খোলাচোখে
পৌনঃপুনিক ভয়ের গল্প
ভয় আমাদের সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায়। নানাবিধ ভয়। আমাদের ভয় দেখায় আইএস , জেএমবি, আনসার আল ইসলাম, বাংলা ভাইয়ের প্রেতাত্মা। আমাদের মাথার ওপর ৫৭ ধারা; অন্যদিকে ৫৪ ধারা, আমরা ভয় পাই রিমান্ডের জিজ্ঞাসাবাদ।
আমরা ভয় পাই আমাদের প্রতিবেশীকে। পাশের ফ্ল্যাটের ব্যাচেলরের দিকে আমরা সন্দেহের চোখে তাকাই। কেননা আমরা তাকে ভয় পাই। আমরা জানি না, তার ওয়্যারড্রবের ভেতরে প্রিয় ফুটবল দলের জার্সি নাকি গ্রেনেড লুকানো। আমরা এখন কালো পাঞ্জাবিও ভয় পাই। মহল্লায় ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিতি, যে কি না নিয়মিত ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলে , তাঁকে দেখেও আমাদের সন্দেহ হয়।
আমরা ঘুমাতে গেলে ভয় পাই। কেননা আমরা জানি না, কাফকার মেটামরফসিসের মতো ভোরে ঘুম থেকে জেগে আমরা দেখব কি না যে, আমরা তেলাপোকা বা জঙ্গি হয়ে গেছি।
ভয় আমাদের পিছু ছাড়ে না। আমরা সাহসী জাতি। মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বীরের জাতি। কিন্তু আমাদের প্রতিনিয়তই ভয় দেখানো হয়। ভয় পেতে পেতে আমরা ক্রমশ ভীত জাতিতে পরিণত হচ্ছি। এখন আমরা নিজের ছায়া দেখেও ভয় পাই।
ব্রিটিশ কবি লর্ড বায়রন বলেছেন, ‘ভয় মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে।’ ফলে আমাদের ভয় দেখাতে দেখাতে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
এই ভয় ক্রমশ পরিণত হচ্ছে এক ধরনের ফোবিয়ায়; যার ফলে আমরা সারাক্ষণই বহুবিধ ভয়ের কাঁটাতারে পরিবেষ্টিত থাকি। পাড়ায় বাচ্চারা পটকা ফাটালেও আমরা জানালা খুলে বোঝার চেষ্টা করি, ওটা জঙ্গি হামলা কি না। পুলিশ আমাদের পাড়ায় নিয়মিত টহলের অংশ হিসেবে সাইরেন বাজিয়ে চলে গেলেও আমরা পরস্পরকে জিজ্ঞেস করি, তারা কোনো জঙ্গিবিরোধী অভিযানে যাচ্ছে কি না।
ভবনে একটু বেশি মানুষের শোরগোল শুনলেই আমরা জানবার চেষ্টা করি, কোনো বিপদ হলো কি না; যতক্ষণ না আমরা নিশ্চিত হই সেই শোরগোল আসলে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের-ততক্ষণ আমরা কাঁপতে থাকি।
মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, ভয় মনের অবচেতন স্তরের একটি বিশেষ অবস্থা, যার নির্দিষ্টতা আছে কিন্তু এটি সেই নির্দিষ্টতা অতিক্রম করলে ভয়রোগ/ ভীতিরোগ/ ফোবিয়ায় রূপ নেয়। আমরা সাধারণত যেসব কারণে ভয় পাই তার মধ্যে রয়েছে, অন্ধকার, অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ঘটনা, দুর্ঘটনা, রোগ, হিংস্র প্রাণী ইত্যাদি। কিন্তু এসবের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে জঙ্গিবাদের ভয়, যা অন্য যেকোনো ভয়কে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই ভয় কোনো জন্তু-জানোয়ারের কারণে নয়। এই ভয়ের উৎস মানুষ, যাকে বলা হয় এন্ড্রোফোবিয়া (Androphobia)। এই ভয় অনেকটা মৃত্যুভয়ের মতো, যাকে বলা হয় থানাটোফোবিয়া (Thanatophobia)। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে অচেনা অনেক বিষয় জড়িত-ফলে এটিকে অনেক সময় জেনোফোবিয়াও (Xenophobia) বলা হয়।
অনেকে মনে করেন, ভয় হচ্ছে ভাইরাসের মতো, যা দ্রুত অন্যকে স্পর্শ করে। খুব শক্তিশালী মনের অধিকারী না হলে বা সাহসী না হলে, যে কারো মধ্যেই যেকোনো বিষয়ে ভয় বিস্তৃত হতে পারে।
যেমন বিস্তৃত হয়েছে চাপাতির ভয়, গ্রেনেড ও পিস্তলের ভয়। একসময় মানুষ যেমন চোর-ডাকাতকে ভয় পেত, রাস্তায় বেরোলে ছিনতাইকারীকে ভয় পেত-সেসব ভয়কে ছাড়িয়ে গেছে জঙ্গিবাদের ভয়। কে যে আসলে জঙ্গি, কে কোন এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত, তা বোঝা মুশকিল। ফলে মানুষ এখন তার ঘনিষ্ঠজনদেরও ভয় পেতে শুরু করেছে। অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে। এই ভয় আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে, আমাদের জানা নেই।
মানুষ এখন কোনোকিছু লিখতে গেলেও ভয় পায়। কী লিখলে কে তার কী ব্যাখ্যা করবে এবং তার পরিণতি কী হবে-তা নিয়ে ভীত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা। কেননা এখানে সক্রিয় ৫৭ ধারা।
আমরা ফোনে কথা বলতে গেলেও ভয় পাই। কারণ কার ফোন ট্র্যাক হচ্ছে, কোন কথা কে কীভাবে ব্যাখ্যা করে কোন ঝামেলায় ফেলে, তা আমরা জানি না। ফলে আমরা সতর্ক হতে হতে ভীত হচ্ছি। আমাদের চারপাশে নানাবিধ জুজু। আমরা কেবলই ভয় পাচ্ছি। ভয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন ভয়।
এই ভয়কে জয় করাই এখন চ্যালেঞ্জ। আমাদের ভয় দূর করার দায়িত্ব রাষ্ট্রযন্ত্রের। নাগরিককে ভয় না দেখিয়ে ভয়মুক্ত রাখাই তার কাজ।কারণ সারাক্ষণ ভয়ের মধ্যে থাকা মানুষ নিজের ভেতরে সেঁধিয়ে থাকে। আমরা নিজের ভেতরে সেঁধিয়ে থাকতে চাই না। আমরা খোলাপ্রান্তরে গলা ছেড়ে গান গাইতে চাই। আমরা নির্ভয়ে পথ চলতে চাই। হে রাষ্ট্রযন্ত্র, আমাদের ভয় ও শংকা দূর করুন।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও উপস্থাপক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর