স্মরণ
স্মৃতিতে হুমায়ুন জামান
২ জুন, ২০১১ ; আসলে ৩ জুন । সন্ত গ্রেগরির নিয়মে দিন পালটেছে প্রায় এক ঘণ্টা হলো । তিন তারিখের পত্রিকা ছাপাখানায় গেছে ঢের আগে । হাতেগোনা কজন কেবল অফিসে ; এক প্লেট চানাচুর, সাথে চা, শেষ । দ্বিতীয় সংস্করণের কাজও শেষের দিকে । ইন্টারনেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধকালীন আকাশবাণীতে ‘সংবাদ পরিক্রমা’-খ্যাত (পরে) পদ্মশ্রী দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ৭৭ বছর বয়সে মারা গেছেন ; সে রাতেই । খবরটা ছোট করে হলেও যাওয়া দরকার । কিন্তু সময়ও নেই । আরেকটু ঘেঁটে নিই ; হুমায়ূন ( জামান ) ভাইকে ফরিদ ( আহমেদ ) ভাইয়ের সাথে কথা বলতে বলি ; আর লিখতে শুরু করি । ফরিদ ভাই দেরি করতে রাজি নন ; সঙ্গত কারণে ; মেল ফেল করবে — মানে সব জায়গায় কাগজ যাবে না ; আর হুমায়ূন ভাই খবরটা দেবেনই । ততক্ষণে লেখা শেষ : শিরনাম ধরে শʼতিনেক শব্দ, সাথে একটা ছবি, খবরের কাগজের ভাষায় যার নাম ‘মাগশট’ । ২০০ শব্দের মতো শেষ অব্দি গিয়েছিল । হুমায়ূন ভাইয়ের মুখে হাসি ।
১৩ অক্টোবর, ২০০৬ । বিকেলে জানা গেল মুহাম্মদ ইউনুস শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন । কাজ চলছে ; সন্ধ্যায় হুমায়ূন ভাইকে বললাম এ নিয়ে পূর্বতন ভারতবর্ষে নোবেলের সংখ্যা ছয় । হুমায়ূন ভাই লিখে ফেলতে বললেন একটা লেখা । ছোট করে সবার ছবি দিয়ে শেষপাতায় ছাপিয়েছিলাম লেখাটা, নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে ; দ্বিতীয় সংস্করণে হুমায়ূন ভাই আমার নাম দিয়ে দেন । ১৯ জুলাই, ২০১২ । প্রথম সংস্করণ চলে গেছে এমন সময় জানা গেল হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু সংবাদ । খবরটি দ্বিতীয় সংস্করণে যাবে । খবরের শুরুটা কী করে হবে লিখতে শুরু করে দিয়েছি আর ভাবছি কী কী থাকবে । হুমায়ূন ভাই এসে বললেন ওরা ঠিকমত পারবে না ; তোমাকেই লিখতে হবে ; শুরু করে দাও । পৌনে ১টা নাগাদ শেষ হলো; ৭০০ শব্দের একটু বেশি । হুমায়ূন ভাই একবার পড়ে দিলে ছাপতে দেওয়া হলো ।
এই হুমায়ূন ভাইয়ের সাথে প্রায় ২৩ বছরের পরিচয় ; ১৯৯৮-এ কয়েক মাস আর শেষের প্রায় ১০ বছর সহকর্মী হিসেবে । গেল শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে, শাহবাগে একটি বইয়ের দোকানে খুব অল্প দিনের জন্য বিকেল থেকে রাত অব্দি বই বিক্রি করতাম আর টাকা-পয়সার হিসেব রাখতাম । সেখানে আমি বিক্রেতা, বিনে-পয়সার, আর হুমায়ূন ভাই ক্রেতা, পয়সার । তখন থেকে মাঝেমাঝে দেখা— বইয়ের দোকানে, দুজনেই ক্রেতা ; অন্যত্র, পরিচিত হিসেবে । ১৯৯৩ সালে আমি ডেইলি স্টারে স্পোর্টস সাব ; আর সে সূত্রে দুজনেই একই বৃত্তের লোক । তাঁরও পত্রিকায় শুরুটা খেলাধুলার পাতা দিয়েই । ১৯৯৮ সালে মাস কয়েকের জন্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব বাংলাদেশে আর তার শেষের ১০ বছর নিউ এজে সহকর্মী ।
সেই হুমায়ূন ভাই মারা গেলেন রোববারের সন্ধ্যায় (২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫) । ঝটকা লেগেছিল বেশ খানিকটা । বেজেছিল । অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটেছে বলে নয়, চাইনি এমন কিছু ঘটেছে বলে । আমরা জানতাম যেকোনো কিছু, খুব খারাপ একটা কিছু যেকোনো সময়ে ঘটতে পারে । কিন্তু ইচ্ছে ছিল আবার আসুক, এসে বসুক তার কম্পিউটারে, কপি দেখুক । আর ফাঁকে-ফাঁকে রঙ্গ করে দেখাক জীবনের খণ্ড গল্প । তার অনেকখানি বানানো হলোই বা ।
একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছিল মাস তিনেকেরও আগে । হেঁটে ফিরছিল বাসায় ; ট্যাক্সির একটা চাকা বাম পায়ের পাতার ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল ; সামান্য চিড় ধরেছিল গোড়ালির হাড়ে । মাঝে পরীক্ষায় ধরা পড়ে ফুসফুসে কর্কটের বাস বেশ কিছু দিন ধরে । এরপর ফুসফুসে পানি জমে । আরো অসুস্থ হয়ে পড়লে সেপ্টেম্বরের বিশের সকালে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় । ফুসফুসের পানি বের করবার জন্য ছোট একটি অপারেশনও হয়েছিল । হৃদপিণ্ডে স্টেন্টিং করা হয়েছিল আগেই, ২০০৮ সালে । এটা হয়তো হওয়ারই ছিল । ৬২ বছর বয়সের মৃত্যু কি অকাল মৃত্যু? বরং অনেকটা কাছ-থেকে-দেখা একটা জীবনের চলে যাওয়ার বেদনাটা বেজেছিল বড় হয়ে।
হুমায়ূন ভাইয়ের পত্রিকায় শুরু সংবাদে কাজ করা দিয়ে ; এক কিংবা দেড় বছর বড় জোড় । বয়স বাইশ । তখন তিনি বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র । এই মহাবিদ্যালয়ই জয়নুল আবেদীনের গভর্নমেন্ট আর্টস ইনস্টিটিউট ; এই মহাবিদ্যালয়ই পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চারুকলা ইনস্টিটিউট আর এখন চারুকলা অনুষদ । জীবনের শেষ ১০ বছর নিউ এজে, সহযোগী সম্পাদক । মাঝে অধুনা-লুপ্ত বাংলাদেশ টাইমস ও মর্নিং নিউজ, নিউ নেশন, ইনডিপেন্ডেন্টে । খেলাধুলা দিয়ে শুরু, প্রধান পাতায় শেষ।
নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব বাংলাদেশ নামের একটি সংবাদ সংস্থায় কিছু দিন কাজ করেন হুমায়ূন ভাই । অল্প কদিনের মধ্যে সংবাদ সংস্থাটি বন্ধ হয়ে যায় । চলচ্চিত্র-বিষয়ক সাপ্তাহিক চিত্রালীতে তাঁর লেখা ছাপা হতো। চিত্রালীর লেখাগুলো যতটা না সাংবাদিকতার তার চেয়ে বেশি আন্তরিকতার কাজ ছিল, চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কারণে । চলচ্চিত্রের ব্যাপারটা ভালোই বুঝতেন হুমায়ূন ভাই । শখ ছিল ছবি বানাবেন কোনো একদিন, জমাট গল্প, দুর্দান্ত ক্যামেরার কাজ । দিনের প্রথম সংস্করণের কাজ শেষে দ্বিতীয় সংস্করণের অপেক্ষায় থাকা গভীর রাতের আড্ডায় প্রায়ই গল্প করতেন গ্রামের ভেতর দিয়ে হুইসেল দিয়ে চলে যাওয়া একটি ট্রেনের । হলো না; হতোও না।
তাঁর আরেকটি ভালোবাসার জায়গা ছিল অনেক আগে ছেড়ে-দেওয়া ছবি আঁকা, বিশেষ করে প্রতিকৃতি । ছেড়ে দেওয়ার বেদনা ছিল, বোঝা যেত । কথা উঠলেই মুখে বেদনা-মলিন হালকা হাসি ঝলকে উঠেই মিইয়ে যেত । তাঁর আঁকা ছবি কোনো দিন দেখিনি আমরা কেউই, কিন্তু বোঝা যেত ছবি বোঝেন তিনি । মাঝেমধ্যে বলতেন খানিকটা চেষ্টা করলে ভালো একটা কিছু হতো । আর তার ছবি আঁকার কথা বলতে গিয়ে প্রতিবার যেন একটা দীর্ঘশ্বাস দুষ্টু হাসির আড়ালে লুকিয়ে পড়ত।
তুমুল নেশা ছিল বই সংগ্রহের, পড়ারও । নিয়মিত যাতায়াত ছিল শাহবাগ, নীলক্ষেত এবং পল্টনে, নতুন ও পুরানা বইয়ের খোঁজে । সাথে বই কেনার মতো যথেষ্ট টাকা না থাকলে কিছু টাকা আগাম দিয়ে পছন্দের বইগুলো একপাশে সরিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতেন, সাথে পুরো টাকা দিয়ে পরে এসে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি । পছন্দের কিংবা পরে প্রয়োজন হতে পারে এমন কোনো বই হলে সাধ্যের বাইরে গিয়ে খরচ করতেন । শেষের এক-দেড় বছর এই মরিয়া ভাবটা খানিকটা কমে এসেছিল । সৈয়দ মুজতবা আলীর পরিণত বয়সে বই কিনতে গেলে নাকি মনে হতো বইটা তাঁকে বলছে— আমাকে আর কতদিন পড়তে পারবি? ঘটনা এবং বাক্যবিন্যাস এ রকমটা না হলেও, ভাবটা কাছাকাছি ; কোথাও যেন পড়েছিলাম, কিন্তু বই খুলে নিসন্দিগ্ধ হতে পারছি না । কথাটা হুমায়ূন ভাইকে বলেছিলাম একদিন, কাজ শেষে রাতের আড্ডায় । মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়েছিলেন।
গেল ১০ বছরে অনেক কথা হয়েছে, কথা কাটাকাটি হয়েছে ; মনের কথা হয়েছে আবার মনোমালিন্যও হয়েছে । এরই মাঝে আমরা প্রতিদিনের মতো অফিস থেকে বাসায় ফিরেছি আবার বাসা থেকে অফিসে ফিরেছি, সপ্তাহের ছুটির দিনগুলো বাদ দিয়ে । এসব ছুটির দিনের বেশির ভাগই হুমায়ূন ভাইয়ের কাটত দিনের বেলাটা বাসায়, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত অব্দি বইয়ের দোকানে, আশপাশে । কখনো-কখনো সারাদিনের জন্য পুরান ঢাকায় বেরিয়ে পড়া ; সেই পুরান ঢাকা যেখানে তাঁর জীবনের শুরুর দিকের অনেকটা কেটেছে ; ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো ; কেন-জানা-নেই বিষণ্ণতায় ডুবে পুরনো দিনে ফিরে যাওয়া । বিয়ে করেননি ; আর তাই বলতেন তারর কোনো পিছুটান নেই; পিছন ফিরে তাকাবার কেউ নেই । কিন্তু তাঁর পিছনে ফিরে যাওয়ার জায়গা ছিল — পুরান ঢাকা যেখানে তাঁর বেড়ে ওঠা কিংবা কলকাতা যেখানে তার শৈশবের মনে-না-করতে-পারা অনেক দিন ফেলে আসা । কলকাতায় যাওয়ার কথা বলতেন প্রায়ই । কলকাতায়, ঠিক যেমন ঢাকায়, তাঁর বাবা সাংবাদিকতা করতেন ; তাঁর দাদাও সাংবাদিক ছিলেন।
মাঝেমধ্যে দুম করে রেগে উঠে আবার ঠান্ডা হয়ে যেতেন । আবার আড্ডা চলত, কাজের শেষে, রাতে । ইউটিউবে পুরোনো দিনের উর্দু-হিন্দি গান বাজত ; যুক্ত পাকিস্তান, বিভাগপূর্ব ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রের গান । সেসব গান তাঁর খুব পছন্দের ছিল । তাঁর গলায় খেলতও ভালো । সেই আড্ডা আর সেভাবে ফিরবে না । তাঁর মৃত্যুতে নিউএজ হারিয়েছে দক্ষ হাত, তাঁর সম্পাদনা সহকর্মীরা হারাল ডেস্কে কাজের মজা।
লেখক : সাংবাদিক