অভিমত
ইরম শর্মিলার অনশন ও ভবিষ্যৎ লড়াই
‘মানুষ কেন বুঝতে চাচ্ছে না আমি একজন সাধারণ মেয়ে, দেবী নই। মানুষের মতো করে বাঁচতে চাই’- ইরম শর্মিলা চানুর এই আকুতি বারবার আমার কানে ভাসছে। প্রতিদিনের হাজারো ঘটনার ভিড়ে শর্মিলা চানুর সংবাদটি খুব বেশি একটি নাড়া দিতে পারেনি আমাদের সংবাদমাধ্যমকে। যেখানে প্রতিক্ষণই মৃত্যুর আতঙ্ক কিংবা প্রিয়জনের জঙ্গি হয়ে ওঠার আশঙ্কা আমাদের তাড়া করে ফিরছে সেখানে কোনো শর্মিলা তার ১৬ বছরের অনশন ভেঙে মানবী হয়ে ওঠার সংগ্রাম করছে তা নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? তারপরও শর্মিলা প্রসঙ্গটি আমার কাছে অনেক ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে তার এই দেবী থেকে মানুষে নেমে আসার এই অধঃপতনে(!) যাওয়ার আকাঙ্ক্ষার কারণেই।
ইরম শর্মিলা চানুর গল্প মিডিয়ার দৌলতে এখন মোটামুটি সবারই জানা। তারপরও সংক্ষেপে তার ১৬ বছরের চমকপ্রদ ইতিহাসটা তুলে ধরছি। মণিপুরের মেয়ে শর্মিলা। উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থেকেও দেশীয় রাজার রাজত্ব সেখানে স্বীকৃত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘১৯৪৭-এর মণিপুর সাংবিধানিক আইন’ অনুযায়ী রাজাকে মাথায় রেখেই গণতান্ত্রিক ধাঁচের সরকার তৈরি হয় মণিপুরে। ১৯৪৯ সালে মণিপুরের রাজা বোধচন্দ্রের সঙ্গে ভারত সরকারের চুক্তি হয়। ওই বছরই অক্টোবরে ভারত ভুক্ত হয় মণিপুর। ১৯৫৬ সালে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের মর্যাদা। পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা মেলে ১৯৭২ সালে। গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিতে থাকে এই রাজ্যে। সেই সূত্র ধরেই ‘সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) আইন ১৯৫৮’ বা আফস্পা প্রয়োগ।
গুরুতর অভিযোগ উঠতে থাকে এই আইনের অপপ্রয়োগ নিয়েও। সেই ইতিহাসেই জুড়ে আছে শর্মিলা চানুর এই ১৬ বছরের অনশন। সরকারি পশু চিকিৎসা বিভাগের কর্মী ইরম নন্দ আর ইরম সাখির নয় ছেলেমেয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ইরম শর্মিলা। ১২ ক্লাসের পরীক্ষা শেষ করে কিছুদিন স্টেনোগ্রাফি শেখেন। ইম্ফলের উপকণ্ঠে মালোমে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা দশজনকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মেরে ফেলেন আধা সামরিক বাহিনী আসাম রাইফেলসের সদস্যরা। ঘটনাটা শুনে সাইকেল চালিয়ে মালোমে পৌঁছে যান শর্মিলা। রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা রক্তের দাগ দেখে হঠাৎ করেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন শর্মিলা। মণিপুরে সেনাবাহিনীর এই আধিপত্য শেষ করতে হবে। সেই যে এক বৃহস্পতিবার একার সিদ্ধান্তে শর্মিলার অনশন শুরু হয়েছিল, সেই অনশন চলেছে ১৬ বছর ধরে। অনশন করে আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করছেন অভিযোগে দুদিন পরেই গ্রেপ্তার হন শর্মিলা। কিছুদিন পরেই শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে শর্মিলার। সরকারের নির্দেশে তাঁর নাকে নল ঢুকিয়ে তরল খাদ্য, পানীয় দেওয়া হতে থাকে। সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রত্যাহার করা নিয়ে ইম্ফলের লড়াইয়ের খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশেই।
‘আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট’ (AFSPA) বা ‘আফস্পা’ নামের এককালে আইনের রক্ষাকবচে কিছুই হয় না দোষী ভারতীয় সেনাসদস্যদের। ভারত সরকার মণিপুরসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে ‘আফস্পা’ বলবৎ করে ১৯৮০ সালে। এই অ্যাক্টের বলে ভারতীয় সেনাবাহিনী কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই যেকোনো লোককে তল্লাশি, গ্রেপ্তার, কিংবা গুলি করে হত্যা করতে পারে। সেনাবাহিনীর এই সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে গেলে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হয়। অ্যাক্ট চালু হওয়ার পরই ভারতের উত্তরাঞ্চলে সেনাবাহিনীর তৎপরতা অনেক বেড়ে যায়। সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনের দোহাই দিয়ে চালু হওয়া সেনা অভিযানে নিরীহ মানুষও হামলার শিকার হয়। ১৯৫৮ সালে আইনটির জোরে মণিপুরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হত্যা, অত্যাচার, অপহরণ, ধর্ষণ সব কিছুকেই জায়েজ করা হয়। জনরোষের সামনে পড়ে সরকার বারবার তদন্ত কমিশন বসিয়েছে। অপরাধ প্রমাণও হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো অপরাধী সেনা বা কর্মকর্তার শাস্তি হয়নি।
এদিকে ১৬ বছর ধরে ‘আফস্পা’ প্রত্যাহারের দাবিতে অনশন চালিয়ে গিয়েছেন শর্মিলা। তাঁকে জওহরলাল নেহরু হাসপাতালের একটি কক্ষে বন্দি করে নাক দিয়ে জোর করে রাইলস টিউব পুরে দিয়েছেন সরকারি চিকিৎসকরা। নল খুলে ফেললে তো বটেই প্রতিবারই জামিন পেলে ফের আত্মহত্যার চেষ্টার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এভাবেই চলেছে পৃথিবীর ইতিহাসের দীর্ঘতম অনশন-পর্ব।
ভারতে অনশন এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। দুর্নীতি রোধের জন্য শক্তিশালী লোকপালের দাবিতে গান্ধীবাদী আন্না হাজারের মাস ছয়েক ধরে দফায় দফায় ১১ দিন অনশন নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়। সেটা শেষ হতে না হতেই প্রচারমাধ্যমে আসে ২০০২ সালের সংখ্যালঘু নিধনের প্রশ্রয়দাতা তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ও বর্তমানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনশন ‘শান্তি, একতা ও সামাজিক সম্প্রীতি’ বৃদ্ধির জন্য। এমন লোকদেখানো অনশনের ভিড়ে অতিসাধারণ ইরম শর্মিলা চানুর টানা ১৬ বছরের অনশন ভারতীয় মিডিয়া ও জনগণের উপেক্ষার ভেতর দিয়েই বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম অনশন কর্মসূচির ইতিহাস সৃষ্টি করল। একের পর এক সরকার এসেছে, গেছে, কিন্তু সেনাবাহিনীর ওই বিশেষ ক্ষমতা আইন তুলে নেওয়া হয়নি। আর একই সঙ্গে ঘটেছে আরো বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা।
সেই সব হত্যার ঘটনায় যেসব পরিবার হারিয়েছিল তাদের প্রিয়জনদের, তারাও এসে দাঁড়িয়েছে শর্মিলার পাশে। ২০০৪ সালে থঙজাম মনোরমাকে ধর্ষণ করে তারপরে গুলি চালিয়ে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। তার প্রতিবাদে মধ্য তিরিশের মণিপুরি নারীরা সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে আসাম রাইফেলসের দপ্তরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। তাঁদের হাতে ছিল ব্যানার ‘ভারতীয় সেনা, আমাদেরও ধর্ষণ করো।’ সেই প্রতিবাদী নারীরাও এসে দাঁড়িয়েছেন শর্মিলার লড়াইয়ের পাশে, তৈরি হয়েছে ‘শর্মিলা কানবা লুপ’।
আন্নার ক্ষতির আশঙ্কায় যেমন উদ্বিগ্ন ছিল ভারত সরকার, যেভাবে চারদিনের কারাদণ্ড দিয়েও, মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তেমনটা শর্মিলার ক্ষেত্রে হয় না। আন্নার দাবি মেনে নেওয়া হলেও শর্মিলার দাবি মানা হয় না। আন্না-মোদির অনশন নিয়ে সংবাদমাধ্যমের ব্যাপক প্রচার মানবাধিকারকর্মীদের হতাশ করেছে। এ ব্যাপারে ভারতীয় জনগণের মনোভাবও খুবই দুঃখজনক। অরুন্ধতী রায় বলেছিলেন, “আন্নাকে ঘিরে এই ‘আন্দোলন’ এক উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ, যে উগ্র জাতীয়তাবাদ উত্তর-পূর্বের কোনো মহিলার আন্দোলনকে গ্রহণ করবে না। ভারতের ক্রিকেট বিশ্বকাপে জয় বা পোখরানে সাফল্যের পরে বা সংরক্ষণবিরোধী সমাবেশেও একই ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদের ছোঁয়া থাকে। অনশন বলতে ইরম শর্মিলার অনশনকে বোঝায় না।”
ভারতীয় টিভি চ্যানেল এনডিটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শর্মিলা বলেছিলেন, ‘ওটা (আন্না হাজারের আন্দোলন) খানিকটা লোকদেখানো। আমরা কীভাবে দুর্নীতি দূর করব? আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি, আমি সমাজটাকে বদলাতে চাওয়া এক সাধারণ মেয়ে। ওসব সোশ্যাল ওয়ার্কার, সোশ্যাল অ্যাকটিভিস্ট সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।’
তবে আর যাই হোক, মণিপুরে শর্মিলা হয়ে ওঠেন পূজনীয়। কিন্তু ঘটনা পাল্টে যায় তখনই, যখন শর্মিলা ঘোষণা দেন অনশন ভাঙতে চান তিনি। যেহেতু এতদিনেও তাঁর লড়াই সরকারকে হার মানাতে পারেনি, তাই বিধানসভার নির্বাচনে অংশ নিয়ে অন্যপথে অধিকার আদায় করবেন। একই সঙ্গে ঘোষণা করেন যে ডেসমন্ডকে বিয়ে করে সংসারী হতে চান তিনি। গোয়ান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ মানবাধিকারকর্মী ও লেখক ডেসমন্ড শর্মিলার ‘অন্ধভক্ত’। তাঁদের সম্পর্ক বেশ কয়েক বছরের। ডেসমন্ডই চিঠির পর চিঠি লিখে লৌহমানবীর মন গলিয়েছিলেন। ২০১১ সালের ৯ মার্চ দেখা হয় তাঁদের। তখন এক সাক্ষাৎকারে ডেসমন্ড বলেছিলেন, ‘আমি জানি, এই মেয়েটির সঙ্গে সম্পর্ক চালানো আমার পক্ষে খুবই কঠিন হবে। যেমন কঠিন কাজ করতে হয়েছিল গাঁধীর স্ত্রী কস্তুরবা বা জন লেননের স্ত্রী ইয়োকো ওনোকে।’ প্রথম থেকেই এই সম্পর্ক নিয়ে প্রচণ্ড আপত্তি ছিল ইরমের সমর্থকদের। যে শর্মিলার নাকে নল লাগানো ছবি হয়ে উঠেছিল উত্তর-পূর্বের আন্দোলনের মুখ, তাঁর এহেন ‘সাধারণ’ চাওয়া-পাওয়াই মেনে নিতে এখন অসুবিধে হচ্ছে মণিপুরের। তাই ছাত্রী থেকে সমাজকর্মী, মুদিখানার মালিক বা সরকারি কর্মী, সকলের মুখেই প্রশ্ন— ‘আফস্পা’ বদলানো না-হলেও কেন অনশন ভাঙতে চান চানু? কেন তিনি বিয়ে করতে চান আর পাঁচটা ‘সাধারণ’ মেয়ের মতো? কেন নামতে চান ভোট-ময়দানে? শর্মিলাও জানতে চান- ‘তাঁর মৃত্যুই কি সবাই কামনা করেন?’
পরিস্থিতি এমনই যে, মুক্তির পর তিন জায়গায় রাত কাটাতে গিয়েও জনবিক্ষোভে ফিরে আসতে হয়েছে শর্মিলার। নিজের মা ও ভাই মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আর কোনো উপায় না পেয়ে ফের জওহরলাল নেহরু হাসপাতালের সেই পুরোনো ঘর, যেখানে তিনি ছিলেন বন্দি, সেখানেই ফিরে আসতে হয়। কিন্তু অনশন ভাঙার ২৪ ঘণ্টা পর সিদ্ধান্তে অনড় শর্মিলার পাশে ফিরে এসেছেন তাঁর এতদিনের সহযোদ্ধা বাবলু লৌইতংবাম। সঙ্গে আছেন শুভানুধ্যায়ী, প্রাক্তন রাজ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা টি রমেশ।
শর্মিলাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অনেকেই বলছেন ‘বিশ্বাসঘাতক’। মণিপুরের দুই কট্টর জঙ্গি সংগঠন কেওয়াইকেএল ও কেসিপি সরাসরি শর্মিলাকে বার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছে— ডেসমন্ডের প্রেম আসলে ভারত সরকারের পাতা ফাঁদ। আন্দোলনের আদর্শ ছেড়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঠিক করেননি তিনি। সিদ্ধান্ত বদল করতে হবে। ভোটে দাঁড়ানোর তো প্রশ্নই ওঠে না। আর যাঁকে বিয়ে করতে চেয়ে এত কাণ্ড, সেই ডেসমন্ড কি আসবেন মণিপুরে? ই-মেল করে আপাতত কোনো জবাব মেলেনি তাঁর কাছ থেকে। এখন কী করবেন শর্মিলা? ডেসমন্ড যদি সত্যিই ভালোবাসার ‘ফাঁদ’ পেতে থাকেন, তাহলে শর্মিলা কি আরো বেশি মুষড়ে পড়বেন নাকি সাধারণ মানুষ হয়ে উঠতে চাওয়ার যে অমানসিক যন্ত্রণা তা সহ্য করে একাই লড়ে যাবেন? এমন প্রশ্নই ভাসছে মণিপুরে। তবে ১৬ বছর ধরে যে নারী লড়াই করে গেলেন, তাঁর ওপর হঠাৎ করেই আস্থা হারানো কি ঠিক হবে? এমন প্রশ্নও কিন্তু উঠছে।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ