মার্কিন নির্বাচন
সবচেয়ে ভয়ংকর নেতাকে বেছে নিল যুক্তরাষ্ট্র
জোনাথন ফ্রিডল্যান্ড ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান-এর একজন নিয়মিত কলামিস্ট ও লেখক। এ ছাড়া তিনি নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকস-এ নিয়মিত লেখালেখি করেন এবং বিবিসি রেডিও ফোর-এর কনটেম্পোরারি হিস্ট্রি সিরিজ উপস্থাপনা করেন। ২০১৪ সালে অরওয়েল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে তাঁর আটটি বই প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন নির্বাচন-পরবর্তী কলামটি তিনি লিখেছেন দ্য গার্ডিয়ানের মতামত পাতায়। কলামটির সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর করেছেন ফাহিম ইবনে সারওয়ার।
আমরা ভেবেছিলাম, অন্য রকম কিছু ঘটবে। জরিপগুলোও আমাদের সে ইঙ্গিত দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একজন ধর্মান্ধ, যৌন নিগ্রহকারী এবং মিথ্যাবাদীর হাতেই দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর অফিসের দায়িত্ব তুলে দিল মার্কিনরা। দুনিয়াজুড়ে মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন দেখেছেন, অপেক্ষা করেছেন ফলাফলের জন্য। প্রায় সবাই ভেবেছিলেন, ট্রাম্প অধ্যায়টি নির্বাচনের পরই কেটে যাবে। কিন্তু সেই ট্রাম্পই এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাস্তবতা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ, যারা কি না নিজেদের ‘পৃথিবীর শেষ ভরসাস্থল’ হিসেবে দাবি করে, যে জাতি সব সময় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছে, তারাই কি না বারাক ওবামার উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নিল ডোনাল্ড ট্রাম্পকে!
আজ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ববাসীর কাছে অনুপ্রেরণার উৎস নয়, বরং ভীতির উৎস। প্রথম নারী প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করার বদলে এমন একজনের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হলো, যিনি কি না পরিচিত তাঁর অজ্ঞতা, বর্ণবাদী ও নারীবিদ্বেষী মনোভাবের কারণে। যাঁরা তাঁকে ভালোমতো চেনেন, তাঁরা তাঁকে অভিহিত করেন ‘বিপজ্জনক’ ও ‘সামাজিক ব্যাধি’ হিসেবে।
তবে খুব শিগগির ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার ফল চোখের সামনে দেখতে পাবেন মার্কিনরা। ট্রাম্প যা বলেছিলেন তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার সময়, ধীরে ধীরে তার বাস্তবায়ন শুরু হবে। বৈধ কাগজপত্র নেই এমন অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করার ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। এর ফলে এক কোটি ১০ লাখ অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়তে হবে, যারা যুক্তরাষ্ট্রের জনশক্তির ৬ শতাংশ।
মুসলিমরা যুক্তরাষ্ট্রে আর ঢুকতে পারবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন ট্রাম্প। পরে অবশ্য কিছুটা নমনীয় হয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘যেসব মুসলিমপ্রধান দেশ সন্দেহের তালিকায় রয়েছে, সেসব দেশ থেকে কোনো মুসলিম যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবে না।’ যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে বড় একটি দেয়াল তুলে দেওয়া হবে। যেসব নারী গর্ভপাত করাতে চান, তাঁদের সাজা দেওয়া হবে এবং হিলারি ক্লিনটনকে জেলে পাঠানো হবে।
মানুষ হয়তো বলবে, এসবই ছিল কথার কথা। নির্বাচনী প্রচারণার অংশ। কিন্তু প্রচারণাজুড়েই ট্রাম্পশিবির এই ব্যাপারগুলোতেই জোর দিয়েছে। আর তার বিজয় বলে দিচ্ছে, বিপুল পরিমাণ মার্কিনের এতে সমর্থনও রয়েছে। যে অফিসে থমাস জেফারসন, আব্রাহাম লিঙ্কন, ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট ও জন এফ কেনেডি বসেছেন, এখন সেখানে বসবেন ট্রাম্প! তিনি যা খুশি তা-ই করতে পারেন।
প্রাথমিকভাবে ট্রাম্পের সময়কাল হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কঠিন পরীক্ষা। কিন্তু সারা বিশ্বেই এর প্রভাব পড়বে। একজন রিয়েলিটি শোর টিভি তারকা, যাঁর রাজনীতি বা সামরিক বিষয়ে বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা নেই, তাঁর হাতেই থাকবে পারমাণবিক বোমার চাবি। মনে করে দেখুন, ট্রাম্প সেই লোক, যিনি প্রায় সময়ই জিজ্ঞাসা করেছেন, পারমাণবিক বোমা থাকতেও কেন যুক্তরাষ্ট্র তা ব্যবহার করছে না? এই ট্রাম্পই বলেছিলেন, ‘আমি যুদ্ধ ভালোবাসি।’ আইএস জঙ্গিদের দমনে ট্রাম্পের বুদ্ধি ছিল, ‘বোমা মেরে সবাইকে উড়িয়ে দেওয়া’!
জোট নিরপেক্ষ জোট ন্যাম-এর ব্যাপারেও ট্রাম্পের মনোভাব খুব একটা ইতিবাচক নয়। একজন আক্রান্ত হলে সবাই মিলে হামলাকারীকে প্রতিহত করবে—এমন নীতিতে বিশ্বাস করেন না বলে নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন ট্রাম্প। তাঁর মতে, ন্যাটো হচ্ছে একটি মাফিয়া জোট, যেখানে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের মতো সামরিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর আশ্রয়ে সুবিধা নিচ্ছে। এই সুবিধা নিতে হলে দুর্বল দেশগুলোকে অবশ্যই অর্থ খরচ করতে হবে বলে মনে করেন ট্রাম্প।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মার্কিন নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর সময় থেকেই ট্রাম্পের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। তাঁর এই ইঙ্গিত বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। রুশ এই স্বৈরশাসক অবশ্যই বাল্টিক দেশগুলোতে আগ্রাসন চালিয়ে নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করবেন। এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পুতিনের এমন সাহসী পদক্ষেপের প্রশংসা করবেন।
চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-যুদ্ধ আসন্ন। নতুন নতুন শুল্ক আরোপ করা হবে, যা বিশ্ববাজারে প্রভাব ফেলবে। এবং এই বিশ্বের কী হবে? ট্রাম্প বিশ্বাস করেন, জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে চীনাদের তৈরি ধাপ্পাবাজি। কার্বন ডাইঅক্সাইডের নিঃসরণ কমাতে ট্রাম্প কিছুই করবেন না, কারণ তিনি জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বাসই করেন না।
এসব কিছুর পরও আরেকটি প্রেক্ষাপট আমাদের সামনে রয়েছে, যেটা বেশি ভয়ংকর। ট্রাম্পের বিজয় শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদীদের দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্রে। ৬৩ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ পুরুষ ও ৫২ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ নারী ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন।
ট্রাম্পের বিজয়ের জন্য কাকে দোষ দেবেন? তালিকাটি দীর্ঘ। রিপাবলিকান পার্টি থেকে গণমাধ্যম, পোলস্টারস থেকে ডাটা অ্যানালিস্টরা সবাই ট্রাম্পের বিজয়ে ভূমিকা রেখেছেন। এমনকি হিলারি ক্লিনটন নিজেও ট্রাম্পের বিজয়ের জন্য দায়ী। কিন্তু আজকের দিনে আর দোষ দিয়ে কী হবে? বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র এখন পরিচালিত হবে সবচেয়ে ভয়ংকর নেতার দ্বারা।