স্বপ্নদ্বীপের পর কে?
কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আনন্দবাজারের বয়স ১০১ বছর। বিদগ্ধজন প্রফুল্ল কুমার সরকারের সম্পাদনায় ১৯২২ সালের ১৩ মার্চ সান্ধ্য দৈনিক (Eveninge) হিসেবে সংবাদপত্রটির যাত্রা শুরু করেছিল। ভারত ও বাংলাদেশের নানা ঘটনায় সংবাদপত্রটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। গত ১৮ আগস্ট আনন্দবাজরের অনলাইনে ঢু মারি। এদিনই আনন্দবজারের পোর্টাল স্ক্রলিং করতে করতে চোখের সামনে চলে আসে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং এ ছাত্রমৃত্যুও ঘটনাটি। উল্লেখ্য, র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে ৮ আগস্ট হোস্টেলের তিন তলা বারান্দা থেকে নিচে লাফ দিয়েছিলেন স্বপ্নদ্বীপ কুন্ডু নামের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী। যার মৃত্যু হয় ৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার ভোরে। পরে জানা যায়, আবাসিক হোস্টেলের তিন তলার একটি কক্ষে ১২০ মিনিট ধরে র্যাগিং দেওয়া হয়েছিল স্বপ্নদ্বীপ কুন্ডুকে।
১১৮ বছরের পুরাতন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, পুরো ভারতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অনেকেই দাবি করেন, ভারতের অগ্রসর চিন্তা ও প্রগতিপন্থী শিক্ষার্থীরা এখানে পড়াশোনা করে থাকেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকেও অনেক শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী স্বপ্নদ্বীপের মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গে রীতিমতো তোলপাড় চলছে। এ ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ১২ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনা করে এতে অন্তত তিনজন গ্রেফতারকৃত শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন স্বয়ং কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল। ঘটানায় সরব মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। চিত্রতারকা, এমনকি ভারতের ক্রিকেট কিংবদন্তী সৌরভ গাঙ্গুলিও। এদিকে এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূলের ছাত্র সংগঠন ও বামদের ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
স্বপ্নদ্বীপের মৃত্যু নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এখনও আলোড়ন চলছে। চলছে দফায় দফায় মিটিং, প্রতিবাদ, রাস্তা অবরোধ সাথে একে অপরকে দোষারোপ। শিক্ষক, সমাজতাত্ত্বিকরা এই ঘটনাকে বিশ্লেষণ করছেন নানা দিক থেকে, গভীরভাবে। দৈনিক আনন্দবাজারেই এ ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অনুরাধা রায়। তিনি খুব মজা করে লিখেছেন, প্রতিবাদ মিছিলও অনেক হচ্ছে, ঠিক কার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সেটা যদিও স্পষ্ট নয়। মিছিলের কেউ কোনো দিন র্যাগিং করেননি বা অন্য কোনো আধিপত্যবাদে মদত দেননি, এমনটি জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। অনুরাধা রায় আরও পরিষ্কার করে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যে ও ভারতের কেন্দ্রে যে আধিপত্যবাদ চলছে, তারই এক নিদারূপ ফল স্বপ্নদ্বীপের মৃত্যু।
প্রথমবর্ষের এই পড়ুয়ার মৃত্যুকে নানা নিন্দা চললেও এই ঘৃণ্য চর্চা যে সহসা বন্ধ হবে তা ভারতের কোনো সুধীজনই জোর গলায় বলছেন না। বরং তারা বারবার, আঙ্গুল তুলছেন আধিপত্যবাদী ক্ষমতাসীন বা বলবান একটি গোষ্ঠীর প্রতি যারা তাদের ক্ষমতা বা দাম্ভিক চরিত্র বজায় রাখতে এমন কাজ ক্রমাগতভাবে করে আসছেন। তাই নিপীড়নের শিকার হয়ে স্বপ্নদ্বীপের এই মৃত্যুই শেষ মৃত্যু কী না- তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। সাধারণত যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক ব্যবস্থা থাকে সেখানে র্যাগিং বা নিপীড়ন বেশি হতে দেখা যায়। কিন্তু যেখানে আবাসন ব্যবস্থা নেই সেখানে যে হয় না তা বলা যাবে না। যেমন; আমার কর্মস্থল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথায় ধরা যাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের এক সহকর্মী জানিয়েছিলেন, নতুন শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেওয়ার অনুষ্ঠানের নামে মফস্বল থেকে আসা এক নারী শিক্ষার্থীকে ৭০-৮০ জন শিক্ষার্থীর সামনে এক বড় ভাইকে প্রেম নিবেদন করতে বলা হয়েছিল! যাতে মেয়েটি ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। পরে যা দেন-দরবারে গড়ায়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অত্যন্ত কঠোর ভাষায় নোটিশ দিয়ে যেকোনো ধরনের র্যাগিং বন্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেয়।
বাংলাদেশ বা ভারত যেখানেই হোক না কেনো- নিশ্চিতভাবেই র্যাগিং বা নবীন নিপীড়ন এক ধরনের আধিপত্যবাদী, ক্ষমতা দেখানোর আয়োজন। বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ। যা নিপীড়নের শিক্ষার শিক্ষার্থীর মনে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যে চর্চা বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই দেশের শিক্ষা কাঠামোতেই বিদ্যমান। বিকৃত এই চর্চার অবসানে প্রয়োজন কঠোর আইনের প্রয়োগ ও সুস্থ শিক্ষা সংস্কৃতির প্রসার। সাথে সব ধরনের আধিপত্যের অবসান। যা নিশ্চিত করা না গেলে, আমাদের সামনে হাজির হতে পারে আরও একজন স্বপ্নদ্বীপ কুন্ডু। হতে পারে সেই শিক্ষার্থী যাদবপুরের অথবা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা