হাতির মৃত্যু
ক্ষমা করো বঙ্গবাহাদুর!
ক্ষমা করো বঙ্গবাহাদুর! আমরা তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না। সামান্য একটি হাতিকে উদ্ধার বা তাকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তাও দিতে পারল না আমাদের বন বিভাগ। অতিরিক্ত চেতনানাশক প্রয়োগ, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা আর খাদ্য সংকটেই যে তোমার মৃত্যু হয়েছে, সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
তোমার মৃত্যুর দায় কিছুটা আমারও। কারণ, তুমি যমুনার চরে চরে ঘুরছিলে। তোমাকে খুঁজে বের করে দেশবাসীর সামনে হাজির করেছিলাম আমরা। তারপরই তোমাকে উদ্ধারের তৎপরতা। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রতিনিধিদলের উদ্ধার অভিযান। এবং সেই সফল অভিযানের হয়তো কাঙ্ক্ষিত পরিণতিই তোমাকে বরণ করতে হলো।
তুমি একটা হাতি। তোমার মৃত্যুতে আমাদের কিছু যায়-আসে না। আমরা মানুষ। সৃষ্টির সেরা জীব। তুমি আমাদের ফসল নষ্ট করেছ। কিছু মানুষের ঘর ভেঙেছ। তোমার তাড়া খেয়ে আমি নিজেও আহত হয়েছি। তুমি দেড় মাসের বেশি সময় আতঙ্কিত করে রেখেছিলে যমুনার বিভিন্ন চরের মানুষকে। তারা মশাল নিয়ে রাত জেগে পাহারা দিত, যাতে তুমি কারো ওপর আক্রমণ করতে না পারো।
তোমাকে নিয়ে গণমাধ্যমে এত এত খবরে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। তির্যক মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, দেশে এত ইস্যু থাকতে হাতিটিকে নিয়ে আমরা কেন এত বাড়াবাড়ি করছি? এবার আশা করি সেই মানুষরাও খুশি। হাতিটি মরে গেছে। অতএব, তাকে নিয়ে আর কোনো বাড়াবাড়ি হবে না। ফেসবুকে গালাগাল এবার নিশ্চয়ই বন্ধ হবে।
১৯৯৬ সালের ১৮ মে আমার চোখের সামনে মৃত্যু হয় দাদাজানের। স্বজন হারানোর বেদনা ওই প্রথম অনুভব করি। তারপর আজ মঙ্গলবার ভোরে অফিসে যখন আমাদের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি হিরক গুণ জানান, হাতিটির মৃত্যু হয়েছে, আমার চোখ থেকে দরদর করে পানি বের হয়। ভাষা হারিয়ে ফেলি। একটি হাতির জন্য কেন আমার এই কষ্ট? এটা কি খুব বাড়াবাড়ি নয়?
হয়তো বাড়াবাড়ি। আমাদের জামালপুর প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন মিন্টুও ফোন করে কেঁদেছেন। মোবাইল ফোনের ওপারে আমি এই বয়সী মানুষের কান্না শুনেছি। হয়তো এটাও খুব বাড়াবাড়ি। আমাদের রিপোর্টার মাকসুদের চোখও ছলছল। একটি হাতির জন্য আমরা কাঁদছি। খুব বাড়াবাড়ি!
তবে এই মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমাদের বন বিভাগ একটি হাতিকে সুস্থ করা তো থাক, উদ্ধারেও ব্যর্থ। চিকিৎসার জন্য তাকে গাজীপুরের সাফারি পার্কে নিয়ে যাওয়ার যেসব গল্প আমাদের বলা হয়েছে, এখন মনে হচ্ছে তার সবই ভাঁওতাবাজি। কিছু অনভিজ্ঞ লোক যেভাবে হাতিটিকে ট্রাঙ্কুইলাইজ করছিল, তাতে সোমবার বিকেলেই আমরা ধারণা করছিলাম, হাতিটি শেষমেশ মারাই যাবে।
অবশ্য অনেকেই চাইছিল না হাতিটি বেঁচে থাকুক। কারণ, জুনের শেষদিকে ভারতের আসাম থেকে ভেসে আসার পর ক্রমেই সে মানুষের মাথার ওপর একটা বোঝা হতে থাকে। সেই বোঝা সে নিজেই সরিয়ে দিল। যদিও ভালোবেসে বন বিভাগ তার নাম দিয়েছিল ‘বঙ্গবাহাদুর’। প্রতিবেশী দেশ থেকে এসে বাংলার নাম ধারণও তাকে বাঁচাতে পারল না মৃত্যুর হাত থেকে। আমরা মেরেই ফেললাম তাকে।
১১ আগস্ট হাতিটিকে মোটামুটি উদ্ধারের পর তাকে রশি ও শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল গাছের সঙ্গে। কিন্তু সেই বাঁধন ছিঁড়ে সে আবার নেমে গেছে ফসলের ক্ষেতে। তাকে একবার বাঁধা হয়, ফের ছুটে যায়। এভাবে একদিকে তাকে বাগে আনার চেষ্টা, অন্যদিকে পোষ মানতে না চাওয়ার বন্যতা তাকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে ফেলে; তার ওপর পর্যাপ্ত খাদ্য ও চিকিৎসা না পাওয়া এবং অতিরিক্ত চেতনানাশক প্রয়োগ। সব মিলিয়ে তার মৃত্যুর যাবতীয় আয়োজনই আমরা সম্পন্ন করেছিলাম বেশ সফলভাবেই।
একটি হাতি নিয়ে আমাদের কেন এত উদ্বেগ? কেন আমাদের এত বাড়াবাড়ি? কারণ খুব ছোট্ট। তা হলো, মানবিকতা। আমরা একটি শিশু পানিতে বা গর্তে পড়ে গেলে যে রকম উদ্বিগ্ন হই, স্রোতের টানে কোনো শিক্ষার্থীর ভেসে যাওয়ার খবর যে রকম আমরা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করি, সেভাবে এই বিপদাপন্ন হাতিটির পাশে দাঁড়ানোও গণমাধ্যমের দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি।
মানুষ শুধু মানুষের জন্যই বেঁচে থাকবে এবং বিপদাপন্ন মানুষের পাশেই দাঁড়াবে, তা তো নয়। মানুষকে সব সৃষ্টির সেরা মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এ কারণে যে, সে অন্য সব প্রাণীকে ভালোবাসবে ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। যখন শীতের দিনে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আশ্রয়ের জন্য আমাদের দেশে আসে, তখন আমরা তাদের মারতে নিষেধ করি। আমরা বলি, তারা আমাদের অতিথি। সুতরাং এই হাতিও বিপদে পড়ে বানের জলে ভেসে ভেসে আমাদের দেশে চলে এসেছিল। বাঁচার জন্য সে অনেক ফসল নষ্ট করেছে। কারো কারো বাড়িঘরও ভেঙেছে। কিন্তু সে নিজেও হয়তো এসব চায়নি। কারণ, বনের পশু যখন লোকালয়ে আসে বা ভিনদেশে আসে, তখন এখানের সবকিছুই তার কাছে নতুন। সবাইকেই সে শত্রু মনে করে। সুতরাং যখনই তার কাছাকাছি বেশি লোক গেছে, সে তাড়া করেছে। সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার ছিন্নার চরে তার তাড়া খেয়ে আমিও আহত হয়েছি। কিন্তু তারপরও এই প্রাণীটির প্রতি এক অদ্ভুত ভালোবাসা উপলব্ধি করছি। সেই ভালোবাসার বন্ধন ছিন্ন করে সত্যি সত্যিই আমাদের ছেড়ে চলে গেল বঙ্গবাহাদুর। আমাদের ক্ষমা করো বাহাদুর, কারণ কটি হাতিকে বাঁচানোর মুরদও আমাদের নেই।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।