তুরস্ক সংকট
সেনাবাহিনী গণতন্ত্রের বিকল্প নয়
গণতন্ত্রের অনেক সমালোচনার পরও বলা হয়, গণতন্ত্রের সবচেয়ে ভালো বিকল্প হচ্ছে গণতন্ত্র। অর্থাৎ যদি কোনো দেশে গণতন্ত্রের সংকট থাকে, তাহলে সে পরিস্থিতি উত্তরণে প্রয়োজন আরো বেশি গণতন্ত্রের চর্চা। আর সেনাবাহিনী যে নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নয়, সেটি এবার রাজপথে নেমে, প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করল তুরস্কের জনগণ।
হালের রাজনৈতিক নানা সমীকরণে তুরস্কের প্রতি আমরা বাংলাদেশিদের ক্ষোভ বা বিরক্তি থাকলেও দেশটির জনগণ যেভাবে একটি সেনা অভ্যুত্থান ঠেকিয়ে দিয়েছে, তাতে তাদের অভিবাদন জানানোয় কাপর্ণ্য করা উচিত নয়।
যে দেশে গণতন্ত্র নেই, সেখানে গণতন্ত্রের সংকটও নেই। আমরা সৌদি আরবের গণতন্ত্র নিয়ে খুব বেশি কথা বলি না বা বলার প্রয়োজনও বোধ করি না। কিন্তু আমরা আমাদের দেশের গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলি, উদ্বেগ জানাই। কারণ, নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও আমরা এক ধরনের গণতন্ত্রের চর্চার ভেতরে রয়েছি। ফলে যখনই আমরা কম গণতন্ত্রের উপস্থিতি টের পাই বা যখন দেখি যে রাষ্ট্রযন্ত্র আমাদের যথেষ্ট গণতন্ত্র দিচ্ছে না, তখন আমরা আরো বেশি গণতন্ত্রের দাবি তুলি এবং বলি, গণতন্ত্রের বিকল্প গণতন্ত্রই। যে কারণে অনেক খারাপ শাসনের পর ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলো, তাকে দেশের মানুষ স্বাগত জানায়নি। কারণ তারা জানে, অনির্বাচিত বা বন্দুকের নলে ক্ষমতায় আসা সামরিক শাসকের চেয়ে নির্বাচিত স্বৈরশাসক উত্তম। কারণ, তাদের কোনো না কোনোভাবে জনগণের প্রতিনিধি হয়েই ক্ষমতায় আসতে হয় এবং যার ফলে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা বা ম্যান্ডেটের কথা মনে রাখতে হয়। মনে রাখতে হয় এ কারণে যে, পাঁচ বছর পর তাকে আবার ওই জনগণের কাছেই যেতে হয়। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং অপরাধ কমার পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক শাসনকে বেটার মনে হলেও ভেতরে ভেতরে রাষ্ট্রযন্ত্র ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে। বোধ হয় এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিতে রাজপথে নেমে প্রাণ দিয়েছে তুরস্কের জনগণ। এটি অবশ্যই একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে অভ্যুত্থানে ব্যর্থ সেনাদের আত্মসমর্পণের যে ছবি দেখা গেছে, তা শুধু তুরস্কের ইতিহাসেই নয়, সারা বিশ্বের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেওয়ার পর তুরস্কের প্রেডিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান জাতির উদ্দেশে বলেছেন, ‘উই আর অল ইউনাইটেড আন্ডার আ সিঙ্গেল ফ্লাগ, অর্থাৎ আমরা সবাই একই পতাকার নিচে ঐক্যবদ্ধ।’
বস্তুত এরদোয়ানের কৌশলী ভূমিকার কারণেই একটি নিশ্চিত সামরিক অভ্যুত্থানের হাত থেকে বেঁচে গেছে তুরস্ক। কেননা, ক্যু প্রচেষ্টার দুই ঘণ্টা পর এরদোয়ান ফেসটাইম অ্যাপের মাধ্যমে টেলিভিশনে বিবৃতি দেন। সেখানে তিনি তাঁর সমর্থকদের কাছে আহ্বান জানান, তাঁরা যেন রাস্তায় নেমে আসেন প্রতিরোধে। শহরের মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেন ও বিমানবন্দরে জড়ো হন। তিনি বলেন, জনগণের শক্তির চেয়ে বড় আর কিছুই নেই।
তাঁর এই ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মানুষ ইস্তাম্বুল আর আঙ্কারার রাস্তায় নেমে আসে। বিমানবন্দরে যে সেনারা অবস্থান নিয়েছিল, তাদের ঘেরাও করে; পুরো বিমানবন্দর দখল করে নেয় জনতা। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন থেকে অভ্যুত্থানকারীরা বেশ কিছু ঘোষণা প্রচার করেছিল। তারা কারফিউ জারি করেছিল। কিন্তু সেটি কার্যকর করতেও তারা ব্যর্থ হয়।
তুরস্কের ইতিহাসে সেনা অভ্যুত্থান নতুন কোনো অভিজ্ঞতা নয়। কিন্তু এবার যা ঘটল, তা একেবারেই ব্যতিক্রম। জনগণ রাস্তায় নেমে এলে যে একে ফোরটি সেভেন বা এম সিক্সটিনও খেলনা পিস্তলে পরিণত হয়, সেটি দেখিয়ে দিয়েছে তুর্কিরা। একটি ট্যাঙ্কের সামনে একজন যুবকের শুয়ে পড়ার ছবিও এখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে দেখা যাচ্ছে। প্রতিবাদের এর চেয়ে শক্তিশালী আর কী ভাষা হতে পারে! ধরেই নেওয়া যায় যে ওই যুবক এরদোয়ানের দলের সমর্থক এবং তাঁর ভোটার। কিন্তু তা সত্ত্বেও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এটি একটি সাহসী উচ্চারণ। এই ছবির অর্থই হলো, জনগণই শেষ কথা। বন্দুকের নল, ট্যাঙ্কের চাকা, জলপাই রঙের ভীতি—এ সবই তুচ্ছ যদি জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়।
তুরস্কের এ ঘটনা সবচেয়ে বড় যে দিকটি উন্মোচন করেছে তা হলো, রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃঢ়তা। রাষ্ট্রের এমন বিপদের মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যদি কোনোভাবেই জনগণের কাছে পৌঁছাতে না পারতেন এবং জনগণকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানাতে না পারতেন, তাহলে এতক্ষণে তুরস্কের ইতিহাস অন্যভাবে লিখতে হত।
সুতরাং জাতির ও রাষ্ট্রের যেকোনো ক্রান্তিকালে সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্বই যে ভরসা এবং জনগণই যে সব ক্ষমতার মালিক আর গণতন্ত্রের বিকল্প যে আরো বেশি গণতন্ত্র—তুরস্কের এই ব্যর্থ অভ্যুত্থান আমাদের সে কথাই মনে করিয়ে দিল। জয় জনতা।
লেখক : সাংবাদিক।