সৌদি প্রবাসী জোছনা হকের কবিতা ‘আমাদের মা’
আমাদের মা
রোগা টিংটিঙে দেহটা জাফর মামার।
কি অত্যাচারী লোকরে বাবা।
ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন আমাদের মা, বাবার পৈশাচিক অত্যাচার আর দ্বিতীয় বিয়ে করা আমার মা মেনে নিতে পারেননি।
আমি জন্মগ্রহণ করার পর মা অনেক চেষ্টা করেছে, ওই পাষণ্ড লোকটির ছায়া আশ্রয়ে
বাকি জীবন পার করিয়ে দিতে।
দিনের পর দিন বাবার অত্যাচার বেড়ে যায়।
আমার তিন বছরের বয়সের মাথায় আবার মায়ের কুলজুড়ে আসে আমার বোন ‘সুখী’
নানিমা খুব শখ করে আমাদের নাম রেখেছে, সাগর আর সুখী।
মূল নাম রহমান, আর রাবেয়া।
আদর করে সুখী আর সাগর বলে ডাকে।
বাবার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নানিমা মাকে নিয়ে আসে নানার বাড়িতে।
দুই মামা মা-কে মোটেও সহ্য করতে পারেন না।
বয়স তখন আমার পাঁচ।
স্কুলের পথ রোধ করে মামারা আমাকে কাজে লাগিয়ে দিতেন।
আমার সমবয়সী তাদের ছেলে মেয়েগুলো ঠিকই পড়াশুনা আর জমিদারের মতো চলতো।
নানার অগাধ সম্পত্তি।
মাও এই সম্পত্তির মালিক।
আমার আর আমার বোনের ওপর জুলুম দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে।
মা-তো আছেই মামিদের চাকরানি হয়ে।
নানিমার বয়স হয়েছে।
ওনার একমাত্র মেয়ের চিন্তায় মৃত্যু শয্যায় দিন গুনছেন।
আর ওনার ছেলেদের অমানবিক কার্যকলাপ দেখে গুমড়ে খাচ্ছে নানিমার ভেতরটা।
নানিমার প্রতি অবহেলা শুরু হয়ে গেল, দুই ছেলে আর দুই বউয়ের।
ক্রুশের চিহ্ন আঁকে তাদের মনে।
আমার মা, একটি ভুলের জন্য পৃথিবীর সব সুখ থেকে নিজেকে আলাদা করে দেয় তখন থেকে।
শুধু নানিমা আর আমাদের কথা ভাবে।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন মা।
মরণের আক্ষেপে কুঁকড়ে মরে মায়ের রোগা দেহটি।
বেঁচে থাকতে মায়ের ঘেন্না হতো।
শুধু একবুক স্নিগ্ধ মায়া আমার নানিমা আর আমরা দুই ভাই-বোনের জন্য, তাই এই মায়ার বাঁধন ছেড়ে মা কোথাও যেতে চান না।
বিছানার কোনায় নানিমাকে শুয়ে থাকতে দেখতাম।
হঠাৎ নাড়াচাড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মা নানিমার পাশে বসে খুব কাঁদতেন।
আমি স্কুলে ঠিক মতো যেতে পারতাম না।
একদিন আমার মাথায় এলো ফলমূলের অভাবে হয়তো নানিমার এমন অবস্থা।
আমি বাজারের একটা হোটেলের পেছনের কক্ষে কাজ নিলাম।
আমার কাজ ছিল বাসন ধোয়া। প্রথম কাজের টাকা দিয়ে নানিমার জন্য ফলমূল নিয়ে আসলাম।
মা তা দেখে ভ্রু কুচকে থাকিয়ে ছিলেন!
কিছু বলার আগেই আমার মামিরা আমাকে চোর বলে ধাক্কা মেরে ঘর থেকে বের করে দিলেন।
মা অপমানে একটা আধপোড়া কাঠ দিয়ে খুব মেরেছিলেন।
নানিমা এই ‘সুখে’ পরলোকগমন করেছিলেন।
মায়ের আপন বলতে আর কেউ রইল না।
আমি, মা, আমার বোন বাড়ি ছেড়ে বহুদূর চলে যায়, যেখানে মানুষ আমাদের চেনে না।
মা প্রথমে একটি স্কুলের চাকরি নেন।
তখনকার ম্যাট্রিক পাস করা মহিলা ছিল আমার মা।
সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মা-কে খুব আপন করে নিয়েছিলেন।
মায়ের দুঃসময়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন।
এখান থেকে আমাদের জীবনের শুরু আর সাথে ছিল আল্লাহ।
আমি এমবিএ পাস করে ব্যাংকে চাকরি নিলাম। ছোটবোন সুখী ভালো চাকরির আশায় বিয়েতে রাজি হচ্ছে না।
এর মধ্যে মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করেছি।
কিছুদিন যেতে না যেতেই বউ আমার মায়ের সাথে থাকবে না।
আলাদা ফ্ল্যাটে থাকবে।
আমি খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম, চোখের সামনে স্পষ্ট আমার নানিমার প্রতি অত্যাচার।
আমার মায়ের জীবন চিত্র।
আমি খুব চিন্তা করতে লাগলাম, এই মেয়েগুলোর সমস্যা কি?
আমার মা, আমার মায়ের কাছ থেকে আমাকে আলাদা করবে, দুই মাস আগে আসা মেয়েটি।
আমার স্বর্গ, আমার জান্নাতকে আলেদা করবে।
আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বামী, স্ত্রীর মায়া-মমতা সৃষ্টি হয়।
এই মমতায় মানুষ এক নীড়ে অনেক বছর পার করে দেয় ঠিক, কিন্তু আমার গর্ভধারিণী, আমার জন্য কী হতে পারে এর বর্ণণা এই সৃষ্টিকোলে দিতে পারব না।
মা-কে কিছু বুঝতে না দিয়ে বউকে বললাম, কাপড়-চোপড় গুছিয়ে নাও।
দেনমোহরসহ বউকে দিয়ে আসলাম তাঁর বাবার বাড়িতে।
আসার সময় বউয়ের মা-বাবাকে সব বললাম।
বউকে শেষ কথা বলে এলাম, তুমি এক মায়ের ছেলেকে আলাদা করতে চেয়েছ, যার অবদান আমার শিরা- উপশিরায়।
যে সময় তাঁর পাশে তাঁর ছেলেকে প্রয়োজন।
আমার মা, আমার ছোট মেয়ে।
আমাকে আমার মায়ের দায়িত্ব নিতে হবে। তোমার যখন সমস্যা, তুমি আমার জীবন থেকে চলে যেতে পারো, আমার মা আমার চোখের সামনে থাকবে, ঠিক মা, যেভাবে সন্তানদের আগলে রাখে।
এই বলে চলে এসেছিলাম সেদিন।
মাকে এসে সব বলেছিলাম, মা খুব কান্না করলেন।
মেয়েরা দুঃখেও কাঁদে, সুখেও কাঁদে বোঝা মুশকিল।
মা-কে কিছু বলতে না দিয়ে অফিসে চলে গিয়েছিলাম।