মালয়েশিয়ায় লকডাউন, সপরিবারে কেমন আছেন বাংলাদেশিরা
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে মালেয়েশিয়ায় ক্রমেই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। দেশটিতে গতকাল মঙ্গলবার করোনায় আক্রান্ত একজন মারা গেছেন। নতুন আক্রান্ত হয়েছেন ১৭০ জন। এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৬৩ জনের। মোট আক্রান্ত তিন হাজার ৯৬৩ জন। এ ভাইরাসের বিস্তার রোধে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পর্যটন নগরী মালয়েশিয়ায় লকডাউন চলছে। ১৮ মার্চ থেকে ৩১ মার্চের লকডাউনের সময়সীমা ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সর্বসাধারণের চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ আরোপের পাশাপাশি নেওয়া হয়েছে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। বিনা কারণে ঘর থেকে বের হলেই করা হচ্ছে জেল-জরিমানা। নিয়ম অমান্য করলে স্থানীয় ও প্রবাসীদের আটকও করছে মালয়েশিয়া পুলিশ।
বাংলাদেশি যাঁরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মালয়েশিয়ায় থাকেন, কেমন কাটছে তাঁদের লকডাউনের সময়টা। এসব ভালোলাগা, মন্দলাগার অভিজ্ঞতার কথা এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন তাঁরা।
কুয়ালালামপুরে একটি বহুজাতিক ‘তেল ও গ্যাস’ সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রকৌশলী প্রণয় কুমার চৌধুরী অংশু বলেন, “সারা পৃথিবীর মানুষ আজ ঘরে বন্দি। ফ্রন্ট লাইনাররা বাইরে মহাভয়ঙ্কর ভাইরাসটির মহাসংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টায়। আমাদের দিন কাটছে ঘরে, সবার মতো অধীর অপেক্ষায় কখন সুদিন ফিরবে। প্রবাসে, যে দেশে আছি, এখানেও লাখ লাখ স্বদেশি মানুষ টিকে থাকার চেষ্টায় জীবন সংগ্রামে রত। সমগ্র পৃথিবী সংক্রমণে। দ্রুততম সময়ে বিজ্ঞানীরা 'ভ্যাকসিন’ পেয়ে যাক, সর্বসাধারণের সুরক্ষায়, সহজলভ্য হোক। প্রার্থনা সর্বশক্তিমানের দরবারে। কল্যাণ হোক পৃথিবীর।”
প্রকৌশলী প্রণয় কুমার চৌধুরী অংশু আরো বলেন, 'বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে মালয়েশিয়ায়। আমরা মালয়েশিয়ার একটি শহর কাজাংয়ে থাকি। শহরটি কুয়ালামপুর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে এবং সেলাঙ্গর প্রদেশে অবস্থিত। বর্তমানে মালয়েশিয়াতে সর্বমোট করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩৪৮৩ জন। এর মধ্যে শুধু সেলাঙ্গর প্রদেশে পাওয়া গেছে ৮৯০ জন যা অন্য সব প্রদেশের চেয়ে বেশি।'
চলমান কড়াকড়ির আওতায় খাদ্য জ্বালানিসহ জরুরি কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব সরকারি, বেসরকারি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু সুপারমার্কেট, ব্যাংক, গ্যাস স্টেশন ও ওষুধের দোকান খোলা রাখার নির্দেশনা আছে। ফলে কাউকে অফিস, স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে যেতে হচ্ছে না। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পথ বন্ধে এবং এরই মধ্যে যারা আক্রান্ত তাদের শনাক্ত করতে এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মালয়েশিয়ার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ডা. লুবনা আলম বলেন, 'অফিস বন্ধ মানে এই না যে, আমরা ছুটিতে আছি, সবাই বাসা থেকে কাজ করছি। আমার যে অফিশিয়াল কাজ সেটা আমি বাসায় বসে অনলাইনে করছি। ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা তাদের নিজ নিজ হোস্টেলে অবস্থান করছে এবং ইউনিভার্সিটি কতৃপক্ষ তাদের বিনামূল্যে তিনবেলা খাবার সরবরাহ করছে। এতে ছাত্রছাত্রীদেরও কোথাও বের হতে হচ্ছে না। সত্যিকার অর্থে আমাদের এখানে কিছুই তেমন থেমে নেই, আমার সাড়ে চার বছরের ছোট একটা ছেলে আছে যে এখানে কেজি-টু-এ পড়ে। প্রতিদিন সকালে ওদের স্কুল টিচাররা হোয়াটস্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে সবাইকে কাজ দিচ্ছেন। আমরা বাসায় ছেলেকে সেগুলো করিয়ে ছবি বা ভিডিও আপলোড করে দিচ্ছি এবং টিচাররা তা দেখছেন।’
ডা. লুবনা আরো বলেন, ‘আমাদের কন্ডোমিনিয়াম কর্তৃপক্ষও করোনা মোকাবিলায় বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। কন্ডোমিনিয়ামের কমন ফ্যাসিলিটি যেমন সুইমিংপুল, বাচ্চাদের খেলার পার্ক, জিমনেসিয়াম এগুলো সব বন্ধ। বাসায় সব ধরনের জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি সব নির্দেশনা মেনে চলার। আলহামদুলিল্লাহ আমরা এখন পর্যন্ত সুস্থ। চিরচেনা মালয়েশিয়ার চারদিকে সুনসান নীরবতা। মাঝেমধ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, আর কোনোদিন দেশে ফেরা হবে কি না!’
প্রবাসী এই শিক্ষিকা আরো বলেন, 'আমরা মানসিকভাবে খুব দুশ্চিন্তায় আছি। বাংলাদেশের জন্য, আমাদের বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বজন যাঁরা বাংলাদেশে আছেন তাঁদের জন্য। সবসময় তাঁদের সুস্থতা কামনা করছি। বাংলাদেশের সবাইকে একটা অনুরোধই করতে চাই, আমরা প্রবাসীরা আপনাদের জন্য দেশে না ফেরার চেষ্টা করব, যত দিন না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়, দয়া করে আপনারা নিজেদের মাত্র কিছুদিনের জন্য লকডাউন করুন, আপনাদের পরিবার-পরিজন এবং প্রবাসীদের বাবা মা ভাইবোনদের জন্য। সর্বশক্তিমান আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে রক্ষা করেন, এই বিপদ থেকে দ্রুত মুক্তি দেন।’
মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ দুলাল বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়া থাকি। আমার একটা সন্তান এখানে প্রাইমারিতে পড়ে। এ লকডাউনের ফলে আমরা আজ ঘরে বন্দি। ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ। বাচ্চার স্কুল বন্ধ। মালয়েশিয়াতে আমরা যে এলাকায় থাকি, করোনাভাইরাসের জন্য রেড জোন এটা। পাশে কুয়ালালামপুর হাসপাতাল। সব মিলিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে। তবে করোনা প্রতিরোধে মালয়েশিয়া সরকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, তারা করোনা কন্ট্রোলে আনতে পারবে। প্রবাসে পরিবার নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। চিন্তা একটাই বাংলাদেশকে নিয়ে তারা একটু সচেতন হলে বাংলাদেশে করোনা প্রতিরোধ করতে পারবে। মালয়েশিয়ার মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আইনকে মান্য করে কেউ ঘর থেকে বের হয় না। বের হলে সঙ্গে সঙ্গে ধরে জেল-জরিমানা করে। মালয়েশিয়া নতুন সরকার ক্ষমতা আসার পর প্রবাসী ও স্থানীয় লোকজনের অনেক সুযোগ সুবিধা ঘোষণা করেছে। যা সত্যিই প্রশংসনীয়। রুম থেকে বের হইনি। একটি জিনিস উপলব্ধি করেছি ঘরে থাকলেই করোনা কখনো আক্রমণ করতে পারবে না। তাই বন্ধুবান্ধব সবাইকে বলব, ঘরে থাকুন, সুস্থ থাকুন। নামাজ পড়ে আল্লাহ কাছে ক্ষমা চান এবং দোয়া করুন।’
প্রবাসী বাংলাদেশি সঙ্গীতশিল্পী মোসাম্মৎ ইকরা সুলতানা ইতি বলেন, ‘লকডাউনের কারণে আজ অনেকদিন আমরা বাসায় অবস্থান করছি। আমার দুই সন্তান। মালয়েশিয়ায় করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তবে আলহাদুলিল্লাহ আমাদের কেলাংয়ে এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত কোনো ব্যাক্তি শনাক্ত হয়নি।’
মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি প্রকৌশলীর স্ত্রী ও সঙ্গীতশিল্পী ইতি বলেন, ‘স্বামী, সন্তানদের নিয়ে খুব ভালো আছি। আমার স্বামীর কর্মস্থল বন্ধ থাকলেও কোম্পানির পক্ষ থেকে বেতন পাচ্ছে। এখনো পর্যন্ত কোনো সংকটে পড়িনি। বাসায় অবসর সময়ে দুজনে গান করি। তবে এ লকডাউনে বাংলাদেশে বাবা-মাকে নিয়ে অনেক চিন্তা করি। পুরো পৃথিবী আজ লকডাউন। কবে যে উত্তরণ হবে একমাত্র আল্লাহপাক জানেন।’