গুলশান হামলা
৭১ ভেঙে ৭/১!
ইতিহাস ঘেঁটে মনে হচ্ছে, এদেশে রাষ্ট্র আর সমাজ একদম এক মেরুতে অবস্থান নিয়েছে। ১৯৭১ সালের দিকে এমনটা ছিল না। পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর-আশি এমনকি নব্বইয়ের দশকেও রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক ছিল, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের এজেন্সির দায়িত্ব সে পালন করেছে। তবে সমাজটা ছিল একদম উল্টো। সমাজই বাংলার অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যটা টিকিয়ে রেখেছিল বিগত সময়ে। এখন সমাজও রাষ্ট্রেরই পথ ধরেছে। এই সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন, মুক্তবাজার অর্থনীতি ও করপোরেট কালচারের যুগে সমাজও হয়েছে সাম্প্রদায়িক। বাজার ও ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই এটা হয়েছে। একদিনে নয়, ধীরে ধীরে। এ যুগের নানা প্রবণতার মধ্যে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন বলতে হবে।
এত সব অসহিষ্ণুতার ঘটনায় রাষ্ট্র যে দায়িত্ব নেয় না কিংবা নিজের কর্তব্যটা পালন করে না, তা কিন্তু নয়। করতে সে বাধ্য হয়। এই যেমন ১ জুলাইয়ের ঘটনায় রাষ্ট্র ও সরকার অবশ্যই প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এসব ঘটনা কি দমনেই শুধু কৃতিত্ব? বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে ক্রসফায়ারই কি শেষ কথা? মূলে যেতে হবে না?
সরকার যেভাবে কিছু হলেই বিরোধী দলগুলোকে জড়িয়ে কথা বলে, সেই চর্চাটা থামার সময় এসেছে এখন। না হলে মনোযোগ অন্যদিকে সরে গিয়ে পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হতেই পারে। এর আগে, বাংলাদেশে ঘটা প্রায় প্রতিটি ঘটনার দায় আইএস স্বীকার করে নিলেও সরকার নাকচ করে বলেছে, দেশে আইএস নেই। আসলেই কি নেই?
২
গুলশান ২-এ কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থাকা ডিপ্লোমেটিক জোনে গত শুক্র ও শনিবার যা ঘটল, তা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। সেগুলোতেও আইএসের কথাই বলা হয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের প্রতি সংঘটিত হত্যাকাণ্ড এবং ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের রক্তাক্ত ইতিহাস এতদিন বিশ্বমিডিয়ায় তোলপাড় হওয়া ঘটনাবলির অন্যতম ছিল। তবে বিশ্বরাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষিত বিবেচনা করলে, ’৭১-এর চেতনাকে একদম তীব্রভাবে আঘাতটা সম্ভবত এই ১ জুলাইয়ের ঘটনাটাই করল!
বহির্বিশ্বে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে সাম্প্রতিক অতীতে মাস ও তারিখের ক্রমে সাজিয়ে জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছে। যেমন ৯/১১, ১/১১, ২৬/১১ ইত্যাদি। বাংলাদেশের এই ঘটনা সেই মোতাবেক ‘৭/১ গুলশান জিম্মি’ নামে পরিচিতি পাবে। কাকতালীয় কি না কে জানে, যে ৭১ সংখ্যাটা নিয়ে আমাদের এত এত গর্ব, স্ল্যাশ চিহ্নটা তার দুই অঙ্কের মাঝখানে বসে সংখ্যাটাকে ভাগ করে দিয়ে গেছে! ৭১ ভেঙে ৭/১ হয়ে গেছে! চেতনাটাও যেন তছনছ হয়ে গেছে!
অপরাধীরা সম্ভবত এটাই চেয়েছিল! এখন তো মনে হচ্ছে, এমন একটি তারিখ বেছে নেওয়াটা তাদের পূর্বপরিকল্পিত ছিল। ইতিহাসে এই দিনটি ৭/১ হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে গেল। ৭১-কে হারিয়ে দিতেই কি এই ৭/১-এর পরিকল্পনা?
৩.
বহুদিন ধরেই দেখছি, যারা এই পথে জড়িয়েছে, তাদের অধিকাংশই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। মাঝেমধ্যে যে দু-চারজন ধরা পড়েছে তাদের পরিচয় তাই বলে। ধারণা করি, প্রকাশ্যে ছাত্র রাজনীতি, ছাত্র আন্দোলন নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের এমন প্রতিক্রিয়াশীল জিম্মিকারী জঙ্গি হওয়ার রাস্তায় নিয়ে গেছে। তার চূড়ান্ত প্রমাণ ৭/১।
একবার ভাবুন তো, কোন সে পরিস্থিতি যা এদের এমন মরিয়া করে তুলল? ওরা ৫/৬ জন কি জানত না, যে খেলা তারা খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে খেলায় বাঁচার একটাই উপায়-- মারো, মরো নতুবা আমাকে মেরে ফেলো! ওরা জেনেও সে পথটাই বেছে নিয়েছে। স্রেফ ধর্মের নামে ওরা নিজেদের পরিবারগুলোকে তো শেষ করলই; অন্যন্য ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে নিরীহ ও সাধারণ মানুষগুলোকে মেরে সেই পরিবারগুলোকেও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দিল। কোনো কোনো পরিবার হয়তো শেষই হয়ে গেল!
ভাবতে পারেন কী পরিমাণ অ্যাপোলেটিক্যাল এই অ্যাপ্রোচ? যারা রাজনীতি করে কিংবা বোঝে কিংবা রাজনৈতিকভাবে বিচক্ষণ তারা কখনই এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেবে না। তারা রাস্তায় নেমেই পরিবর্তন ও প্রয়োজন দাবি করবে, করে।
কোনো কিছু আপনি নিষিদ্ধ করে রাখলে সেটার প্রতিক্রিয়া কখনো কখনো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। শুরুতে টের পাবেন না। এই যে এখন টের পাওয়া শুরু করেছেন! দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই তাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসেপ্ট ও কালচার নিয়ে ভাবার সময় এসে গেছে।
এই কিছুদিন আগেও মাদ্রাসার গরিব শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাঙালি মধ্যবিত্ত কথায় কথায় জঙ্গি খুঁজে পেত। আর আজ খোদ অর্থনৈতিকভাবে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা জঙ্গিত্ব ধারণ করে ফেলেছে! অথচ এদের আমরা ‘ডিজুস’, ‘ইয়ো ইয়ো’, ‘আনকালচারড’ জ্ঞান করে দূরে সরিয়ে রেখেছি এতকাল! আজ দেখছি, কী নিদারুণ প্যারাডক্স!
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও কাঠামোটাই খোদ ত্রুটিপূর্ণ। নিদারুণ বৈষম্যমূলক এই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। যার অর্থ আছে, ক্ষমতা আছে, সামর্থ্য আছে সে ওপরে, যার নেই সে নিচে। একই দেশে জন্মে এক পাড়ায় জন্মে শিশুরা দেখে তার বাবার টাকা নেই বলে সে মাদ্রাসায় পড়ে আর তার বন্ধুটি কিন্ডারগার্টেনে। এই বৈষম্য একদম ওপরের স্তর পর্যন্ত চলমান। আর সঙ্গে যোগ করুন, চাকরি ব্যবস্থা, বেকারত্ব, বিনোদনের অভাব আর সমাজের হেয় করার প্রবণতা ইত্যাদি। এসব থেকে যে হতাশা আসতে পারে—এগুলো কি আমরা কখনো চিন্তা করেছি?
এই হতাশ, দিগভ্রান্ত মানুষ টিকে থাকতে পারে না। সে আত্মহত্যা করাকেই শ্রেষ্ঠ পথ মনে করে। ৭/১-এ তো সেই কাজটাই এই ৫-৬টা ছেলে করল। ধর্মের নামে আত্মহত্যা করল! তাদের মারা তো হয়েছেই; তবে অনেক আগেই তারা মরে গিয়েছে!
৪.
ধর্মীয় মৌলবাদিত্ব ও গোঁড়ামি সব ধর্মে, সব দেশেই কমবেশি আছে। এগুলোকে পুঁজি করে তৃতীয় কোনো শক্তি নিজের ফায়দা ঠিকই লুফে নেয়। তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইন্দ্রজাল সবচেয়ে বেশি সুযোগটা আজকে লুফে নিচ্ছে ইসলামকে ব্যবহার করে। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি সংকট থেকে সৃষ্ট হওয়া সুন্নিপন্থী আইএস এখন আল-কায়েদার মতোই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।
আইএস কোথা থেকে অস্ত্র পাচ্ছে? কোথা থেকে প্রশিক্ষণ পাচ্ছে? কারা তাদের অর্থ সাহায্য দিচ্ছে? প্রশ্ন করাটা জরুরি। এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সারা বিশ্বের অস্ত্র ব্যবসা জারি রাখা এবং তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদের খনিগুলো দখল করার জন্য শক্তিধর আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রগুলো মরিয়া হয়ে যে প্রতিযোগিতায় নেমেছে, সেই প্রতিযোগিতায় ফুয়েল দেওয়ার নাম ধর্ম, মৌলবাদ, আইএস। এই রাষ্ট্রগুলো মোড়লগিরি করতে কোনো না কোনোভাবে আরেকটা দেশে তার সেনা, তার এজেন্ট পাঠাতে চায়। এ জন্যই দুনিয়ার দেশে দেশে এমন ৭/১ সৃষ্টি হয়ে চলেছে দিন দিন। সেই ধারাবাহিকতায় যে কোনো মূল্যে কেউ না কেউ, কোনো না কোনো তৃতীয় শক্তি বাংলাদেশে ঢুকতে চাইছে। সেটা এখানকার এজেন্টদের ক্ষমতা বসিয়ে হলেও সে ঢুকতে চাইছে।
অস্ত্র তাই শুধু এককভাবে ওই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীটির হাতেই উঠেছে, ব্যাপারটা মোটেও এমন নয় কিন্তু। এখানে ওই যে শুরুতেই বলেছি, রাষ্ট্রের সঙ্গে খোদ সমাজও আজ সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছে অনেক অনেক বেশি। যে কারণে, সমাজে মৌলবাদিত্ব বাড়ছেই। তাই ধর্মের নামে যারা মানুষ মারছে, তাদের সমর্থন করার মানুষের তো অভাব দেখা যাচ্ছে না দেশে। সাম্প্রদায়িক মানুষ বেড়েছে বলেই, সমাজও আরো সাম্প্রদায়িক হয়েছে। আর এ তো জানাই, একপক্ষ যত বেশি সাম্প্রদায়িক হতে চাইবে, আরেক পক্ষও তত বেশি সাম্প্রদায়িক হতে চাইবে।
পরিস্থিতি যখন এমন, তখন আমাদের মূলধারার দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিচক্ষণহীনতা, আমাদের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা, আমাদের অগণতান্ত্রিক চড়াও মনোভাব একটা সুন্দর দেশকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের সন্তানরা অস্ত্র তুলে নিচ্ছে। অস্ত্র তারা আগেও তুলেছে। এখন ধর্মের নামে তুলছে। পাকিস্তান আমলে, ৭১-এর আগে খোদ রাষ্ট্রধর্মের নামে মানুষ মেরেছে। ধর্মের নামেও আজ হামলা ও হত্যা চলছে। সমাজের কতিপয় বিপথগামী সন্তান সেটার দায়িত্ব নিয়েছে, এই যা।
এটা অনিবার্য এক সামাজিক সংকট। সেই সংকটের মধ্যে পড়ে যাওয়া এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ। যে দেশটাকে ৭/১ জিম্মি করে ৭১-এর গৌরবোজ্জ্বল অর্জনকে স্লান করে দিতে পারে না। বারবার সংকট থেকে এই দেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এবারও দাঁড়াবে। ৭/১ নয়, ৭১-এর বিজয়মাল্যতেই আমরা শতফুল গাঁথতে চাই।
লেখক : গবেষক ও সংবাদকর্মী