অলিম্পিক ২০১৬
এখনো বাংলাদেশ ক্রীড়া পর্যটক!
নেই। নেই এবং নেই। ক্রীড়াক্ষেত্রে বাংলাদেশের বলার মতো তেমন সাফল্য নেই। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে শুরু হবে ‘নেই’-এর মিছিল! কেউ বলবেন, যথার্থ অবকাঠামো নেই। কারো মুখ থেকে বের হবে- পর্যাপ্ত অর্থ নেই। কেউ বলবেন, নিবিড় অনুশীলনের ব্যবস্থা নেই। এক পা এগিয়ে কেউ বলবেন- দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই। এসব ‘নেই’-এর যোগফল, অলিম্পিকে আমাদের কোনো পদক নেই।
কিন্তু আমাদের একটা জিনিস আছে। অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার উদগ্র বাসনা! এটা কি শুধু অলিম্পিকের মূল স্পিরিট মেনে অংশ নেওয়ার জন্য? আপাতত তাই মনে হতে পারে। আসলে এই ইচ্ছা, বাসনার পেছনে শুধুই ক্রীড়া মনস্তত্ত্ব কাজ করে তা নয়। আছে আরো অনেক হিসাব-নিকাশ। যার বড় একটা খাত পর্যটনপিপাসু মনের চাহিদা মেটানো।
যে কোনো পদমর্যাদায় সবাই গেমসে অংশ নিতে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। মন্ত্রী-এমপি-অলিম্পিক কর্তা থেকে ফেডারেশন কর্তারা। সবাই ক্রীড়া পর্যটকের মতো ছুটে যান। তাই অলিম্পিকে বাংলাদেশ দলে অ্যাথলেটদের সংখ্যার চেয়ে কর্মকর্তাদের বহরটা বড়। এবারও তাঁর ব্যতিক্রম নয়।
সাতজন অ্যাথলেট। কিন্তু কর্মকর্তাসহ বাংলাদেশ দলটা ১৪ জনের! এর বাইরে অভিজ্ঞতা অর্জনপিপাসু মন্ত্রী-এমপিরা তো আছেনই। এশিয়ান গেমস বলুন, কমনওয়েলথ গেমস বলুন সব জায়গায় একই অবস্থা। বাংলাদেশ দলে সদস্যসংখ্যা বাড়ে। বাজেট বাড়ে। কিন্তু পদক বাড়ে না। বিভিন্ন ইভেন্টে এর সংখ্যা বরং কমে। তাহলে যাঁরা অভিজ্ঞতা অর্জনে যান, তাঁদের অভিজ্ঞতাটা কোথায় কাজে লাগে?
এই প্রশ্নের অপ্রিয় উত্তর কেউ শুনতে চান না। অতীতে চাননি। আগামীতে চাইবেন, তেমনটা ভাবারও আপাতত কোনো কারণ নেই। আমাদের ক্রীড়া সংস্কৃতি যে স্তরে দাঁড়িয়ে, সেটা আশাও করা যায় না। অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধিরা আসেন অলিম্পিক বা বড় বড় গেমসে। সেসব দেশ ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবেও লোক পাঠায়। কিন্তু সেখানেও অনেকগুলো বিষয় বিবেচনা করা হয়। বিশেষ করে ক্রীড়া বিশ্বে লোকগুলোর ইমেজ। আগামীতে তাঁরা খেলাধুলায় কী প্রভাব রাখতে পারবেন, এসব বিষয় অগ্রাধিকার পায়।
পাশের দেশ ভারতের অ্যাম্বাসাডর হিসেবে রিও-তে গেছেন শচীন টেন্ডুলকার। সাবেক হওয়ার পরও ক্রিকেট বিশ্বে এখনো ভারতীয়দের ‘মুখ’ তিনি। কিন্তু অলিম্পিকের অ্যাথলেটদের কাছে শচীন অপরিচিত নাম না হলেও খুব পরিচিত তা বলা যাবে না। সেই শচীন অলিম্পিক ভিলেজে ঢুকে নিজেই অভিভূত। অলিম্পিক ভিলেজের সঙ্গে তাঁর পরিচয় নেই। কিন্তু ’৯৮ সালে কুয়ালালামপুরের কমনওয়েলথ গেমস ভিলেজে ছিলেন। কারণ, সেবার ডিসিপ্লিন হিসেবে ক্রিকেট ছিল কমনওয়েলথ গেমসে। আগামী ২০২৪ সালে রোম বা প্যারিসে অলিম্পিক হলে সেখানে ফিরবে ক্রিকেট। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটেই হবে। তবে খেলাটা তো ক্রিকেট। তাই আগামীর কথা মাথায় রেখে ভারত কিন্তু শচীনকে পাঠিয়েছে। একই সঙ্গে তিনি ভারতের রাজ্যসভার সদস্য। কিন্তু বাংলাদেশ? আমাদের উজ্জ্বল অতীত নেই। ধূসর বর্তমান। আলোহীন ভবিষৎ। তাই আমরা আগামীর কোনো উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা ভাবতে পারি না।
আগামীতে ক্রিকেট অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্ত হবে। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে যে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল পাঠানো হলো সেখানে আগামীর কথা ভেবে একজন তারকা ক্রিকেটারকে কি পাঠানো যেত না? মাশরাফি-মুশফিক-সাকিবরা আগামীতে অবসরে চলে যাবেন। কিন্তু তাদের একজনকে পর্যবেক্ষক হিসেবে পাঠালে ক্ষতি কী ছিল? আগামীতে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই গেমসের কথাটা তো তাঁরা বলতে পারতেন। ওদের কথা বাদ দিন। এমপি, আমলাদের যদি যেতেই হয়, সেখানেও তো দু-একজন ক্রীড়াবিদ ছিলেন, তাঁরা কেন নন? বাংলাদেশ দলের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয় সংসদ সদস্য। তাঁকে পাঠানো যেতে পারত প্রতিনিধিদলে। সেটাও ভবিষ্যতের কথা ভেবে। কিন্তু আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি, তার কোনো নমুনা কি রাখতে পারছি ক্রীড়াঙ্গনে? না। এখানেও পরিকল্পনা বলে কিছু নেই। এখানেও সেই ‘নেই’-এর গল্প।
কিন্তু এবার রিও অলিম্পিক দেখিয়ে দিচ্ছে অনেক কিছু না থাকলেও অনেক কিছু করা যায়। আমাদের অনেক কিছু নেই। তবে একটা দেশ আছে। একটা পতাকা আছে। একটা জাতীয় সংগীত আছে। বাংলাদেশের সেই লাল-সবুজ পতাকা উঁচিয়ে ধরে গলফার সিদ্দিকুরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল মার্চপাস্টে অংশ নিলেন। আবার সেখানেই ক্রীড়াবিশ্ব দেখল, যাদের দেশ নেই। পতাকা নেই। জাতীয় সংগীত নেই। তাঁরাও মার্চপাস্টে অংশ নিলেন। ওঁদের পরিচয় ওরা উদ্বাস্তু। ওঁদের কেউ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের নাগরিক। কেউ গৃহযুদ্ধে আত্মীয়-পরিজন হারিয়ে শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা। ওঁদের প্রতিদিন তিনবেলা খাবার জোটে না। তারপরও ওঁদের আছে প্রবল ইচ্ছাশক্তি। অবিশ্বাস্য প্রাণশক্তি। মানবিক সব সমস্যা পেছনে ফেলে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কাউন্সিলের পতাকা হাতে নিয়ে তাঁরা মার্চপাস্টে অংশ নিলেন। আমাদের তাঁরা দেখিয়ে দিলেন, মৃত্যুর উপত্যকা পেরিয়ে অলিম্পিকে আসা যায়! গোলাবারুদের গন্ধের মধ্য দিয়ে প্রাণভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে রিও পর্যন্ত যাওয়া যায়। অলিম্পিক পদকের আশা করা যায়। পদক না পেলেও ক্রীড়া বিশ্বের কাছে তুলে ধরা যায় নিজেদের অদ্ভুত জীবনকাহিনী!
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি