আগামী বিশ্বকাপটা বাংলাদেশেরই
মুস্তাফিজের বল খেলার কায়দা আজ অবধি বের করতে পারেনি তাবত ক্রিকেটবিশ্ব। এরই মধ্যে দৃশ্যপটে হাজির হলেন আরেক ‘বালক-বীর’ ১৯ বছর বয়সী মেহেদী হাসান মিরাজ। মিরাজকে তো ইতিমধ্যে ইংলিশ দর্শকরা নাম দিয়েছেন ‘মিস্টার সিক্স’। সদ্যসমাপ্ত বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড টেস্টে ম্যাচের ইনিংসপ্রতি ছয় উইকেট ছাড়া ‘ওয়ান্ডারবয়’ মিরাজ কথাই বলেননি। দুই ম্যাচে তিনি একাই নিয়েছেন ১৯ উইকেট! এই যখন অবস্থা, এই দলটিই যখন ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে বোলিংয়ে আগুন ঝরাবে, তখন প্রতিপক্ষের কী অবস্থা হতে পারে?
কল্পনা করুন দৃশ্যটা। প্রতিপক্ষ ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলংকা -যেই হোক, ওঁরা দুজন বল করতে এলে সেই ওয়ানডে ম্যাচে প্রতিপক্ষের ওভার দাঁড়াবে আসলে ৩০। কারণ এই দুজনের বোলিংয়ের ২০ ওভার কাটাছেড়া করে রেখে দিতে হবে। রান নেওয়ার চেষ্টা মানেই অকালে প্রাণ বিসর্জন। কে হায় খেলতে গিয়ে অকালে সাজঘরে ফেরে? তারওপর সাকিব-তাসকিনদের তোপ তো আছেই। সবকিছু ঠিকঠাক মতো চললে আসন্ন বিশ্বকাপটা আসলে বাংলাদেশময়ই হবে।
সদ্যসমাপ্ত ইংল্যান্ডের বাংলাদেশ সফরের কথাই ধরা যাক, এই পাঁচ ম্যাচের ফলাফল হতে পারতো বাংলাদেশ ৫, ইংল্যান্ড ০। অর্থাৎ ইংল্যান্ড কমপ্লিট হোয়াইটওয়াশ। কারণ ওয়ানডে ও টেস্টের পাঁচটি ম্যাচই 'ভেরি ক্লোজ' ম্যাচ হয়েছে। সেগুলোর প্রত্যেকটিই ঝুকে গিয়েছিল বাংলাদেশের দিকে। কিন্তু ভাগ্য বাংলাদেশের পক্ষে ছিল না। দীর্ঘদিন খেলার বাইরে থাকায় টাইগাররাও খেই হারিয়ে ফেলেছিল। এই সুযোগটিই বগলদাবা করে নিয়েছে ইংল্যান্ড। তারা ২-১ এ ওয়ানডে সিরিজ জিতেছে। সেই পথ ধরে টেস্ট ট্রফিটাও নিতে চেয়েছিল তারা, কিন্তু সেখানে আর ভাগ বসাতে দেয়নি টাইগাররা। বাঘ তো বারবার শিকারের সুযোগ হাতছাড়া করে না। নিয়মিত খেলার সুযোগ পেলে সামনের বিশ্বকাপটা যে নিজেদের করে নেবে টাইগাররা, এ কথা এখনই বলে দেওয়া যায়। ফলে ইংল্যান্ড-ওয়েলসে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্বকাপটাতেই রচনা হতে পারে টাইগারদের সবচেয়ে বড় সেই গৌরবগাঁথা।
ক্রিকেটের মধ্যে যত সংস্করণ রয়েছে, তার মধ্যে টেস্টকেই বলা হয় সবচে কুলীন সংস্করণ। বিষয়টা এ রকম যে, তোমরা আমজনতা ওয়ানডে খেল, টি-টোয়েন্টি খেল, যা খুশি তা-ই খেল; কিন্তু মিনিমাম স্ট্যাটাস বা আভিজাত্য ছাড়া টেস্ট খেলতে পারবে না। ওটা জমিদারি খেলা, রাজরাজরাদের খেলা। সেই হিসেবে এত দিন প্রজার অবস্থানেই ছিল বাংলাদেশ। ২০০০ সালের নভেম্বরে আসে কুলীন ক্লাব টেস্টে খেলার সুযোগ। সফরকারী ভারতের বিপক্ষে সেই টেস্ট খেলার মধ্য দিয়ে আসে মাহেন্দ্র ক্ষণটি। ৯ উইকেটের পরাজয় দিয়ে শুরু সেই যাত্রাটি শুভ হতে পারেনি। কিন্তু ১৬ বছর পর? দৃশ্যপট এখন ভিন্ন। বাংলাদেশ এখন কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। প্রতিটি ম্যাচ জয়ের লক্ষ্য নিয়ে খেলতে নামে তারা। প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়ে যায় শেষ বলটি পর্যন্ত। এই ভয়েই কি না, কে জানে, বাংলাদেশের সাথে টেস্ট খেলতে চায় না কোনো দল। এদিকে অনিয়মিত টেস্ট খেলে টাইগাররা নিজেদেরকে সেভাবে শানিতও করতে পারছে না। যার ফলে টেস্টে প্রথম জয়টি পেতে আমাদের পাঁচ বছর লেগে গিয়েছিল। জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে টেস্টের ৩৫তম ম্যাচে এসে ২০০৫ সালের ৬ জানুয়ারি এসেছিল সেই জয়। এরপর ওয়েস্টইন্ডিজকে হারায়। নিউজিল্যান্ড একটুর জন্য ফসকে যায়।
অনেকে বলে থাকেন, দশটি ওয়ানডে জেতার চেয়ে একটি টেস্ট জেতাও ঢের বেশি গৌরব আর আনন্দের। ইংলিশদের বিরুদ্ধে আরাধ্য সেই টেস্ট ম্যাচটায় শেষ পর্যন্ত জিতল টাইগাররা। জিতল তো জিতল; একেবারে দোর্দণ্ড প্রতাপ নিয়েই জিতল। টাইগাররা পরাক্রমশালী ইংলিশদের মাঠের লড়াইয়ের তিনটি পজিশনেই হারিয়ে দিল।
শুধু তাই নয়, টেস্টের শেষ ম্যাচে জিতে শেষ হাসিটি হেসে টাইগাররা বাংলাদেশের টেস্ট তথা ক্রিকেটকেই যেন এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেল। প্রতিটি খেলোয়াড়ের শেষ বল পর্যন্ত লড়াইয়ের এই যে ক্ষুধা, টেস্টের মতো একটি ধীরগতির খেলাকেও তারা চরম উপভোগ্য করে দিয়েছে। এক হিসেবে এটা বিশ্ব টেস্টক্রিকেটেরও লাভ। টেস্টের দর্শকখরা যখন নিয়মিত ব্যাপার, সেখানে মিরপুরে বাধভাঙা দর্শকঢেউ। কিন্তু আইসিসির নানা বৈষম্যের কারণে টাইগাররা সমানতালে পাল্লা দিয়ে সামনে যেতে পারছে না। মাঝেমধ্যেই শংকার সৃষ্টি হয় আইসিসির নানা রকম সংস্কারের প্রস্তাবে। বিশেষ করে মধ্যম সারির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের টেস্ট খেলার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে একবার প্রস্তাব তুলেছিল ক্রিকেট মোড়ল ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। তখন এ নিয়ে তুমুল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল।
এসব বাধা বিপত্তি পেরিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট যত দ্রুত এগোচ্ছে, এর পেছনে ষড়যন্ত্রকারীরাও ততটাই তৎপর। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচে বাজে আম্পায়ারিংয়ের শিকার হয়েছিল বাংলাদেশ। এ নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এ ছাড়া নিরাপত্তার অজুহাতে অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশে খেলতে না আসাসহ এর আগেও নানা অবিচারের শিকার হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। এমনকি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়িং রাউন্ডে বাংলাদেশকে খেলানো নিয়েও ছিল জোরালো প্রশ্ন। কিন্তু মনে রাখা দরকার ক্রিকেটের মোড়লরা যখন নানা কারণে সমালোচিত তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট জগতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে। বলা হয় বাংলাদেশ দলের দ্বাদশ খেলোয়াড় হচ্ছে ১৬ কোটি বাঙালি।
তারও পর ক্রিকেট যখন পণ্য, তখন এই আবেগেরও সঞ্চারও করেছে বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনাময় টাইগারবাহিনী। বাংলাদেশ শুধু ভালো খেলছেই না, বড় বড় টুর্নামেন্টের আয়োজন করেও আয়োজক হিসেবে সাফল্য দেখিয়েছে। আর বাংলাদেশের ক্রিকেটের দর্শকরা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের দর্শকের চেয়ে খেলাঅন্তপ্রাণ। ক্রিকেট বিশ্ব তাই বাংলাদেশকে উপেক্ষা করতে পারে না কিছুতেই।