প্রতিক্রিয়া
ফ্রান্সের জন্য কান্না নাকি প্রতিরোধ?
গুলশানে জঙ্গি হামলায় রক্তাক্ত হলি আর্টিজানের সামনে যখন শোক চলছে, ঠিক সে সময়েই ফ্রান্সের নিসে ৮৪টি মানুষের লাশ। ঢাকায় বা প্যারিসে, মুম্বাই বা আমেরিকাতে, আফগানিস্তানে যাঁরা খুন হয়েছেন, তাঁরা নিতান্তই মানুষ।
তাঁদের অধিকাংশই শেষ সময়েও জানতে পারলেন না কী কারণে তাঁদের মৃত্যু? এ কোন পৃথিবী? আজ এখানে তো কাল ওখানে নিরন্তর মানুষের খুন হয়ে যাওয়ার খবর। কোনো কারণ ছাড়াই লাশ হওয়ার এই সময়ে আমরা কি শোক নাকি প্রতিরোধ- কোন দিকে গুরুত্ব দেব? আমাদের কাজ কি কেবলই মোমবাতি আর ফুলের দোকানের ক্রেতা বাড়ানো, নাকি রুখে দাঁড়ানো?
আমি রুখে দাঁড়ানোর পক্ষে। বিশ্বাস করি, একমাত্র মানুষের মিলিত শক্তিই রুখে দিতে পারে অন্ধকারের শক্তিগুলোকে। বাংলাদেশের পুরোহিত, যাজক, ব্লগার বা আর্টিজানের লাশগুলোর রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে বিশ্বের সকল প্রান্তের খুন হয়ে যাওয়া মানুষের রক্তধারা। সেই রক্তের কাছে প্রতিটি মানুষের দায়বদ্ধতা আছে, আছে ঋণ। সেই কারণেই আমি বিশ্বাস রাখতে চাই মানুষের মিলিত শক্তির ওপর।
বিশ্বের সকল নাগরিকের তুলনায় জঙ্গিদের সংখ্যা অতিনগণ্য। প্রশ্ন হলো, হাতে গোনা এই জঙ্গিদের কাছে কি আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে গড়ে ওঠা মানবসভ্যতা আতঙ্কিত হবে? নাকি মিলিত হয়ে রুখে দাঁড়ানো মানুষের সামনে খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে এই সন্ত্রাসী-জঙ্গিরা?
আমরা যদি আতঙ্কিত হতে থাকি, তাহলে সেই সুযোগটিই নেবে এই জঙ্গিরা। কারণ তাদের মূল টার্গেট পৃথিবীব্যাপী এক ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা। তাদের টার্গেট মানুষের শুভ চেতনাকে আক্রান্ত করা, শুভ আয়োজনে মানুষের অংশগ্রহণকে আতঙ্কিত করা। যে কারণেই বাস্তিল দিবসের আয়োজন থেকে ছায়ানটের রমনা বটমূল হয়ে ওঠে তাদের হামলার টার্গেট।
আমরা একটু মনোযোগী হলে দেখি, জঙ্গিদের হামলার টার্গেট দুই ধরনের- একদিকে নিতান্ত সাধারণ মানুষ। যারা যে কোনো আনন্দ আয়োজনে বা কাজের কারণে সমবেত হয়েছিল, তাদের ওপরে অতর্কিত হামলার ঘটনা ঘটনা ঘটছে।
অন্যদিকে আবার চলছে দুই ধরনের টার্গেট কিলিং। সাধারণ মানুষ সে পুরোহিত হোক আর যাজক হোক বা পীর- এঁরাই জঙ্গিদের টার্গেট। অন্যদিকে যাঁরা এই অন্ধকার শক্তির বিরুদ্ধে লড়েছেন, যাঁরা রাজপথে আছেন, সামাজিক বা গণমাধ্যমে কথা বলছেন- তাঁদেরও খুন করা হচ্ছে। তালিকা বানিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
প্রথম থেকে হত্যাকারীদের টার্গেটের যে তালিকা, সেই তালিকার সঙ্গে মেলালে তালিকায় নাম থাকা কয়েকজনের হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দেখতে পাই। দেখতে পাই, এই হত্যাগুলোকে আস্তিক-নাস্তিক বিতর্কের মধ্যে ঠেলে দেওয়ার ক্ষেত্রে খোদ পুলিশ কর্মকর্তাদের বাগাড়ম্বর। দেখি, শাসক দলসহ অনেকেরই এই মৃত্যুগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পাশ কাটানোর চেষ্টা। আরো দেখি, রাজপথের বিরোধী দলের দায় চাপানোর রাজনীতি। দেখি হুমকিপ্রাপ্তদের জীবনরক্ষার্থে ন্যূনতম নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কৃপণতা।
আজ হিসাবটা শুধু বাংলাদেশেরই নয়। ঢাকা আর প্যারিসে সব খুন হওয়া মানুষের রক্তের রং যেমন লাল, তেমনই এই খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সারা পৃথিবীর ভাষাও হতে হবে একই রকম। সাদা-কালো বা এশিয়া-ইউরোপের দূরত্ব যতই হোক, সব প্রান্তের মানবিকতা যখন আক্রান্ত তখন লড়াইটা হতে হবে সম্মিলিত। মোম বা ফুলের শোকের সঙ্গে থাকতে হবে প্রতিরোধের শপথও। থাকতে হবে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মানুষের মিলিত লড়াইয়ের জন্য হাতে হাতে একতা গড়ে তোলা।
রাষ্ট্র সরকার বা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দায়িত্ব যেমন পালন করছে, তেমনই করতে থাকুক। যারা রাষ্ট্রের নাগরিকদের হত্যা করছে, তাদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কঠোর থেকে কঠোরতর হোক। কিন্তু সব দায়িত্ব রাষ্ট্রের কাঁধে সঁপে দিয়ে বসে থাকার সময় এটা নয়, প্রয়োজন নাগরিকদের সম্পৃক্ততা। প্রয়োজন বিশ্বব্যাপী নাগরিকদের জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে শামিল হওয়ার। প্রয়োজন প্রতিটি নাগরিককে জঙ্গিবাদের প্রশ্নে পাহারাদারের ভূমিকা নেওয়ার, যোদ্ধার ভূমিকা নেওয়ার কোনোই বিকল্প নেই এই সময়ে।
লেখক, গণমাধ্যমকর্মী