সোজা কথা
মোবাইল ফোনে হুমকিদাতারা কারা?
আমাদের এখন সবকিছুই গা সওয়া হয়ে গেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের পরিবারের ওপর কোনো বিপর্যয় নেমে না আসছে, ততক্ষণ আমাদের কিছুতেই কিছু যায়-আসে না। নানা ধরনের অন্যায়-অবিচার আমাদের চারপাশে ঘটলেও আমরা প্রতিবাদ করতে চাই না। এতটা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছি আমরা। তার ফল এখন হাতেনাতে পেতে শুরু করেছি আমরা। আমাদের সন্তানরা কখন যে আমাদের চোখের আড়ালে জঙ্গি হয়ে উঠছে তা টেরও পাচ্ছি না। কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন বিশিষ্টজনকে মোবাইল ফোনে হুমকি দিয়ে আসছে জঙ্গিরা। যেন বিষয়টি চলতেই থাকবে।
প্রখ্যাত লেখক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী ড. ইয়াসমীন হককে গত ১২ অক্টোবর রাতে দুটি এসএমএস পাঠানো হয়। ইয়াসমীন হকের মোবাইল ফোনে আসে, welcome to our new top list! your breath may stop at anytime. রাত সোয়া ১২টার সময় তিনি পান এই খুদেবার্তাটি। আর সেদিনই রাত আড়াইটার দিকে জাফর ইকবালের মোবাইলে বার্তা আসে- Hi unbeliever! we will strangulate you soon. হুমকি পেয়ে সিলেটের জালালাবাদ থানায় জিডি করেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এর আগে তেল গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদও মোবাইলে এ ধরনের খুদেবার্তার হুমকির খবরের জন্য থানায় জিডি করেন। আনু মুহাম্মদকে হুমকিদাতা লিখেছে- Death keeps no calendar, and Ansarullah knows no time. পরের দিন থানায় জিডি করার পর আবারও তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়- Say yes to Rampal, otherwise you must will be hacked to death incredibly by us.
লেখক মইনুল আহসান সাবেরকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয় এবং তাঁর হুমকিদাতার দাবি তারা আইএস- Welcome to our new top list, you will be killed today or tomorrow-isis. এ নিয়ে মইনুল আহসান সাবের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘আইএসের কাছে এতটা মূল্যবান হয়ে ওঠার কারণ বুঝতে পারছি না।’
হুমকির কারণ বোঝা না গেলেও একটা ব্যাপারে যোগসূত্র রয়েছে আর তা হলো আনু মুহাম্মদ, জাফর ইকবাল দম্পতি এবং মইনুল আহসান সাবের তাঁরা সবাই একই মোবাইল ফোন নম্বর থেকে হুমকি পেয়েছেন। আর হুমকি দেওয়ার পর থেকে তা বন্ধ আছে।
রোববার পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, হুমকিদাতার পরিচয় পাওয়া গেছে। এঁদের সবাইকে যে নম্বরটি থেকে হুমকি দেওয়া হয়েছে ওই নম্বরটি হচ্ছে ফায়যুর রাহমান নামে এক ব্যক্তির। হুমকিদাতার ফেসবুক প্রোফাইল আইডি অনুযায়ী তার পরিচয়, ফায়যুর বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক। ‘সিলেটের ডাক’ নামের একটি পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার। জঙ্গিবাদের বিশ্বায়ন নামে তাঁর একটি প্রকাশিত গ্রন্থও আছে। ফায়যুরের দাবি, এই নম্বর তাঁর হলেও হুমকি পাঠানোর বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই। এর আগেও তাঁকে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। তাঁর নম্বর ব্যবহার করে অন্য কেউ এসব করছে বলে তাঁর দাবি।
এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিশ্চয়ই অনুসন্ধান করে দেখবেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, কিছুদিন পরপর সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা মোবাইলে এ ধরনের হুমকি পাচ্ছেন যেসব হুমকিদাতার কেউ নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম অথবা আইএস জঙ্গি বলে নিজেদের দাবি করছে। আসলে এরা কারা? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিটিআরসির সহযোহিতা নিয়ে কেন তা বের করতে পারছে না, তাও বোধগম্য নয়।
গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদসহ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে আটক আবদুল হক যে কয়টি নম্বর ব্যবহার করে হুমকি দিয়েছিল, তার মধ্যে হাফিজ ফায়যুরের নম্বরটির কথাও উল্লেখ ছিল।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে মোবাইল ফোনে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের নামে সমাজের বিভিন্ন স্তরের নাগরিকদের প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে বার্তা কারা দিয়ে আসছে তা ধরতে কেন ব্যর্থ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী? কত ঢাকঢোল পিটিয়ে আমাদের ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে মোবাইল সিমগুলোকে নিবন্ধিত করলেন। তার ফল কি আদৌ পাওয়া গেল? যদিও প্রতিমন্ত্রী দাবি করছেন, মোবাইল নিবন্ধনের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে মিরপুরসহ বিভিন্ন নিহত জঙ্গির পরিচয় জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেইস থেকে উদঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। ডেটাবেইসে আঙুলের ছাপ সংরক্ষিত থাকায় এই অগ্রগতি। এ ছাড়া বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে মোবাইল সিম নিবন্ধন থাকায় সম্প্রতি এ ধরনের জালিয়াতির কিছু ঘটনা উদঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। খুবই ভালো কথা। আমরাও চাই এসব দুষ্কৃতকারীদের খুব সহজেই ধরতে সক্ষম হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যদিও তারা বারবার বলে আসছেন জঙ্গিরা আধুনকি তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
জঙ্গিরা কি তবে বেশি শক্তিশালী? একপ্রকারে তাই কি বলতে চাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা? দিনের পর দিন জঙ্গিরা সমাজের বিশিষ্টজনদের হুমকি দিতে পারছে যখন খুশি তখন, যেমনভাবে খুশি তারা আক্রমণ করতে পারছে আর আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন ‘জঙ্গিরা নিয়ন্ত্রণে’। জঙ্গিরা যদি নিয়ন্ত্রণেই থাকে তাহলে তাদের কোথাও কার্যক্রম চালানোর আগে ধরতে পারছেন না কেন? প্রাণঘাতী অভিযানটাই কি সবচেয়ে বড় কাজ? এত অভিযান সত্ত্বেও এসব জঙ্গি মাস্টারমাইন্ডরা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসির পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, মোবাইল ফোনকেন্দ্রিক বিভিন্ন ঘটনার অভিযোগ তাদের কাছে আসছে। তারা অভিযোগগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখছেন। মূলত আতঙ্ক সৃষ্টি করতেই এ ধরনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে এই দাবি বেশ কয়েক বছর ধরেই করে আসছে পুলিশ। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের এটি একটি নতুন ধারা কিংবা কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে জঙ্গিরা। গত কয়েক বছরে দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান বারবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। বিলুপ্ত জেএমবি নতুনরূপে আঘাত হানার চেষ্টা করছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বসে ষড়যন্ত্র করছে। এই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে সম্প্রতি ভারতের বর্ধমানে জেএমবি সদস্যরা আটক হলে। এরপরও কলকাতা থেকে ছয় বাংলাদেশি জেএমবি সদস্য আটক হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, এতদিন ধরে আল-কায়েদা অনুসারী বাংলাদেশি জঙ্গিরা এখন উদ্বুদ্ধ হচ্ছে আইএসের ঘটনায়। তাই তারা সিরিয়ায় গিয়ে আইএসের অনুসারী হওয়ার জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। দেশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে এদের কার্যক্রম। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিতে এদের দক্ষতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাই এদের হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিছুদিন পরপর দু-একটা জঙ্গির নাটকীয়ভাবে মরে যাওয়ার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। বরং এসব জঙ্গির উৎস খুঁজে নির্মূল করতে হবে সরকারকেই, আর এ ধরনের একটা কাজে জনগণের সহযোগিতা পেতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ