যেখানেই থাকুন সদানন্দে থাকুন, আস্থা রাখুন
আজ রোববার (১৯ নভেম্বর) আমার মতোন অনেকেরই প্রিয় মানুষ, শ্রদ্ধার মানুষ দাদার মহা প্রয়াণ দিবস, আমার প্রিয় স্বজন সঞ্জীবদা’র। আর সকলের কাছে যিনি তুখোড় সাংবাদিক, সংগীতশিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী নামে পরিচিত। আমাদের দেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী, গীতিকার, কবি ও সাংবাদিক, অকাল প্রয়াত পরম আপনজন সঞ্জীব চৌধুরী ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার মাকালকান্দি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর আমাদের ছেড়ে অচেনালোকে চলে যান সঞ্জীব চৌধুরী। প্রিয় সঞ্জীবদা’র স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। কেবল মননশীল সাংবাদিকতার পেশাগত সৃজনশীলতাতেই নয়, গায়ক, শিল্পী ও গীতিকবি হিসেবেও তরুণ প্রজন্মের জন্য আদর্শ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাঁর সৃষ্ট অজস্র গান এখনও নবীনদের অনুপ্রেরণা বলে মনে করেন এ প্রজন্মের অনেক সঙ্গীতশিল্পী। সেই প্রিয়জন সঞ্জীবদা আমার মতোন অনেকের জীবন যাপনে, স্মৃতির আকাশে ভীড় করে অনুভবের পাখিরা, শিহরণের পায়রাগুলো ডানা মেলে ওড়ে মনের মুক্ত আকাশে। কোনটা রেখে কোনটার কথা বলি, কোনটাকেই বা ধরি শব্দজালে!
আজ আর আপনার গানের মতো করে ‘হাতের উপর হাতের পরশ রবে না’ বটে দাদা কিন্তু আপনি তো মনের মনিকোঠায় আছেন। দাদা আপনার গান শুনি আর ভাবি কত কত অতীত কথা। ‘আমি রাগ করে চলে যাবো, খুঁজেও পাবে না’। রাগ–অনুরাগে জীবন্ত মানুষ ছিলেন এবং জমালয়ের ভয়হীন হয়েই বাঁচতে জানতেন সারাক্ষণ তিনি। তখনও দলছুটের সঞ্জীব চৌধুরী হয়ে ওঠেননি সংগীতশিল্পী। কিন্তু তাঁর বন্ধু বাপ্পা (মজুমদার) দা এলেই চারতলা আলাদা ‘মজলিসী’ আড্ডায় জমে উঠতো, সুরেও ভরপুর হতো মাঝে মাঝে। আপনার সঙ্গে কাটানো সুরে–সুরার সেই প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা আলোকিত সময়গুলোকে খুব মিস করি দাদা। আপনি দূর থেকে তা টের পান কি? আপনার স্মৃতি আকাশে মেঘ হয়ে ভাসলেই বলতে মন চায় কেবল, ‘ওই কান্না ভেজা আকাশ আমার ভালো লাগে ন’, মন ড্রাইভারের ‘গাড়ি চলে না, আর চলে না’।
সঞ্জীব চৌধুরী মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত (বাইলেটারেল সেরিব্রাল স্কিমিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে) কারণে ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর রাতে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান, ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দেখতে দেখতে তার চলে যাওয়ার ১৬ বছর হয়ে গেল।
সঞ্জীব চৌধুরী ছোটবেলায় হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। এরপর ঢাকার বকশী বাজার নবকুমার ইন্সটিটিউটে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯৭৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ১২তম স্থান অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও মেধা তালিকায় স্থান করে নেন তিনি। তার বাবা ননী গোপাল চৌধুরী এবং মা প্রভাষিণী দেবী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা সঞ্জীব চৌধুরী আশির দশকে সাংবাদিকতা শুরু করেন। সে সময়ই ‘শঙ্খচিল’ নামের দলে সঙ্গীতচর্চা শুরু হয় তাঁর। সাংবাদিকতার ক্যারিয়ারে তিনি বহু বছর ‘ভোরের কাগজে’র ফিচার বিভাগে দায়িত্বরত ছিলেন। সাংবাদিকতায় নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী। মূলত তাঁর হাত ধরেই দৈনিক পত্রিকায় ফিচার বিভাগ নিয়মিতভাবে চালু হয়। জীবদ্দশায় দৈনিক ভোরের কাগজ, দৈনিক আজকের কাগজ ও দৈনিক যায়যায়দিনে কর্মরত ছিলেন এই সাংবাদিক।
সঞ্জীব চৌধুরী ১৯৯৬ সালে সঙ্গীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে বর্তমানের শীর্ষস্থানীয় ব্যান্ড ‘দলছুট’ গঠন করেন। বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে দলছুট ব্যান্ড গড়ে অনেক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন সংগীতশিল্পী। ১৯৯৬ সালে দলছুট ব্যান্ড তাদের প্রথম অ্যালবাম ‘আহ’ প্রকাশ করে বেশ প্রশংসিত হয়। এরপর তাদের হৃদয়পুর, আকাশচুরি এবং জোছনাবিহার অ্যালবাম থেকে একাধিক গান জনপ্রিয়তা পায়।
পরবর্তীতে সঞ্জীব চৌধুরীর কথা ও বাপ্পার সঙ্গীতায়োজন দলটিকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। ধারাবাহিকসহ বেশ কয়েকটি নাটকেও অভিনয় করেছেন তিনি। লিখেছেন অনেক গল্প ও কবিতা। তাঁর সুর ও গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে আছে–বায়োস্কোপ, আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ, আমি তোমাকে বলে দিব, সাদা ময়লা রঙ্গিলা পালে আউলা বাতাস, চোখ, তখন ছিল ভীষণ অন্ধকার, আহ ইয়াসমিন, রিকশা ও কথা বলব না। তার গাওয়া বাউল শাহ আবদুল করিমের লেখা–গাড়ি চলে না এবং কোন মেস্তরি বানাইয়াছে নাও গান দুটিও বেশ প্রশংসিত।
দৈনিক ‘ভোরের কাগজ’-এর বাংলামোটর অফিসের দিনগুলোর কথা মনে আসে, আর স্মৃতিতে ভাসে তাদের কথা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) রিপোর্টার হিসেবে এবং ডেস্কে কখনো রিপোর্টার, কখনো সাব-এডিটর হিসেবে টানা প্রায় ছয় বছর সবসময়ই যাদেরকে পেয়েছি কৃর্তৃত্বমূলক নয়, সহযোগিমূলক সিনিয়র আপনজন হিসেবে। একে একে ভাসে হারিয়ে যাওয়া মুখগুলো, যেমন সঞ্জীবদা (চৌধুরী), টিপু ভাই (জহিরুল আহসান), তেমনই হাই ভাই (এ.টি.এম. আবদুল হাই), লতিফ ভাই (মফস্বল সম্পাদক লতিফ সিদ্দিকী), বেনজীর ভাই (ব্যবস্থাপনা সম্পাদক) সহ আরো অনেকের কথাই।
সে সময়কালে (১৯৯৩-৯৮) দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয়, প্রচারবহুল জাতীয় পত্রিকা দৈনিক ‘ভোরের কাগজে’র কাজের পরিবেশেটাই ছিল অসম্ভব প্রীতিময়, পারস্পরিক অকৃত্রিম সহযোগিতামূলক। অপার সহযোগিতা, সম্প্রীতির উদার স্নেহময় সেই সময়গুলো আমার স্মৃতিতে বড়ই আলোড়িত, আলোকিত, আজো দারুণ সজীব। আর তাই আমার জীবনের এক সোনালি অধ্যায়ের নাম দৈনিক ‘ভোরের কাগজ’ কর্মপর্ব। সেই পর্বে বাংলামোটরের ছোট বার্তাকক্ষে যাদের একান্ত সান্নিধ্য, সহযোগিতা, উপদেশ আমাকে নিরন্তর স্বপ্ন জুগিয়েছে, কাজের প্রতি আগ্রহ-উৎসাহকে বাড়িয়েছে তাদেরই অন্যতম একজন আপনি, সঞ্জীবদা। প্রিয় সঞ্জীবদা, আপনি যেখানেই থাকুন সদানন্দে থাকুন আর আস্থা রাখুন আমরাও আসছি কিন্তু ! আপনি তো একা থাকার লোক নন দাদা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা।