ক্রিকেট
কেমন করছেন কীর্তিমানদের সন্তানরা
বিখ্যাত বাবার সন্তান হওয়া একটু ঝক্কিরই বৈকি। বাবার কীর্তি বয়ে বেড়ানো সত্যিই কঠিন কাজ। তা উন্নত কিংবা অনুন্নত যে বিশ্বই হোক। আর কর্মজীবনে যে সরণি দিয়েই আপনি হাঁটতে চাইবেন সেখানে ছায়ার মতো আপনার সঙ্গে চলবে বাবার কীর্তি। কারণ, কীর্তিমান ব্যক্তিরা জনমানস থেকে বিস্মৃত হন না।
স্যার ডন ব্র্যাডম্যান নামক এক অসামান্য সফল ব্যক্তির কীর্তির বোঝা বইতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন জন ব্র্যাডম্যান নামের এক ভদ্রলোক! উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বংশপরিচয় ‘ব্র্যাডম্যান’ শব্দটা তাঁর কাছে এত ভারী ছিল যে তিনি বইতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত আইন মেনে নামের শেষ অংশটুকু ছেঁটে ফেললেন। ১৯৭২ সালে জন তাঁর নামের শেষে যোগ করলেন ব্র্যাডসেন! বাবা-ছেলের সম্পর্কেরও টানাপড়েন শুরু সেখান থেকে। সম্পর্ক উন্নয়নে ডনের এক বন্ধু রোহান রিভেট বড় একটা ভূমিকা নিলেন। পরে ফিরলেন তাঁর বংশপরিচয়ে। নামের শেষে আবার যোগ করলেন ব্র্যাডম্যান। ডনের মৃত্যুর পর এখনো ব্র্যাডম্যান পরিবারের পরম্পরা বয়ে বেড়াচ্ছেন জন। অ্যাডিলেডে হোল্ডেন স্ট্রিটের দুই নম্বর বাড়ি এখন তালাবন্ধ থাকলেও ওই বাড়ির মুখপাত্র জন। তবে ব্র্যাডম্যান বংশে আর কেউ ক্রিকেটে আসেননি। তার সবচেয়ে বড় কারণ, স্যার ডনের অবস্থান ক্রিকেটের মহাকাশে। বাকিরা বড় জোর সমতলে দাঁড়িয়ে সেটা দেখার চেষ্টা করতে পারতেন। সেই চেষ্টা না করাকে শ্রেয় মনে করলেন তাঁর বংশধররা!
স্যার ডনের পর যে নামটা ক্রিকেট মহাকাশে এখন সবচেয়ে বেশি জ্বলজ্বল করছে, সেই শচীন টেন্ডুলকারের বংশধর হিসেবে অর্জুন টেন্ডুলকার অবশ্য ব্যাট হাতে নিয়েছেন। অর্জুন অবশ্য ক্রিকেট নামক কুরুক্ষেত্রে নিজের ব্যাটটাকেই সেরা অস্ত্র মনে করছেন। বাবার রেখে যাওয়া পরিসংখ্যানকে তাঁর ব্যাটের চেয়ে ভারী মনে করছেন না। তবে তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে জ্যোতিষচর্চা এখনই না করা ভালো।
তবে অতীতের দিকে ঝুঁকে পড়লে অনেককে পাওয়া যাবে যারা বাবার নামের সামনে গিয়ে নুয়ে পড়েছেন। সেই তালিকা নেহাত ছোট নয়। বিখ্যাত সুনীল গাভাস্কারের ছেলে রোহান গাভাস্কার। তাঁকে অবশ্য শুধু গাভাস্কার শব্দটা নয়, নামের পুরোটা জুড়ে বয়ে বেড়াতে হয় বিখ্যাতদের কীর্তির ওজন। সানি তাঁর ছেলের নাম রেখেছিলেন নিজের তিন প্রিয় ব্যাটসম্যানের নামের অংশ নিয়ে। রোহান কানাইয়ের রোহান। এম এল জয়সীমার জয়। আর গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের বিশ্ব। সব মিলিয়ে রোহান জয়বিশ্ব গাভাস্কার। বিখ্যাত চতুষ্টয়ের নামের বোঝা বইতে পারেননি রোহান গাভাস্কার।
মুম্বাইয়ের আরেক বিখ্যাত বিজয় মাঞ্জেরেকারের ছেলে সঞ্জয় মাঞ্জেরেকার। নিজের একটা পরিচিতি তৈরি করতে পারলেও ব্যাটসম্যান হিসেবে বাবাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। বাঙালি ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম তারকা পংকজ রায়। তারকা ছাড়া কী? পঞ্চাশের দশকে ৪২টা টেস্ট খেলেছেন। গড় ৪২ দশমিক ১৭। কিন্তু তাঁর ছেলে প্রণব রায় বাবার মতো ভারতের ইনিংস ওপেন করেছেন বটে। কিন্তু দিন শেষে ক্যারিয়ার দুই টেস্টের। গড় ৩৫ দশমিক ৫০। পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষায় বাবার পথ ধরে ক্রিকেট নামক সাদা পতাকা উড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। পংকজ রায়ের ছেলে এই পরিচয়ের গণ্ডি পেরিয়ে যেতে পারেননি তিনি।
কেন পারেননি তা ক্রিকেট ইতিহাসবিদদের গবেষণার বিষয় হতেই পারে। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে কীর্তিমান বাবার কীর্তি ছাপিয়ে যেতে পারেন এমন কাউকে কি দূরবীণ দিয়েও দেশে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে? উত্তর আরো দূরে থাকুক। অনেকে বলবেন, সে রকম কীর্তিমান বাবাই বা কোথায় বাংলাদেশ ক্রিকেটে? বাংলাদেশ তো টেস্ট ক্রিকেটই খেলল বছর ষোল। একদম ঠিক। তবে এই দেশটার অভিষেক টেস্টেই এক ভদ্রলোক সেঞ্চুরি করেছিলেন। ১৪০ বছরের টেস্ট ইতিহাসে ওরকম নজির আছে আর মাত্র দুটো। অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ব্যানারম্যান। আর জিম্বাবুয়ের ডেভ হটন। বাংলাদেশের ক্রিকেট মহল থেকে সাংবাদিককুল তাঁকে কীর্তিমানের তালিকায় রাখেন বলে মনে হয় না। যদিও ক্রিকেট বিশ্ব তাঁকে নানা কারণে, ‘মিস্টার ইসলাম’ হিসেবে চেনে। কিছুটা সম্মান দেখায়। সম্ভ্রম করে। মেলবোর্নের বাসিন্দা হওয়ায় ক্রিকেট ভিক্টোরিয়া তাঁকে আবার বাড়তি একটু খাতির-যত্নও করে! কিডস থেকে টিনএজে পা রাখা মাহাদী ইসলাম নামের এক ক্রিকেটার সেটা আবার জানে। দেখে। আর সেটা দেখতে দেখতে নিজের মনের মধ্যে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন জাল বুনছে। ভিক্টোরিয়ার আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে সাউদার্ন পাইওনিয়র্স অনূর্ধ্ব-১৪ দলে জায়গাও করে নিয়েছে। জায়গাটা পাকা করেছে টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে। ব্যাট করে ওয়ানডাউনে। খেলেন মেলবোর্নের বারউইক ক্রিকেট ক্লাবে। এই ক্লাবের কোচ ভদ্রলোক আবার একসময় শেন ওয়ার্নের ক্লাব কোচ ছিলেন।
ইন্টারনেট ঘেঁটে মাহাদি ইসলাম নামটা দেখার পর ফোন করেছিলাম অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী এক সাবেক বাংলাদেশ ক্রিকেটারকে। জানতে চেয়েছিলাম ছেলেটাকে চেনেন কি না। ভদ্রলোকের উত্তর, ‘হ্যাঁ চিনি। বয়স তেরো। কিন্তু অনূর্ধ্ব-১৪ সাউদার্ন ক্রিকেট দলে খেলছে।’ ক্রিকেটার হিসেবে কেমন মনে হয়? চটজলদি উত্তর, বলা মুশকিল। এখনো বলার মতো অবস্থায় এসেছে বলে মনে হয় না। আর দেশটা অস্ট্রেলিয়া। এখানকার ক্রিকেট সভ্যতা, ক্রিকেট দর্শন বাংলাদেশের থেকে অনেক আলাদা। ক্রিকেটীয় এই সভ্যতায় বেড়ে উঠতে পারা একটা ভালো দিক। বাস্তবতার রুক্ষ জমিনে দাঁড়িয়ে লড়াই করার মানসিকতাটা তৈরি হয়ে যায়। আর অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দর্শন হচ্ছে হার না মানা। সুতরাং লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারলে কিছু একটা হলেও হতে পারে।’ কিন্তু সেটা কী? ব্যাগি গ্রিন মাথায় তোলা?
‘না। ক্যাপ যদি সত্যিই মাথায় ওঠে তাহলে সেটার রং সবুজ হোক। আমি তা চাই। আমি জানি ব্যাগি গ্রিন মানে ক্রিকেটীয় ঔদ্ধত্য। আগ্রাসন। হার না মানা। যার অর্থ জয়। ওর বেড়ে ওঠা হোক সেই ক্রিকেটীয় দর্শনে। কিন্তু ওর মাথায় যদি গ্রিন ক্যাপ ওঠে, সেটা হোক লাল-সবুজের প্রতীক।’ খুব উচ্চ লয়ে নয় তবে দৃঢ়তা মেশানো গলা ভেসে এলো মোবাইলের অন্য প্রান্ত থেকে।
অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট সভ্যতায় বেড়ে উঠতে থাকা মাহাদী ইসলামের জন্য শুভকামনা জানানো যেতে পারে পৃথিবীর এই গোলার্ধে বসে। কিন্তু মনে অজানা একটা খচখচানি থাকছে। সিনিয়র ইসলাম যে বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে অমোচনীয় কালি দিয়ে লেখা এক নাম। মাহাদী কী পারবে সেই নামের ভার বইতে?
পারলে সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন যে ভদ্রলোক, তিনি বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপে গ্রিন ক্যাপ পরে চেমসফোর্ডে টস করতে নেমেছিলেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের সঙ্গে। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করে গ্রিন ক্যাপ খুলে ব্যাট উঁচিয়ে দর্শকদের অভিনন্দনের জবাব দিয়েছিলেন। তিনি আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ইউটিউবে সিনিয়র ইসলামের অভিষেক টেস্টের ভিডিও দেখে জুনিয়র ইসলামের মধ্যে অন্যরকম অভিঘাত যে তৈরি হয়, সেটা তো বাংলাদেশে বসে আন্দাজ করা যায়।
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি।