প্রতিক্রিয়া
পরের বুলি কেন বলিস, নটের মত কেন চলিশ?
‘হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন—
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।’
সেকালে বঙ্গভাষা কবিতায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত সুদূর ফ্রান্সের ভার্সাই নগরে বসে সনেট লিখে বাংলায় ভাব প্রকাশ না করতে পারার জন্য আক্ষেপ করেছিলেন। মাতৃভাষার প্রতি মমত্ব প্রকাশের ব্যাকুলতা তাঁকে বাংলা সাহিত্য রচনায় নিবেদিত করে। শুধু মাইকেল মধুসূদন নয়, অনেকেই মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ প্রকাশ করে কবিতা কিংবা সাহিত্য রচনা করেছেন।
রামনিধি গুপ্ত তাঁর স্বদেশি ভাষা কবিতায় লিখেছেন—
নানান দেশের নানান ভাষা।
বিনে স্বদেশীয় ভাষা,
পুরে কি আশা?
কত নদী সরোবর কিবা ফল চাতকীর
ধারাজল বিনা কভু
ঘুচে কি তৃষা?
আমাদের দেশপ্রেম, মা ও মাটির সঙ্গে সখ্য অন্য যেকোনো জাতি থেকে পৃথক করেছে। এই পরিচয় ও প্রাপ্তি আমাদের জন্য কম নয়। ঠিক এ অবস্থায় এ দেশের শিক্ষার্থীরা, যাঁরা কি না দেশীয় সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, তাঁদের ভিনদেশি একটি ভাষায় সাক্ষাৎকার দেওয়াটা বেশ বিব্রতকর। দেশি ভাষায় সম্ভব না হলে, আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ইংরেজি ভাষাকে উপেক্ষা করে হিন্দিতে সাক্ষাৎকার দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা আছে কি-না, এটা বোধগম্য নয়। বাংলা, ইংরেজিতে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকার যদি গণমাধ্যমে প্রচার করা সম্ভব না হয়, তাহলে অনুবাদ করে প্রচারের যে সংস্কৃতি ছিল সেটা অনুসরণ করা যেতে পারত। ভিনদেশি ভাষাচর্চা করাটা নেহাত অন্যায় হবে না। যদি সেখানে আমাদের নিজ ভাষাকে সম্মানের আসনে রাখা যায়। এভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) শিক্ষার্থীদের হিন্দিতে সাক্ষাৎকার দেওয়াটা আমাদের জন্য বিব্রতকর।
বেশ কদিন আগে রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকও হিন্দিতে সাক্ষাৎকার দিয়ে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। আজ শিক্ষার্থীদের এই কর্মকাণ্ড আমাদের আবারও ভাবতে বাধ্য করবে। আমরা কীভাবে গড়ে উঠছি? কার্যত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমাদের কী শেখানো হচ্ছে? বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বারবার আলোচনায় আসছে বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ড দিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গিবাদ ইস্যুতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় যখন সমালোচনা চলছে, তখন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) শিক্ষার্থীদের হিন্দিতে দেওয়া সাক্ষাৎকার আমাদের আবারও নাড়া দিয়ে দিল। বিশ্ববিদ্যালয় কি শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেম শিক্ষা দেয় না? বিবিসি হিন্দি সার্ভিসের সঙ্গে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে ব্যাপক সমালোচনা। বেশ কদিনের ব্যবধানে আবারও একই ধরনের ঘটনা ঘটল।
সাক্ষাৎকারটি বিবিসি হিন্দির অফিশিয়াল ফেসবুকে সম্প্রচার হওয়ার পরপরই বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলা বা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যোগাযোগের ভাষা ইংরেজি ব্যবহার না করে ছাত্রছাত্রীরা কেন হিন্দি ব্যবহার করল, তা নিয়ে শুরু হয় তীব্র সমালোচনা। সমালোচনা এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়টির অনেক শিক্ষকের পক্ষ থেকেও। বিবিসি হিন্দি বিভাগের ওই ভিডিওর নিচে বহু বাংলাদেশি ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে মন্তব্য করেছেন।
সমালোচনার একপর্যায়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের এক বক্তব্য গণমাধ্যমে এসেছে, ‘রিপোর্টারের অনুরোধেই ছাত্রছাত্রীরা হিন্দিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছে, যাতে ভারতের সাধারণ মানুষ সহজেই তাদের কথা বুঝতে পারে।’ ভারতের মানুষকে বোঝানোর জন্য যদি সাক্ষাৎকার দেওয়া হয়ে থাকে, সেটা হিন্দি থেকে ইংরেজিতে হলে সবচেয়ে ভালো হতো। ভারতের জনগণ হিন্দিতে কথা বলায় অভ্যস্ত হলেও কার্যত সেখানে অনেক ভাষা প্রচলিত। তাতে করে সমগ্র ভারতে হিন্দি থেকে ইংরেজি ভাষা বুঝতে সক্ষম মানুষ বেশি হবে বলে মনে করি। সঙ্গে অন্যান্য দেশের জনগণও ইংরেজি বুঝতে সক্ষম। তাহলে কেন হিন্দিতে এই সাক্ষাৎকার? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও সামগ্রিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে বিতর্কিত করতে কোনো গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ কাজ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।
আমরা একসময় পশ্চিমা সংস্কৃতিকে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির জন্য হুমকি বলে বুলি ফুটালেও আজকাল দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। প্রতিবেশীদের সংস্কৃতি আমাদের যেভাবে গ্রাস করে চলেছে, তাতে হিন্দি টিভি চ্যানেলগুলো আর কটা বছর চললে আমরা বুঝতে পারব; আমাদের অবস্থা কি বেহাল দশায় পরিণত হয়। মূলত পশ্চিমা সংস্কৃতি নয়, প্রতিবেশী সংস্কৃতি আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির জন্য বড় হুমকি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি এভাবে হিন্দিতে সাক্ষাৎকার দেওয়া শুরু করে, তাহলে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষা বাংলা তার আসল রূপে টিকে থাকবে কি না, সেটা সন্দিহান!
আমাদের সময়ে স্কুলে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া হতো বাংলায়। ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’—এই বাক্যটা কাউকে সাহস করে বলতে পারলেই হলো; তাতেই কেল্লা ফতে! সে পটে যেত। এরপর একটা সময় এর বাংলা-ইংরেজি মিশ্রিত ভাষার প্রচলন। তখন সবাই প্রেমের প্রস্তাবে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বলার পাশাপাশি ‘আই লাভ ইউ’ বলত। কিন্তু আজকাল ছেলেমেয়েরা হিন্দিতে প্রেমের প্রস্তাব দেয় ‘ম্যায় তুমছে পেয়ার কারতা হু’। হিন্দি ভাষার মাধুর্যতা আর বলিউডের ছবির একটা প্রভাব তো আছেই; সঙ্গে হিন্দি সিরিয়ালের জয়জয়কার অবস্থা আমাদের সংস্কৃতিকে, বিশেষ করে আমাদের ভাষাকে গ্রাস করে চলেছে।
আগে থেকেই কলোনিয়াল একটা মানসিকতা আমাদের মধ্যে বহমান থাকায় ইংরেজিকে গ্রহণ করতে হয়েছে। আমাদের লেখাপড়ার বিষয়বস্তু অনেকটা ইংরেজিনির্ভর। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশ্বায়নের এ যুগে টিকে থাকার জন্য আমাদের এ ছাড়া বোধ হয় আর উপায় ছিল না। কিন্তু হিন্দির ক্ষেত্রে সমস্যা কী? এমন প্রশ্ন যে কেউ করতে পারেন। বলছি, ভাষা শিক্ষা কোনো অপরাধ নয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা বরং এটা নিয়ে গর্ব করত; কে কটা ভাষা জানে। তখনকার সামাজিক প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ কোনো ভাষার প্রচলন না থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে হোক আর শেখার আগ্রহ থেকে হোক, সেটা করা হতো। কিন্তু আজকাল তো আর সে সমস্যা নেই। অন্যদিকে হিন্দি শিখতেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বাংলা, ইংরেজি ব্যবহারের সুযোগ থাকার পরও যদি হিন্দি ব্যবহার করা হয়? তখন প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক। আমাদের যে ভাষা আছে, সেটা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তাহলে কেন আমরা অন্য ভাষায় কথা বলব? পরের কোনো জিনিস নিজের মতো করে নেওয়ার মধ্যে মোটেও সার্থকতা ও আনন্দ নেই। এতে বরং নিজের বৈশিষ্ট্য লোপ পায়। যারা এটা করে, তারা নিজেদের পরিচয় নিয়ে সন্দেহে থাকে বলে এটা করে থাকে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠুক আমাদের তরুণ প্রজন্ম। সঙ্গে নিজ দেশের সাহিত্য, সাংস্কৃতির ধারক-বাহক হয়ে আলো ছড়াক সারা পৃথিবীব্যাপী।
লেখক : যুক্তরাজ্যপ্রবাসী।