জঙ্গিবাদ
ব্যাচেলররা কোথায় যাবেন?
ঢাকা শহরে ব্যাচেলরদের দুর্ভোগ নিয়ে নতুন কিছু লেখার নেই। বিশেষ করে এই মহানগরীতে বাসা খুঁজতে গিয়ে ব্যাচেলররা যে ধরনের বিড়ম্বনা আর কটু কথার শিকার হন; বাসা ভাড়া নেওয়ার পর বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে যে রকম অসম্মানজনক আচরণের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাঁদের যেতে হয়- তাতে অনেক সময় ব্যাচেলররা মনে করতে পারেন, তাঁরা আসলে মানুষ নন; নিতান্তই ব্যাচেলর।
এই কঠিন বাস্তবতাকে আরো কঠিন করে তুলছে জঙ্গিবাদ। কেননা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে প্রায়ই জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মিলছে বিভিন্ন মেসে এবং আবাসিক ভবনের এমন সব বাসায়, যেগুলো ব্যাচেলরদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। শুধু ঢাকাতেই নয়, ঢাকার বাইরের মেসেও এ রকম জঙ্গি আস্তানা বা সেখান থেকে জঙ্গি সন্দেহে লোকজনকে আটকের খবর পাওয়া গেছে। ফলে সব বাড়িওয়ালাই এখন ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে অনেক বেশি ভীত এবং সন্দিহান।
তাদের এই ভয় আরো বাড়িয়ে দিয়েছে টেলিভিশনে প্রচারিত একটি বিজ্ঞাপন-যেখানে তিন যুবক বাসা ভাড়া নিতে গেলে বাড়িওয়ালা বলেন, আমরা ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া দেই না। কিন্তু ওই যুবকরা ছয় মাসের ভাড়া অগ্রিম দেওয়ার কথা বললে বাড়িওয়ালা রাজি হয়ে যান। কিন্তু কিছুদিন পরই দেখা যায়, ওই যুবকরা ছিল আসলে জঙ্গি এবং সেই বাসায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
ব্যক্তিগতভাবে আমি একাধিক বাড়িওয়ালার সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলে জেনেছি, তারা ব্যাচেলরদের কাছে বাসা ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্কই শুধু নন-তারা এখন ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া না দেওয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমার এক আত্মীয় বলেছেন, প্রয়োজনে বাসা তিন মাস খালি থাকবে, কিন্তু ব্যাচেলরদের কাছে ভাড়া দেব না। আমি যে বাসায় ভাড়া থাকি, তার একটি ফ্ল্যাটেও কয়েকজন চাকরিজীবী যুবক থাকেন এবং তাদের সজ্জন বলেই আমরা জানি। তারা সবাই ভালো চাকরি করেন। কিন্তু জঙ্গিবাদী নানা ঘটনা এবং ওই বিজ্ঞাপনটি দেখার পর আমার বাড়িওয়ালাও ব্যাচেলর ভাড়াটিয়াদের ব্যাপারে তাঁর ভয়ের কথা বলেছেন।
এই ভয় এখন ছোঁয়াচে রোগের মতো সব বাড়িওয়ালাকেই স্পর্শ করছে। প্রশ্ন হলো, এভাবে সব বাড়িওয়ালাই যদি ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন বা নিরুৎসাহিত হন, তাহলে ব্যাচেলররা কোথায় যাবে?
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদিও বলেনি যে ব্যাচেলরদের কাছে বাসা ভাড়া দেওয়া যাবে না। তারা বলছে, কারো কাছে বাসা ভাড়া দেওয়ার আগে তার সম্পর্কে জেনে নিন। তার জাতীয় পরিচয়পত্রসহ যাবতীয় তথ্য সংগ্রহে রাখুন এবং থানায় জমা দিন।
ঢাকা শহরের বাড়িওয়ালারা ব্যাচেলরদের কাছে নানা কারণেই বাসা ভাড়া দিতে আগ্রহবোধ করেন না। অনেক বাড়ির সামনে সাইনবোর্ডও টাঙানো থাকে যে, এই ভবনের কোনো ফ্ল্যাট ব্যাচেলরদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয় না। আমি যে রাস্তা দিয়ে অফিসে যাওয়া-আসা করি, সেখানেই একটি বহুতল ভবনে এ রকম সাইনবোর্ড দেখি এবং মনে করতে পারি, যখন ব্যাচেলর ছিলাম, তখন এই শহরে বাসা ভাড়া পেতে গিয়ে কী দুর্বিষহ যন্ত্রণা আমাদের পোহাতে হয়েছে। ওই সময়ে বাসা খোঁজার এই বিড়ম্বনায় আমার সহযাত্রী ছিল সাংবাদিক বন্ধু বেলাল হোসেন, বছর কয়েক আগে যে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। আমরা বহুদিন একই বাসায়, একই রুমে থেকেছি। বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে নানাবিধ অসম্মানজনক আচরণের শিকার হয়ে বেলাল প্রায়ই বলত, ‘মনে হয় এই অত্যাচার থেকে বাঁচতেই বিয়েটা করে ফেলতে হবে…।’
ঢাকা শহরে ব্যাচেলর মানেই যে সবাই অবিবাহিত, তা নয়। বরং বাসা ভাড়া নেওয়ার সংস্কৃতিতে ব্যাচেলর শব্দের অর্থ এখন একা থাকা। অর্থাৎ আপনি বিবাহিত হওয়ার পরও যদি পরিবার ছাড়া একা থাকেন এবং কোনো বাসায় টু-লেট লেখা দেখে যদি বাসা ভাড়া নেওয়ার জন্য আপনার পরিচয় দেন যে, আপনি বিবাহিত কিন্তু বাসায় একা থাকবেন অথবা আপনার আরো দু-তিনজন সহকর্মী একসঙ্গে থাকবেন, তাহলেও আপনাকে ওই ব্যাচেলর হিসেবেই গণ্য করা হবে। তার মানে এখানে ব্যাচেলর শব্দটি আর শাব্দিক অর্থ অবিবাহিতর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
এমনিতেই যেখানে বাড়িওয়ালারা ব্যাচেলরদের কাছে বাসা ভাড়া দিতে চান না, সেখানে এখন জঙ্গিভীতির কারণে ব্যাচেলরদের জন্য বাসা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে এবং ক্রমশই এটি কঠিনতর হবে। তাহলে ব্যাচেলররা কোথায় থাকবেন?
শহরে যেসব ব্যাচেলর বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন, তাঁদের বড় অংশই শিক্ষার্থী। একটি বড় অংশ চাকরিজীবী। কিছু আছেন ব্যবসায়ী। কিছু আছেন চাকরিপ্রার্থী; যারা সদ্য পড়ালেখা শেষ করেছেন। আবার কিছু ব্যাচেলর অনেক ভালো বেতনে অনেক সম্মানজনক চাকরি করেন। কিন্তু নানা কারণেই পরিবার থেকে আলাদা থাকেন। কিছু আছেন বিবাহিত। কিন্তু একা থাকেন বলে তাঁরাও ব্যাচেলর। সুতরাং এই বিপুলসংখ্যক মানুষ এখন সন্দেহের তালিকায়। বিশেষ করে যারা বিভিন্ন মেসে থাকেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে অভিযান চালাচ্ছে, তাতে মেসে থাকা ব্যাচেলরদের মধ্যে একটা অজানা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে এ কারণে যে, তাঁরা জানেন না, তাঁরা যাঁদের সঙ্গে থাকেন, তাঁদের মধ্যে কারো জঙ্গিসংশ্লিষ্টতা আছে কি না। যদি থাকে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি তাঁদের ঘরে অভিযান চালায় এবং দুয়েকজনেক ধরে নিয়ে যায়, তাহলে বাকিদেরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হবে। তাঁরা নির্দোষ বা নিরীহ হলেও হয়রানি তাঁদের পিছু ছাড়বে না।
ফলে প্রশ্ন উঠছে, ব্যাচেলররা কোথায় যাবেন? তাঁদের জন্য কি ঢাকা বা এ রকম বড় শহরের বিভিন্ন স্থানে তাঁবু টানিয়ে শরণার্থী ক্যাম্পের মতো আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা হবে?
লেখক : সাংবাদিক।