প্রবাসের কথা
করুণা নয়, প্রাপ্য সম্মান চাই
ঘটনা এক
সিঙ্গাপুরের মসৃণ রাস্তা ধরে হাঁটছি। সময়টা তখন জানুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ দুপুর বেলা। সূর্যের প্রচণ্ড তাপে সারা শরীর যেন জ্বলে যাচ্ছে। গন্তব্য সামনের শিপ ইয়ার্ড। লি কুয়ানের দেশ সিঙ্গাপুরের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য সত্যিই দেখার মতো। ছোট্ট একটি দেশকে এত সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা এবং উন্নত করে গড়ে তোলাটা হয়তো বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই উদাহরণ হতে পারে। এসব কিছু ভাবছিলাম আর হাঁটছিলাম। এমন সময় হটাৎ করে দেখা হয়ে গেল কৃষ্ণকায় বর্ণের এক ভাইয়ের সঙ্গে। সারা শরীর তার ঘামে ভেজা। দরদর করে ঘাম ঝরছে, মনে হয় যেন এখনই গোসল করে বেড়িয়ে এসেছে। লোকটিকে দেখেই আমার কাছে বাংলাদেশি মনে হলো। তাই সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই কী বাংলাদেশি? প্রত্যুত্তরে তিনিও মিষ্টি হাঁসি দিয়ে বললেন, ‘জ্বী ভাই, আমি বাংলাদেশি।‘ এরপর একটু পানি চাইতেই তিনি নিয়ে গেলেন এক রেস্টুরেন্টে। এরপর শুধু পানিই নয়, পানির সঙ্গে 'টানি' হিসেবে পেট ভরে দুপুরের খাবারও খাওয়ালেন। অনেক জোরাজুরি করার পরও বিল দিতে দিলেন না।
এরপর অনেকটা জোর করেই তাকে তিন ডলার দিয়ে একটা পানীয় কিনে দিলাম। খেতে খেতে ভদ্র লোকের সঙ্গে অনেক কথা হলো। ভদ্র লোকের বাড়ি সিরাজগঞ্জে। এখানে একটি কন্সট্রাকশন ফার্মে লেবার হিসেবে কাজ করেন। সিঙ্গাপুরে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশি ভাইদের বিষয়ে অনেক তথ্য জানলাম তাঁর কাছ থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে দুঃখজনক যে কথাটি তিনি বললেন তা হলো, সিঙ্গাপুরে মূলত তিন ধরনের শ্রমিক কাজ করেন। চাইনিজ, মালয়েশিয়ান ও বাংলাদেশি। এর মধ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকরা সাধারণত সবচেয়ে বেশি পরিশ্রমের কাজগুলো করে থাকে, কিন্তু পারিশ্রমিকের বেলায় চাইনিজ আর মালয়েশিয়ানরাই এগিয়ে। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে এদের সঙ্গে বাংলাদেশি ভাইদের পারিশ্রমিকের তুলনাও চলে না। কিছুক্ষণ এসব আলাপ আলোচনা করে শেষমেশ বিদায় নিলাম। তিনি আবারও সিঙ্গাপুরে বেড়াতে আসার দাওয়াত দিয়ে হাঁসি মুখে বিদায় দিলেন।
ঘটনা দুই
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সাল।
মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মাদের মেয়ে ম্যারিনা মাহাথিরের আইপ্যাডসহ ব্যাগ হারিয়ে যায় একটি কাবাব রেস্তোরাঁয়। ঘটনাক্রমে ব্যাগটি পায় একজন বাংলাদেশি যুবক। ব্যাগটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ব্যাগে থাকা কার্ড বের করে কল দেন এবং ম্যারিনা মাহাথীরের ব্যক্তিগত সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপরের কাহিনীটা লাখ কোটি মালয়েশিয়ান তাদের জাতীয় মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছিল। এমনকি ম্যারিনা মাহাথিরও তাঁর ফেসবুকে সেই যুবক ভাইটির ছবি পোস্ট করে তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে ভুল করেননি। ম্যারিনার দেওয়া পোস্টে যুবক ভাইটির সঙ্গে দেখা করার আহ্বান ছিল, আর সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে যখন হাজারো মালয়েশিয়ান তার সঙ্গে দেখা করা শুরু করল, তখন বাধ্য হয়ে রেস্তোরাঁর মালিক তাঁকে অন্য শাখায় বদলি করেন।
কিন্তু এত কিছুর পরও কি এসব দেশের সাহেবরা এসব খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি খুশি? কখনোই না। বাংলাদেশিদের এরা ভিখারির চেয়ে কখনোই ভালো কিছু মনে করে না। অথচ এসব দেশের আকাশচুম্বী ভবনের প্রতিটি ইট সাক্ষী, এসবের ভিতরে লুকিয়ে আছে বাংলাদেশি প্রবাসীদের ঘাম। গরিব অসহায় এই মানুষগুলোকে ঠকিয়ে এ দেশের অনেকেই দামি গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ায়। বড় সাহেবরা যখন এদের ঠকানো টাকা দিয়ে অট্টালিকায় রাত যাপন করে, দেশ ছেড়ে পরিবার থেকে হাজার মাইল দূরে থাকা এসব অসহায় মানুষগুলো তখনো এ সাহেবদের কাজ করে ঘাম ঝরায়। অথচ এসবের বিনিময়ে এদের ভাগ্যে জোটে কেবলই অপমান আর লাঞ্ছনা।
এখানে উল্লেখিত ঘটনা দুটির মূলে থাকা যুবক ভাই দুজন প্রবাসে ছড়িয়ে থাকা লাখো বাংলাদেশির মধ্যে মাত্র দুজন। কিন্তু এরাই প্রকৃত বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী। এরাই সত্যিকারের বাংলাদেশ। বাংলাদেশিরা বীরের জাতি, এরা চোর কিংবা ভিখারির জাতি নয়। আমরা সম্পদের দিক দিয়ে হয়তো কিছুটা দুর্বল হতে পারি কিন্তু আমাদের আত্মসম্মান আছে। যার প্রমাণ আমারা নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু তৈরি করে সাড়া বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছি। আমরা পলায়নপর নয়, জীবন দেওয়া জাতি। ভাষার জন্য, দেশের জন্য রক্ত দিয়েছি আমরা। দেশকে ভালোবেসে হাসিমুখে আমরাই প্রাণ দিয়েছি ৫২'তে আর ৭১'এ। আর সেই আমাদেরই ভাইবোনেরা এভাবে অপমানিত হবেন, এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আকুল আবেদন থাকবে, দেশের অভিভাবক হিসেবে তিনি নিশ্চয়ই বিষয়টি ভাববেন। সেই সঙ্গে এই সমস্যা সমাধানে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোকে কীভাবে আরো কার্যকরী করা যায়, সেটিও নিশ্চয়ই দেখবেন বলে আশা রাখি।
পরিশেষে শুধু একটি কথাই বলব, আমরা কোনো করুণা নয়, প্রাপ্য সম্মান চাই।
লেখক : প্রবাসী ছাত্র, ইউনিভার্সিটি উতারা, মালয়েশিয়া।