সোজা কথা
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিং কি খুব জরুরি?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন, র্যাগিংয়ের নামে নাকি তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্যাতন করা হয়। এবং সেটা করেন সিনিয়র শিক্ষার্থীরা। এমন অভিযোগ বহুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল, ইদানীং তা আবারও নতুন করে শোনা যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও এসেছে এই র্যাগিং প্রসঙ্গে। সেসব অভিযোগ কী, তা আর বিস্তারিত বলব না, কারণ সেগুলো এখন সবারই জানা। অভিযোগকারীরা র্যাগারদের বিরুদ্ধে পেরে উঠতে পারে না, কারণ র্যাগিং করা সিনিয়র শিক্ষার্থীরা দাপুটে হয়ে থাকে—কখনো শুধু সিনিয়র বলে, আবার কখনো তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আদৌ কি এই র্যাগিং সংস্কৃতির প্রয়োজন আছে?
একটি ঘটনা বলি, এ বছরের জুন মাসে ঘটনাটি ঘটে, ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য কর্ণাটকের একটি নার্সিং ইনস্টিটিউটে। সেখানকার দুই সিনিয়র ছাত্র প্রথম বর্ষের নার্সিংয়ের এক ছাত্রীকে জোর করে ফিনাইল খাওয়ায়। মেয়েটির দাবি, ওই কলেজের আটজন সিনিয়র ছাত্র জোর করে তাঁকে ফিনাইল মুখে ঢেলে দিয়েছে। মেয়েটি দলিত সম্প্রদায়ের। ভারতে এই যুগেও জাতপাতের ব্যাপারগুলো আছে এবং তরুণ প্রজন্মও যে এই অন্ধকার থেকে বের হতে পারেনি, তার বড় প্রমাণ এই দলিত মেয়েটি। তাঁকে কলেজের ছেলেমেয়েরা কয়লা, ভয়ংকর দেখতে এ রকম নানা কথা বলে উত্ত্যক্ত করেছে, তাঁর পরিবার নিয়ে হাসিঠাট্টা করেছে। এমনকি তাঁকে জোর করে ফিনাইল খাওয়ানোর পরও কলেজের প্রিন্সিপাল দোষ দিয়েছে মেয়েটিকেই, পারিবারিক কারণে নাকি মেয়েটি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। মেয়েটির খাদ্যনালি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ তো গেল শারীরিক ক্ষতি, তাঁর মানসিক বিপর্যয়ের ক্ষতির হিসাব তো আর চোখে দেখা যায় না। বিষয়টি হয়তো কলেজ কর্তৃপক্ষ সিনিয়র-জুনিয়রের র্যাগিং বলে পার পেতে চেষ্টা করতেন; কিন্তু বিষয়টি জীবনহানিকরের দিকে রূপ নেওয়ায় সেটা আর হয়ে ওঠে না। সিনিয়র সেই ছাত্ররা আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য হয়।
ভারতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র্যাগিংয়ের ভয়াবহ পরিণতির সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটে আমান নামের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে, যাঁকে জীবন দিয়ে এর খেসারত দিতে হয়েছে। ১৯ বছরের আমান ভর্তি হয়েছিলেন হিমাচল প্রদেশের টানডা মেডিকেল কলেজে। কলেজের ছাত্রাবাসের কয়েকজন সিনিয়র ছাত্র তাঁকে নানাভাবে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করত। কিন্তু সেসব কথা মা-বাবাকে বলেননি। কিন্তু একদিন সেই ছাত্ররা তাঁকে প্রচণ্ড মারধর করে। এতে আমান মাথায় আঘাত পেয়ে মারা যান। মারা যাওয়ার আগে আমান সেই নির্যাতনের কথা তাঁর বাবাকে বলে যান। আমানের ঘরে কিছু চিরকুট পাওয়া যায়, যাতে র্যাগিং সম্পর্কে লেখা ছিল। আমানের মৃত্যুর পর তাঁর বাবা রাজেন্দ্র কাচুরি সামাজিক আন্দোলন শুরু করেন। গঠন করেন র্যাগিংবিরোধী হেল্পলাইন, যেখানে র্যাগিংয়ের শিকার হওয়া শিক্ষার্থীরা তাঁদের অভিযোগের কথা জানাতে পারেন। রাজেন্দ্র কাচুরির এ উদ্যোগের ফলে জানতে পারা গেছে, ভারতে কী পরিমাণ র্যাগিংয়ের শিকার হয় লাখো শিক্ষার্থী। অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, অনেকে শারীরিক-মানসিক এই চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেন। র্যাগিংয়ের এ ঘটনা নাকি বেশি ঘটে উপমহাদেশের ভারত ও শ্রীলঙ্কা এই দুই দেশে।
ষাটের দশক থেকে এই উপমহাদেশে র্যাগিংয়ের প্রচলন শুরু হয় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। প্রথম দিকে এটা নির্দোষ সিনিয়র-জুনিয়রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির প্রথম ধাপ হিসেবে দেখা হতো। পরে দিন দিন র্যাগিংয়ের মানে পাল্টে যেতে থাকে; বরং এটা সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা কিংবা ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর জন্য বিভীষিকার রূপ নেয়। র্যাগিং এ উপমহাদেশে আমদানি হয়েছিল ষাটের দশকে। আশির দশকে ভারত, শ্রীলঙ্কায় এটা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানেও এর প্রচলন বাড়তে থাকে নব্বইয়ের দশকে। ভারতের অনুকরণে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর প্রচলন দ্রুত বাড়তে থাকে। জাহাঙ্গীরনগরের মানিক বাহিনীর কথা যেমন শোনা যায়, তেমনি একসময় র্যাগিংয়ের ঘটনায় জড়িয়ে যায় দেশের মর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বুয়েটের নামও। আর এখন তো দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই নাকি র্যাগিংয়ের নামে নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
আমরা যদি আরো একটু পিছিয়ে যাই তাহলে দেখব, র্যাগিংয়ের শুরুটা ছিল নির্দোষ। গ্রিক সংস্কৃতিতে প্রথম এর প্রচলন শুরু হয় সপ্তম ও অষ্টম শতকে খেলার মাঠে টিম স্পিরিট বাড়াতে। কালের বিবর্তনে পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এটা ঢুকে যায়। অষ্টাদশ শতকে, বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলোতে এর প্রচলন বাড়ে। ১৮২৮ থেকে ১৮৪৫ সালের দিকে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর প্রসার ঘটে বিভিন্ন ছাত্রসংস্থার মাধ্যমে। আমাদের উপমহাদেশে ইংরেজরা এই অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটায়।
এই অপসংস্কৃতি সদ্য তারুণ্যে পা দেওয়া শিক্ষার্থীদের যে কতটা নির্যাতন করে, সেটা বুঝেও না বোঝার ভান করেন শিক্ষকরা। তাঁরা মূলত ভয় পান রাজনৈতিক পরিচয়ে চলা বেপরোয়া শিক্ষার্থীদের, যাদের কোনো কাজে বাধা দিলে তাঁদেরই বিপদে পড়তে হবে। এই যদি হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের অবস্থা, তাহলে শিক্ষার্থীরা কী অবস্থায় আছে, তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না।
শিক্ষাজীবনটা যেকোনো ছেলেমেয়ের জন্যই অনেক আনন্দের, অনেক স্বপ্নের একটা সময়। কিন্তু নিজের আনন্দ মেটাতে গিয়ে কাউকে যদি চরম মূল্য দিতে হয়, তাহলে মানুষ হিসেবে আমাদের অবস্থানটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটাও ভেবে দেখা উচিত। শুধু বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উজ্জ্বল করা যাবে না, মানুষের মতো মানুষ হয়ে নিজেকে অনুকরণীয় করে গড়ে তোলার অন্যতম জায়গাও কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা আশা করি, শিক্ষার্থীরা নিজেরাই তাঁদের ভুল বুঝতে পারবেন, নোংরা মানুষ হিসেবে নিজেকে জাহির করার মধ্যে কোনো ক্রেডিট নেই। ভয় দেখিয়ে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পাওয়া যায় না। আর শিক্ষাজীবনে ভালো-মন্দের ফারাকটা ধরতে না পারলে এই শিক্ষার আর কী মূল্য থাকল! তাই বলছি, র্যাগিং জিনিসটা না থাকলে কী এমন ক্ষতি?
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এনটিএন নিউজ।