আমার শিক্ষক প্রফেসর আবদুল জলিল
প্রতিনিয়ত স্বপ্নের মধ্যে তিনি বেঁচেছিলেন, সৃষ্টির আনন্দ ও বেদনার সৌন্দর্যের মধ্যে তিনি বেঁচেছিলেন। ষাট বছরের যে জীবন তিনি যাপন করে গেছেন সেই জীবন একজন শিক্ষক-শিল্পীর জীবন, একজন অসাধারণ প্রতিভাধর মানুষের বিপুল প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকার জীবন। বয়স তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি কখনোই। আক্ষরিত অর্থে নয়। কৈশোর কিংবা বার্ধক্য কোনোটাই যেন তাঁর ছিল না। যৌবন নিয়ে জন্মে ছিলেন। অফুরন্ত যৌবনের মধ্যে তিনি বেঁচেছিলেন এবং বিপুল যৌবন নিয়ে তিনি চিরদিনের জন্য চলে গেলেন। এই মানুষটি আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রফেসর আবদুল জলিল।
জলিল স্যারের নাম শুনেছিলাম বড় ভাইদের কাছে। সেলিম ভাই, ইউসুফ ভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম। বাসায় আলোচনা হতো। একজন নিবেদিত শিক্ষকের প্রতিচ্ছবি চোখের সামনে ভাসত। আস্তে আস্তে বড় হয়ে কাছ থেকে দেখলাম স্যারকে। স্যার আসতেন আমাদের বাসায়। মাছ ধরার জন্য। মাছ ধরা স্যারের একটি শখ ও গুণ ছিল। তখন রবিবার ছিল সরকারি ছুটির দিন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছ ধরতে পুকুর পাড়ে বসে থাকতেন তিনি। পাশে থাকত পানের বিশাল বাটা। কখনো কখনো পান শেষ হলে আম্মা নিজেই বানিয়ে দিতেন। স্যার মহানন্দে খেতেন। আর বিরাট বিরাট মাছ পেতেন। স্যার যেদিন বাসায় আসতেন আমাদের বাসা যেন উৎসবে পরিণত হতো। খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন হতো। আর আমরা ভাইরা ভয়ে ভয়ে তটস্থ থাকতাম। স্যারের পাশে থাকতাম। আব্বার সাথে তাঁর বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল।
১৯৮৫ সাল, আমি উচ্চ মাধ্যমিকে নোয়াখালী সরকারি কলেজে ভর্তি হলাম। কলেজ তখন পুরাতন ক্যাম্পাসে। টিনশেডের ঘর। জলিল স্যার তখন কলেজের প্রিন্সিপাল। আমি মানবিকে থাকায় তাঁর ক্লাস পাইনি। তবে কলেজের বিভিন্ন আয়োজনে স্যারের সাথে দেখা হতো। বাণিজ্য শাখার বন্ধুদের কাছে শুনেছি, পাঠদানে স্যার কঠোর ছিলেন, তবে তাঁর পাঠদান কেবল পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি তাঁর ছাত্রদের নানা বিষয় নিয়ে আলাপ করতেন, বিশ্বের জ্ঞান ভাণ্ডারকে তাদের সামনে উন্মুক্ত করে দিতে সচেষ্ট ছিলেন। ছাত্রছাত্রীদের জন্যে মনের দিক থেকে ছিলেন সবসময় উদার। ব্যক্তিগত মায়া-মমতা ছিল। মিডিয়ায় কাজ করার পর স্যারের সাথে কয়েকবার আমার দেখা হয়। ভীষণ প্রণোদিত করতেন। আশীর্বাদ জানাতেন। শুনেছি, আমার উপস্থাপনায় বিটিভিতে প্রচারিত বহুরূপী অনুষ্ঠান স্যার নিয়মিত দেখতেন। উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন।
জলিল স্যারকে নিয়ে লিখব, এটা তো আনন্দের বিষয় আমার জন্য, আপনজনের প্রখ্যাতি প্রকাশ গর্বের ব্যাপার। আজ স্বজন হারানো বেদনার নীল যন্ত্রণাকে বাণীরূপ দেওয়া, প্রয়াত এক শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকের স্মৃতিচারণা, হৃদয়ে অন্তর্লীন যে প্রশান্ত প্রতিমা, তাকে মূর্ত করে তোলা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন কাজ।
জলিল স্যার মহৎ, প্রাণখোলা একজন শিক্ষক ছিলেন। দারুণ সপ্রতিভ ছিলেন। বাণিজ্য বিষয়ে অনেক বই লিখেছিলেন তিনি।
কলেজের উন্নয়নে ব্যস্ত থাকতেন, কাজে তাঁর এতটুকু ক্লান্তি ছিল না, অবসাদ ছিল না, ছিল না হুড়োহুড়ি করে ইতিটানার মানসিকতা। নিরলস ছিলেন অক্লান্ত।
লেখক : টেলিভিশন উপস্থাপক