নিজেদের মৃত্যু হবে এমন প্রস্তুতি নিয়েই হামলা চালায়। তারা বিশ্বাস করে, এটি জিহাদ এবং এই হামলায় নিহত হলে তারা শহীদ।
গুলশান ৭৯ সড়কের ওই স্প্যানিশ রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়ে কিছু লোককে খুন করে পালিয়ে গেলেও তাদের মিশন সফল হতো। কিন্তু তারা সেটি করেনি। বরং আরো কিছু দেশি-বিদেশি লোককে তারা জিম্মি করে রাখে এবং কোনো কোনো গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে যে, তারা আত্মসমর্পণের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তিনটি শর্ত দিয়েছিল যার মধ্যে রয়েছে খালেদ সাইফুল্লাহর মুক্তি; যাকে মাদারীপুরের কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে হত্যাচেষ্টার মূল পরিকল্পনাকারী বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলা এর আগেও হয়েছে। কিন্তু সরকারের তরফে বরাবরই বলা হচ্ছে, এগুলো স্থানীয় জঙ্গিদের কাজ। আইএস বা আল-কায়েদার মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু গুলশানে এই হামলার পর এটিকে আর স্থানীয় জঙ্গিদের হামলা বলার আদৌ কোনো সুযোগ আছে কি না- তা নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
এসব স্থানীয় জঙ্গিদের তৎপরতা হলেও এর পেছনে আইএস বা আল-কায়েদার মতো গোষ্ঠীর যে প্রত্যক্ষ মদদ, সহযোগিতা, প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন রয়েছে-সেটি যত দ্রুত আমরা বিশ্বাস করব-দেশের জন্য ততই মঙ্গল।
সেই সঙ্গে কোনো ঘটনার পর পরই এটিকে সরকার উৎখাতে বিরোধীপক্ষ বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র বলে যেভাবে বিষয়টিকে হালকা করে ফেলা হয়-সেটি আরো ভয়াবহ এবং আমাদের জন্য আরো বেশি ভয়ের জন্মে দেয়।
কেননা, এসব হামলায় শুধু সংখ্যালঘু, লেখক, প্রকাশক বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই যে নিহত হন তা নয়-বরং হামলাকারীরাও নিহত হয় এবং তাদের আপাতত পরিচয় জঙ্গি বা সন্ত্রাসী হলেও তারা আমাদেরই স্বজন। তারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে বা মঙ্গল গ্রহ থেকে বাংলাদেশে এসে এসব কর্মকাণ্ড করছে না। সম্প্রতি ফাহিম নামের যে তরুণ ক্রসফায়ারে নিহত হলো, গুলশানে কমান্ডো হামলায় যে ৬ জঙ্গি নিহত হলো- তারা সবাই এই জনপদের আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা। কিন্তু কেন তারা এই ধ্বংসের পথে গেল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেন এই মৃত্যু বেছে নিচ্ছে, সেটির নির্মোহ বিশ্লেষণ ছাড়া এই সমস্যা থেকে উত্তরণের সুযোগ নেই।
প্রতিটি প্রাণই মূল্যবান। প্রতিটি মৃত্যুই দুঃখজনক। সুতরাং যে কিশোর, যে তরুণ, যে যুবক তার অপার সম্ভাবনায় ভবিষ্যৎকে জঙ্গিবাদের কাছে বন্দক দিচ্ছে-তার পেছনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কী ধরনের চক্রান্ত রয়েছে, কারা এসব ঘটনার দ্বারা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায়-তার নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ ছাড়া বাংলাদেশকে ইরাক, আফগানিস্তান বা সিরিয়া হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা কঠিন।
লেখক : সাংবাদিক।