শোকের আগস্ট
বঙ্গবন্ধুর চলে যাওয়া ছিল অস্বাভাবিক
বঙ্গবন্ধু বাঙালির জাতির পিতা। কিন্তু তিনি একদিনে কিংবা এমনিতেই জাতির পিতা বনে যান নাই। সে জন্য তাঁকে পুরো জাতির আস্থা অর্জন করতে হয়েছে দিনে দিনে। নিতে ও দিতে হয়েছে পিতার মতো সারা দেশের মানুষের ভালোবাসা। প্রচলিত ধারায় আমরা সাধারণভাবে জানি যে, যিনি সন্তান জন্ম দেন, তাঁকেই সেই সন্তানের বাবা বলা হয়। আর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামক দেশটিরই জন্মদাতা। বাঙালি জাতিকেও উপহার দিয়েছেন একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি। সে জন্য তাঁকে জাতির জনক উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে।
বাবার মৃত্যু নিয়ে শেকসপিয়ার তাঁর ট্র্যাজিক ‘হ্যামলেট’ নাটকে কবিতার ভাষায় বর্ণনা করেছেন—বাবার মৃত্যু নিয়ে কান্না করতে নেই, কারণ তোমার যিনি বাবা, তিনি তাঁর বাবাকে হারিয়েছেন। তাঁর বাবা আবার তাঁর বাবাকে হারিয়েছেন, এভাবে বংশপরম্পরায় বাবাদের হারাতে হারাতে আজ আমরা এখানে। কাজেই আগের তাঁরা যেহেতু তাঁদের বাবাকে হারাতে হারাতে এই পর্যন্ত এসেছেন, কাজেই তোমাদেরও এ নিয়ে এত দুঃখিত হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। শেকসপিয়ার তাঁর নাটকের মাধ্যমে বিশ্বের সব বাবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আমি আমার নিজের বাবাকে হারিয়েছি গত বছর, অর্থাৎ ২০১৫ সালের ৯ আগস্ট। সে হিসেবে এ বছরের (২০১৬) ৯ আগস্ট তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। গত বছর আমার বাবার (হেকমত আলী—৭৫) মৃত্যুর সান্ত্বনা হিসেবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, লেখক এবং ইংরেজি সাহিত্যের শেকসপিয়ার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম আমাকে ‘হ্যামলেট’ নাটকের মর্মস্পশী এ কয়েকটি চরণ উপহার দিয়ে বলেছিলেন, বাবার মৃত্যুতে এর চেয়ে বড় সান্ত্বনা আমার কাছে আর নেই। আপনি যেহেতু লেখেন, যদি সময়-সুযোগ হয়, তাহলে বিশ্বের সব বাবাকে নিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে লেখার চেষ্টা করলে হয়তো আপনার মন কিছুটা হালকা হতে পারে। সে জন্য আমার বাবার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করার জন্য পৃথিবীর সব পিতৃহারার জন্য আমার এ লেখা উৎসর্গীকৃত।
বিশ্বের সব বাবার সঙ্গে তাই আজ বাংলাদেশের জাতির জনকের নামটিও বারবার মনে পড়ছে। কারণ, বিশ্বের বেশির ভাগ বাবারই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের জাতির জনকের মৃত্যুটি স্বাভাবিক হয়নি। কাজেই এ শোকাবহ আগস্ট মাসে তাঁকে নিয়ে কোনো সান্ত্বনাই পাওয়া যায় না। আর বাঙালি জাতির জন্য তো বটেই, বিশ্ব মানবতার ইতিহাসেও এ আগস্ট মাসটি একটি শোকের আবহ সৃষ্টি করে থাকে। কারণ আমরা জানি, আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি, যুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশি-বিদেশি চক্রান্তের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র ১১ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ সপরিবারে হত্যা করে। বাবা-মা এবং পরিবারের সব নিকট সদস্যকে হারিয়ে নির্বাক বঙ্গবন্ধুর কন্যাদ্বয় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পিতৃশোকে এখনো কাতর রয়েছেন।
এখানে একটি বিষয় খুব পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে, আমরা আমাদের বাবাদের স্বাভাবিক মৃত্যুতে কতটুকু শোকাহত হচ্ছি, আর বঙ্গবন্ধুর কন্যাগণ কীভাবে তাঁদের বাবা-মাসহ পরিবারের সব সদস্যের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে সহ্য করে নিচ্ছেন? ২০০৪ সালের এ আগস্ট মাসের ২৪ তারিখে একটি পরিকল্পিত ঘৃণ্য সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটাতে চেয়েছিল এ দেশে। সেখানে আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী আজকের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নির্মম যন্ত্রণায় মারা গিয়েছিলেন সেদিন। তার পর ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টে একমাত্র মানিকগঞ্জ জেলা বাদে সারা দেশের ৬৩ জেলায় একবারে একই সময়ে জেএমবির বোমা হামলায় স্তম্ভিত হয়েছিল দেশবাসী। আবার আন্তর্জাতিকভাবে দেখতে গেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জাপানের হিরোসিমায় ‘লিটল বয়’ নামে এক পারমাণবিক বোমা মেরে সেখানকার দেড় লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করে। এ নির্মমতা এখানেই শেষ না হয়ে তার মাত্র তিন দিন পর ৯ আগস্টে ‘ফ্যাট ম্যান’ নামে আরেকটি পারমাণবিক বোমা মেরে সেখানে আরো অর্ধলক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। এ মৃত্যুর মিছিলেও অনেকের বাবা, সন্তান ও মা ছিলেন। কাজেই শেকসপিয়ারের অনুভূতিকে ধারণ করে আজকে আমার বাবার স্বাভাবিক মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করার পাশাপাশি সপরিবারে বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধুসহ বিশ্বের সব বাবাকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম, দোয়া, প্রার্থনা ও শুভেচ্ছা।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।