অভিযান
গরিবের চরে হাতির পাড়া
দুই পাশে পাটক্ষেত। মাঝখানে একটু খালি জায়গা। কাদায় দাঁড়িয়ে আছে বিশাল দেহের হাতিটি। তাকে ঘিরে কয়েকশো মানুষ। চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ক্যামেরাপারসন সুকান্ত সরকার আনুমানিক ২০০ গজ দূর থেকে ছবি নিচ্ছেন। তাঁর পাশে আমি এবং রিপোর্টার মাকসুদ উন নবী। প্রথম দেখায় হাতিটিকে বেশ শান্তশিষ্ট মনে হলো। কিন্তু মিনিট দুয়েক পরই শুধু একটা গণশব্দ, দৌড়। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমিও ভোঁ দৌড়। কিন্তু পাটক্ষেতের ভেজা আর পিচ্ছিল সরুপথে (আইলে) পড়ে গেলাম উপুড় হয়ে। চোখ থেকে ছিটকে গেল সানগ্লাস। আমাকে টেনে তুললেন স্থানীয় সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন মিন্টু। বললেন, ভাই তাড়াতাড়ি ওঠেন। অদূরে মাকসুদ ডাকছেন। ভাই ওঠেন, দৌড় দেন। নাকানিচুবানি খেয়ে কোনোমতে উঠে আবার দৌড় এবং পেছনে তাকিয়ে দেখি, হাতিটি স্থির দাঁড়িয়ে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ডানে টার্ন নিল। আমরা বাঁয়ে।
এসব কিছুই ঘটল কয়েক সেকেন্ডে। মৃত্যুর একেবারে কাছাকাছি থেকে ফিরে আসা যাকে বলে। কেননা, হাতিটি আমাদের দিকে দৌড়ে এলে দুয়েকজনের প্রাণহানি হতো নির্ঘাৎ।
পেশাগত কারণে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনা কাভার করলেও নিজের জান বাঁচানোর জন্য কখনো এভাবে রুদ্ধশ্বাস ছুটতে হয়নি। এ রকম খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখতে হয়নি। ঘটনার পরে জানা গেল, সাত-আট বছরের একটা শিশুকে সে শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলেছিল। কিন্তু শিশুটি অক্ষত। ঘণ্টাখানেক বাদে যখন তার সঙ্গে আমরা কথা বলি, তখনো সে কাঁপছে।
সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার মুনসুরনগর ইউনিয়নের ছিন্নার চরের এই মৃত্যুজয়ের গল্প ২০ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টার দিকে। ছিন্নার চরের মানুষ রসিকতা করে বলছেন, গরিবের বাড়িতে হাতির পাড়া। ‘আমগোর আর দুঃখ নাই। এ্যালা আর নদী ভাঙব না।’
গরিব মানুষের এই জনপদ, যেখানে বিদ্যুৎ নেই, স্যাটেলাইট কানেকশন নেই বলে বেসরকারি টেলিভিশনও দেখার সুযোগ হয় না- সেই জনপদের মানুষই এখন টেলিভিশনের পর্দায় এই হাতির কল্যাণে। ফলে এটিকে তাঁরা দেখছেন একটা সৌভাগ্য হিসেবে। বলছেন, অন্তত এই উসিলায় তাঁদের নদীভাঙনের ভয়াবহতা আর নাজুক যোগাযোগব্যবস্থার কথাটাও দেশের মানুষ জানুক। আসাম থেকে আসা এই বন্য হাতি যেন তাঁদের জীবন বিপন্নের কারণ না হয়, সেটি যেমন তাঁরা চান, তেমনি হাতিটিও মানুষের উৎপাত থেকে বেঁচে থাকুক, সেই চেষ্টাও সচেতন নাগরিকদের আছে।
এই বন্য হাতিটি এসেছে ভারতের আসাম থেকে ভেসে ভেসে। জুনের শেষদিকে যেকোনো কারণেই হোক পুরুষ হাতিটি পাহাড় থেকে পানিতে পড়ে যায় এবং আর ডাঙায় উঠতে পারেনি। ভেসে ভেসে রৌমারী সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশে। এরপর শুরু তার বাংলাদেশযাত্রা। ঘটনার ২২-২৩ দিন পর আমরা হাতিটির খোঁজে রওনা হই। কেননা ততদিনে গণমাধ্যমে খবর এসেছে হাতিটির আক্রমণ এবং তার বিপন্নতার কথা। কিন্তু তাকে খুঁজে বের করা এবং টেলিভিশনে লাইভ বা সরাসরি সম্প্রচারের পুরো বিষয়টি আমাদের কাছে ছিল একটা ছোটখাটো যুদ্ধজয়ের মতো। কেননা হাতিটি কোনো জায়গায় স্থির থাকে না। সারা দিন সে কোনো একটা চরে থাকলেও সন্ধ্যার পরেই তার স্থান পরিবর্তন হয়। পরিব্রাজকের মতো সে আজ এই চরে তো কাল ওই চরে। ফলে আমরা যখন ট্রলার নিয়ে তাকে খুঁজতে বের হই, তখন নানা গুজব আর ধারণার ওপর ভিত্তি করে আমাদের চলতে হয় যমুনার বুক চিরে।
জামালপুর, সরিষাবাড়ী হয়ে আমাদের গন্তব্য কাজীপুরের ছিন্নার চর। নানা পথ ঘুরে কাজীপুরের মিলপাড়া এলাকায় গিয়ে যখন আমরা পৌঁছাই, তখন বিকেল ৫টা। কিন্তু সেখানে গিয়ে রাস্তার যে অবস্থা দেখলাম, তাতে মনে হলো এ রকম ভয়ঙ্কর সড়ক দেশের আর কোথাও নেই। গাড়ি তো দূরে থাক, হেঁটে যাওয়াও কঠিন। অগত্যা গাড়ি রেখে আমরা ভাড়া করলাম একটা কাকরা (ট্রাক্টরের ইঞ্জিন দিয়ে বানানো স্থানীয় বাহন)। সেটিতে ঘণ্টাখানেক যাওয়ার পর মাজনাবাড়ি ঘাট। সেখান থেকে ট্রলার নিয়ে মাজনাবাড়ি। স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুর রহিমের বদান্যতায় ওই রাতে আমাদের ঠাঁই হয় দুর্গম এই চরের একটি স্কুলের ক্লাসরুমে। খুব ভোরে শুরু অভিযান।
আগের রাতে আমরা জেনেছিলাম হাতিটি ছিন্নার চরের পশ্চিম দিকে আছে। সেই অনুযায়ী যাত্রা শুরু। কিন্তু নদীর তীর ধরে যেতে যেতে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ এবং মেম্বার আবদুর রহিমের অনবরত ফোনের সূত্র ধরে আমরা অনেকটা উদভ্রান্তের মতো ঘুরতে থাকি প্রমত্তা যমুনায়। ট্রলারের তেল নেওয়ার জন্য আমাদের নোঙর করতে হয় খাসরাজবাড়ি চরের গোদারবাগে। সেখানের স্থানীয়রা জানালেন, আগের রাতে হাতিটি এইখানে ছিল এবং একটি নৌকা ভেঙে ফেলেছে। আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, খুব ভোরে হাতিটি অন্তত একটি গ্রামের ওপর দিয়ে এসেছে এবং কয়েকটি বাড়িঘর ভাঙচুর করেছে। তবে খুব বিস্ময়কর যে তথ্যটি আমরা পাই তা হলো, হাতিটি বিশাল এই প্রমত্তা যমুনা পাড়ি দেয় ক্ষিপ্রগতিতে। ইঞ্জিনচালিত ট্রলারের চেয়েও দ্রুত বেগে। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, হাতি যে তার বিশাল দেহ নিয়ে তীব্র স্রোতের বিপরীতে এ রকম ক্ষিপ্রগতিতে সাঁতরাতে পারে, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। গোদারবাগে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই রহিম মেম্বারের ফোনে তথ্য আসে, হাতিটি এই মুহূর্তে আছে ছিন্নার চরের পূর্ব উপকূলে। আমাদের ট্রলার স্টার্ট নেয় এবং দ্রুত বেগে আমরা ছুটতে থাকি ছিন্নার চরের দিকে। সেখানে নেমেই জানা গেল ঘটনার সত্যতা এবং কিছু দূর পায়ে হেঁটে আমরা পৌঁছে যাই হাতির কাছে। তাকে ঘিরে অগণিত মানুষ।
হাতির তাড়া খেয়ে আমাদের অভিযাত্রা শুরু হলেও দিনভর আবহাওয়ার আনুকূল্য এবং আমাদের লাইভ সম্প্রচারের জন্য যে ধরনের ছবি প্রয়োজন, তা পর্যাপ্ত পরিমাণে দিয়ে সহায়তা করে হাতিটি। তবে মাঝেমধ্যেই স্থানীয়দের উৎপাতে তাকে একটু শক্তি প্রদর্শনও করতে হয়।
শুধু হাতি নয়, যেকোনো প্রাণী যতক্ষণ পর্যন্ত নিজে আক্রান্ত না হয় বা নিজেকে বিপদাপন্ন মনে না করে অথবা মাংসাশি প্রাণী হলে যতক্ষণ না সে তীব্র ক্ষুধার্ত হয়, ততক্ষণ সে মানুষকে আক্রমণ করে না। আসাম থেকে আসা এই হাতিটিকে খুব কাছ থেকে দেখেও আমাদের সে রকমটিই মনে হয়েছে। সমস্যা হলো, এ রকম একটি পূর্ণ বয়স্ক হাতি যার ওজন প্রায় পাঁচ হাজার কেজি, সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে দৈনিক তার খাদ্য প্রয়োজন প্রায় ৫০ কেজি। কিন্তু চরের বড় বড় ঘাস আর ধান ছাড়া তার খাওয়ার মতো কিছু নেই। ফলে আমাদের অনুরোধে অনেকেই হাতিটির দিকে কলাগাছ ছুড়ে মেরেছেন যাতে খাদ্যাভাবে তাকে মরতে না হয়।
এই বন্য হাতিকে ঘিরে দুটি পরস্পরবিরোধী ব্যাপার রয়েছে। অর্থাৎ হাতিটিকে বাঁচিয়ে রাখা এবং সেই সঙ্গে তার আক্রমণের হাত থেকে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা। আমরা হাতিটিকে কেন বাঁচিয়ে রাখব? বাঁচিয়ে রাখব এ কারণে যে, সে এখন বিপদাপন্ন এবং বিপন্ন। বিপদে পড়ে আসাম থেকে এসেছে। অতিথি পাখির মতোই সেও অতিথি। আর মানুষের চোখের সামনে যদি না খেয়ে এ রকম বিশাল দেহের একটা প্রাণী মারা যায়, সেটি মানুষ হিসেবে আমাদের অপরাধীও করবে। কিন্তু এখানে চ্যালেঞ্জ হলো হাতিটিকে উদ্ধার করা। এ রকম বন্য হাতির খুব কাছে গিয়ে তাকে শেকল পরানো ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে উদ্ধার করা খুব দুরূহই নয়, বলা যায় অসম্ভবও। তা ছাড়া এ রকম বিরল ঘটনার মুখোমুখি কখনোই হয়নি আমাদের বন বিভাগ।
এ রকম একটি হাতিকে জীবিত এবং নিরাপদে উদ্ধার করার কোনো সক্ষমতাও যে তাদের নেই, তাও তারা আমাদের কাছে স্বীকার করেছে। তাকে অচেতন করে হেলিকপ্টার বা বড় নৌযানে নিয়ে যাওয়াও সহজ কাজ নয়। তাহলে হাতিটির পরিণতি কী হবে- তা পরিষ্কার করে বলা মুশকিল। তবে হাতিটিকে কেউ যদি বিরক্ত না করে তাহলে চরের বড় বড় ঘাস আর কলাগাছ যদি পায়, সেগুলো খেয়ে সে বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু উৎসুক মানুষ তাকে দেখতে ভিড় করবেই।
দূর-দূরান্ত থেকে ট্রলারে করে শত শত মানুষ আসছে তাকে দেখতে। তাদের এই উৎসাহ বা আগ্রহ থামিয়ে রাখা কঠিন। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন প্রতিনিয়তই মাইকিং করছে যাতে কেউ হাতটির কাছে না যায়। আবার সে আজ এ-চরে তো কাল ও-চরে। ফলে পুলিশকেও ঘুরতে হচ্ছে তার পেছন পেছন। বন বিভাগের লোকজনও আছে তার পর্যবেক্ষণে। শোনা যাচ্ছে, ভারতের একটি টিমও নাকি আসবে।
ধারণা করা যায়, আগামী শুকনো মৌসুমে যখন চরগুলো শুকিয়ে যাবে, তখন হাতিটিকে উদ্ধারের একটা উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। কিন্তু ততদিনে হাতিটির কী পরিণত হয় তা বলা মুশকিল। আবার হাতিটিকে ভারত সরকার নিয়ে যাবে নাকি বাংলাদেশেই থাকবে, তাও বলা যাচ্ছে না। তবে হাতিটি বাংলাদেশে থাকুক আর ভারতেই যাক, সে সুস্থ থাকুক এবং তার হাত থেকে মানুষের জানমাল নিরাপদ থাকুক, আপাতত এই প্রার্থনা।
লেখক : সাংবাদিক