স্বপ্নের মালয়েশিয়ায় দুঃস্বপ্নের প্রবাস জীবন
আমি একজন প্রবাসী, একজন বাঙালি, একজন বাংলাদেশি। তাই তাদের জন্য কিছু একটা করার আকুতি আমাকেও তাড়া করে। এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। সম্প্রতি অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ান পুলিশের গণগ্রেপ্তার ও কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে নির্যাতনের কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি। তবু যেহেতু বিষয়গুলো আমি নিজে থেকে কিছুটা হলেও প্রত্যক্ষ করেছি, তাই নিজের সেই অভিজ্ঞতার আলোকে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।
প্রথমেই বলে রাখি, মালয়েশিয়ায় থাকা বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভেতর একটা বড় অংশই হচ্ছে অবৈধ। এদের সঠিক কোনো তথ্য বা পরিসংখ্যান না আছে মালয়েশিয়ান ইমিগ্রেশন বিভাগের কাছে আর না আছে বাংলাদেশ সরকারের কাছে। অবৈধ এসব শ্রমিক বিভিন্নভাবে মালয়েশিয়ায় এসেছে। এই শ্রমিকদের বড় একটা অংশ এসেছে ট্যুরিস্ট ভিসা কিংবা স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও থেকে যাওয়ার কারণে একসময় এরাই অবৈধ হয়ে পড়ে। আবার কেউ কেউ তো কবিগুরুর সোনারতরীর মতো ছোট্ট তরীতে করে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এ দেশে এসেছে নিজের আর পরিবারের ভাগ্যবদলের স্বপ্ন নিয়ে। সোনারতরীর মতো তাদের তরীগুলোও থাকে পূর্ণ, তবে সে পূর্ণতা সোনার ধানে নয়, বরং সেই মানুষগুলোর ভেতর জমে থাকা একবুক স্বপ্ন আর অনিশ্চয়তার ভয়ে পূর্ণ। তাদের সেই গল্পটা যেন রূপকথার রাজ্যের রাজকন্যাকে উদ্ধারের চেয়েও অনেক বেশি ভয়ংকর। তবে ভয়ংকর এসব গল্পের পেছনে থাকে দালাল নামধারী একদল মানুষরূপী জানোয়ার। যাদের ফাঁদে পড়ে এসব নিরীহ বাংলাদেশি শেষ পর্যন্ত লাশ হয়ে হারিয়ে যায় সাগরের উত্তাল তরঙ্গে আর যারা শেষমেশ পৌঁছাতে পারে, তাদের ভাগ্যে জোটে মানবেতর এক প্রবাসজীবন। অবৈধ এই শ্রমিকদের বৈধ করার জন্য মালয়েশিয়ার সরকার এবার প্রায় পাঁচ মাসের মতো সুযোগ দেয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশের সব শ্রমিক এবারও বৈধ হতে পারেনি। এর পেছনে আমার কাছে বরাবরই মনে হয়েছে নিয়োগদাতা বাংলাদেশিদের উদাসীনতা, হাইকমিশনের স্বদিচ্ছার অভাব ও দালালদের প্রতারণাই এ জন্য দায়ী।
কেননা প্রথমত নিয়োগদাতারা এই শ্রমিকদের ‘সময় বাড়ানো হবে’, ‘চিন্তার কিছু নেই’ বলে বারবার ভুল বুঝিয়েছে। দ্বিতীয়ত অনেকেই দালালদেরকে পাসপোর্ট আর টাকা দিয়েছেন বৈধ হওয়ার আশায়, কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি দিয়ে দালাল পাসপোর্ট নিয়ে সরে পড়েছে। সবশেষে হাইকমিশনের গাফিলতির কথা না বললেই নয়। বিদেশে আমাদের একমাত্র আশা আর ভরসার শেষ স্থল যে হাইকমিশন, তার সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট হয়েছেন, এ রকম বাংলাদেশি খুঁজে পাওয়া দায়। নিজ চোখে যে হাইকমিশন আমি দেখেছি, তার বর্ণনা দিতে হয়তো আরেকটা লেখা তৈরি করতে হবে। তবে হাইকমিশন সম্পর্কে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে শুধু একটি কথাই বলব, বিদেশের মাটিতে আমাদের হাইকমিশনগুলো অনন্য (!) আবার মূল লেখায় ফিরে আসা যাক।
গত ৩০ জুন অবৈধ শ্রমিকদের ই-কার্ড নিবন্ধনের সময় শেষ হয়েছে। এরপর থেকেই শুরু হয়েছে ধরপাকড়। এক রাতেই ইমিগ্রেশন পুলিশ প্রায় ১৫০০ অবৈধ শ্রমিককে গ্রেপ্তার করেছে, যার বেশির ভাগই আবার বাংলাদেশি। মালয়েশিয়ান সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী অবৈধ শ্রমিকদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর আগ পর্যন্ত মালয়েশিয়া এই অভিযান অব্যাহত রাখবে। সরকারের এই ঘোষণায় বৈধ-অবৈধ সকল প্রবাসীর মধ্যেই একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকেই ভয়ে রাস্তায় নামছেন না, কেউ কেউ তো আবার গোপনে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছেন নিজেকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। এমতাবস্থায় ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের এ্যাম্বাসি নিজ দেশের নাগরিকদের বাঁচাতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ শুরু করেছে। এসব দেশ যখন নিজ দেশের নাগরিক বাঁচাতে কূটনীতিক লবিং শুরু করে দিয়েছে, তখন আমাদের বাংলাদেশ হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তা মিডিয়ার সামনে বললেন, ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছ থেকে বাংলাদেশি আটকের কোনো খবর তারা এখনো পাননি। পত্র পেলেই তারা আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেবেন।
তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এখন নিজের পকেটে থাকা ছোট্ট মোবাইলটি দিয়ে চাইলেই আমরা সারা বিশ্বের খবর জানতে পারি। অথচ একই শহরে থেকেও হাইকমিশনের কর্তাবাবুরা তাঁদের নিজ দেশের নাগরিক গ্রেপ্তারের খবরটুকূ জানতে পারলেন না। তবে সেটাও বেশ কয়েকদিনের পুরোনো খবর, এখনো কর্তাবাবুরা সেটি জানতে পেরেছেন কি না, আর জানলে তাঁরা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, সেটা আমার মতো সাধারণের অজানা। অবশ্য না জানতে পারার এই সংস্কৃতিটাও কিন্তু বেশ পুরোনো। কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে মালয়েশিয়ার বৈধ ভিসা ও রিটার্ন টিকেট নিয়ে যাওয়ার পরও যে বাংলাদেশিদের হয়রানি করা হয়, সেটা দেশি কিংবা প্রবাসী সবারই জানা আছে। বাংলাদেশিদের ইমিগ্রেশনের সেলে আটকে রাখা, এরপর তাদেরকে নির্যাতন করা, টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেওয়া ও রিটার্ন ফ্লাইটে দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে ভুরি ভুরি।
সম্প্রতি একটি জাতীয় পত্রিকা মারফত দেশ-বিদেশে ওয়াজ ও ধর্মীয় মাহফিল করা বক্তা মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহর সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা জানতে পারলাম। বৈধ ট্যুরিস্ট ভিসা, পর্যাপ্ত ডলার আর রিটার্ন টিকেট থাকার পরও তাঁর সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে তা দুঃখজনক। খুব অবাক লাগে এটা ভেবে যে, এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে আমাদের হাইকমিশন একেবারেই নীরব। তাঁরা যেন এখানে একজন নিরপেক্ষ রেফারি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাংলাদেশিদের যা কিছুই হোক না কেন, তাঁদের যেন মাস শেষে বেতন তোলা আর ফিতা কেটে উদ্বোধন ছাড়া অন্য কোনো দায়িত্বই নেই। তাই তাঁদের থেকে কিছু আশা করাটাই যেন বোকামি। জানি না, আমরা এর থেকে কবে পরিত্রাণ পাব আর আদৌ পাব কি না!
ঘড়ির কাঁটায় রাত এখন প্রায় ৪টা। পৃথিবীটা নিস্তব্ধ, গভীর ঘুমে নিমগ্ন সবাই। কিন্তু দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে থাকা কিছু প্রবাসীর চোখ এখনো জেগে আছে। সে চোখগুলোতে ঘুম নেই। আছে একরাশ আতঙ্ক আর সব হারানোর ভয়। একদিকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন আর অন্যদিকে জীবন সংগ্রামে হেরে যাওয়ার ভয়ে যাদের জীবন আজ দোদুল্যমান, সে জীবনে রাত কি সুখের নিদ্রা বয়ে আনতে পারে? আস্তে আস্তে রাত বাড়ছে, মাথার ওপর ঝুলে থাকা ঘড়ির কাঁটাটা ঠকঠক করে জানান দিচ্ছে নতুন দিনের সূর্যের আগমনীবার্তা। সূর্য উঠলেই দুনিয়াটা ভরে যাবে ঝলমলে আলোয়। কিন্তু সে আলো কি পারবে এই প্রবাসীদের জীবনের অন্ধকারকে দূর করে তাদের মুখের কোণে একটু খানি হাসির ঝলকানি এনে দিতে?
লেখাটা শেষ করতে চাই ছোট্ট একটি আবেদনের মধ্য দিয়ে। আমার এ আবেদন একজন মমতাময়ী মায়ের কাছে তাঁর সন্তানের আবেদন। জানি, সবাই নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পাড়লেও মা কখনোই সন্তানের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তাই সরাসরি নিবেদনটা আমাদের মাতৃতুল্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। কেননা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনিই আমাদের অভিভাবক। একমাত্র তিনিই পারেন তাঁর প্রবাসী সন্তানদের মুখের কোণে প্রত্যাশিত সেই হাসির ঝলকানি ফোটাতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আমি জানি না, আমার এই লেখা আপনার চোখে পড়বে কি না! তবে যদি কোনোদিন আমার লেখা আপনার দৃষ্টিগোচর হয়, তবে সবিনয় নিবেদন করব, হে মমতাময়ী মা! আপনার প্রবাসী সন্তানদের জন্য আপনি কিছু করুন। এরা তো আপনারই সন্তান। আপনি যদি এদের না দেখেন, তবে এই দুঃখী মানুষগুলোকে হয়তো সুদূর প্রবাসের জেলে পচে মরতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! ৫৬ হাজার বর্গমাইলের লাল-সবুজের বাংলাদেশ আমাদের অহংকার। যারা নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সুদূর প্রবাসেও প্রিয় বাংলাদেশকে করেছে কলঙ্কিত, তাদের বিরুদ্ধে আপনি এখনই ব্যবস্থা নিন। আমরা লাখো লাখো প্রবাসী আপনার পাশে আছি।
লেখক : প্রবাসী ছাত্র।