সেন্ট ভ্যালেনটাইনের আদর্শ কথা
নানা রকম কাহিনীর মধ্যে সেন্ট ভ্যালেনটাইনস ডের মাহাত্ম্য আজ নিঃশেষ হতে চলেছে। প্রচলিত ঘটনার বর্ণনায় বিকৃতি ঘটেছে। খ্রিস্ট ধর্মের বাতাবরণের প্রধান কাহিনীর পরিবর্তে নানা আজগুবি ঘটনা জায়গাজুড়ে বসেছে। রোমান সাম্রাজ্যের সেই খ্রিস্টান ধর্মযাজক বা সন্তের আত্মোৎসর্গের কাহিনী অনুসারে বিশ্বজুড়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি সেন্ট ভ্যালেনটাইনস ডে উদযাপিত হলেও ভ্যালেনটাইনের ধর্মভাবনা ও শিক্ষা সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানি না।
ভ্যালেনটাইন ছিলেন পাদরি এবং একই সঙ্গে চিকিৎসক। তখন খ্রিস্টীয় বর্ষের সাড়ে দ্বিশতক অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু দেব-দেবীর পূজা রোমানদের ধর্মীয় জীবন থেকে অপসৃত হয়নি। অবশ্য খ্রিস্ট ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল সে সময়। খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের অভিযোগে ২৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াসের আদেশে ভ্যালেনটাইনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কথিত আছে তিনি যখন জেলে বন্দি ছিলেন তখন শিশু-কিশোররা তাঁকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে জেলের জানালা দিয়ে চিঠি ছুড়ে দিত। বন্দি অবস্থায় চিকিৎসা করে জেলারের অন্ধ মেয়ের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন সেন্ট ভ্যালেনটাইন। মেয়েটির সঙ্গে তার আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মৃত্যুর আগে মেয়েটিকে লেখা এক চিঠিতে তিনি জানান, ‘ফ্রম ইওর ভ্যালেনটাইন’। তাঁর মৃত্যুর পর খ্রিস্ট ধর্মের প্রসার ঘটে।
রোমান সম্রাটরা সেই ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে ভ্যাটিকান সিটিতে ক্যাথলিক খ্রিস্ট সম্প্রদায়ের প্রধান নেতা পোপের সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। বলা হয়ে থাকে সেন্ট ভ্যালেনটাইনের নাম অনুসারেই পোপ প্রথম জুলিয়াস ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে সেন্ট ভ্যালেনটাইনস ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। ইন্টারনেট ঘাটলে ইতিহাসে আরো একজন ভ্যালেনটাইনের নাম পাওয়া যায়। যুবকদের বিয়ে করতে রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস নিষেধ করেছিলেন কারণ যুদ্ধের জন্য ভালো সৈন্য সংগ্রহ করা দরকার। কিন্তু এই ভ্যালেনটাইন নিয়ম ভেঙে প্রেম ও বিয়ে করেন। ফলে তার মৃত্যুদণ্ড হয়। কিন্তু এই কাহিনীর ভিত্তি দুর্বল। বরং সেন্ট ভ্যালেনটাইনের মানবপ্রেম ও ঔদার্যের ইতিহাসটিই মহিমান্বিত। ইন্টারনেট ভিত্তিক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত এবং বই-পুস্তক ঘেটে সন্ত ভ্যালেনটাইনের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আমরা যা জেনেছি তা এখানে উপস্থাপন করা হলো।
সাধু ভালেনটাইন ধার্মিক ছিলেন। তাঁর ধৈর্য ও সহনশীলতা আজকে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। কারণ “অহিংস” উপায়ে অধার্মিকতা ও অন্যায়-অবিচারের নিরসন সম্ভব। খ্রিস্টীয় শিক্ষা হচ্ছে মন্দতাকে উত্তমতা দিয়ে পরাজিত করা। এ উপায়ে একটি সমাজের পরিবর্তন খুব ত্বরান্বিত হয়। ব্যক্তি যদি এক এক করে ভালো হতে থাকে, প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা বাদ দিতে পারে, আর সমাজে আদর্শ সৃষ্টি করতে পারে, মন্দ ও দুষ্টরা দ্রুত পরিবর্তিত হবে। দুষ্টরা অধার্মিক কাজ করতে নিরুৎসাহিত হবে, আর অন্যায় করার সাহস পাবে না। অধার্মিক যতই শক্তিশালী হোক না কেন, ধার্মিকতা ও ন্যায়বিচারকে ভয় পায়। সমাজের অশান্তি ও অন্যায় সবকিছু ঈশ্বর দেখছেন। তিনিই আসল ও সর্বশেষ বিচারক। আমরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করি, অথচ তাঁর শিক্ষা পালন করব না, তা হতে পারে না। তাঁর বাক্যের প্রতি বাধ্যতাই তাঁর প্রতি আমাদের বিশ্বাসের প্রকাশ।
ভ্যালেনটাইন দিবসের শিক্ষা হচ্ছে অন্যায় ও অত্যাচার বন্ধ করার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্র যিশুর আদর্শ থেকে শিক্ষা ও পদক্ষেপ নিবে। যিশুর কয়েকটি শিক্ষাকে একসঙ্গে দেখে ব্যবহার করতে হবে। যেমন- ক্ষমা করা, দুষ্টের জন্য বা শত্রুর জন্য প্রার্থনা করা, মন্দকে উত্তমতা দেখানো, প্রতিশোধ না নেওয়ার মতো শিক্ষাগুলোকে একসঙ্গে নিতে হবে। যেমন, আমরা ক্ষমা করলে, প্রতিশোধ নিতে পারি না। কারো জন্য প্রার্থনা করলে তার অমঙ্গল চাইতে পারি না। বিনম্রতা দেখালে সহিংস হতে পারি না। কাউকে প্রেম করলে ঘৃণা করতে পারি না। রাষ্ট্র ও সমাজের অন্যায়-অত্যাচার এবং জোর-জুলুমকে মোকাবিলায় যিশুর আদর্শ অনুযায়ী করণীয় ঠিক করতে হবে। যিশু খ্রিস্ট কি আদর্শ দেখিয়েছেন? তিনি তাঁর প্রতি করা অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিনম্রতা দেখিয়েছেন ও প্রতিরোধ করেননি বা প্রতিবাদ করেননি। পবিত্র বাইবেলের পুরাতন নিয়ম যিশাইয় ৫৩ : ৭-৯ পদে রয়েছে, “তিনি উপদ্রুত হলেন, তবু দুঃখভোগ স্বীকার করলেন, তিনি মুখ খুললেন না; মেষশাবক যেমন হত হওয়ার জন্য নীত হয়, মেষী যেমন লোমচ্ছেদকের সম্মুখে নীরব হয়, সেরূপ তিনি মুখ খুললেন না। তিনি উপদ্রব ও বিচার দ্বারা অপনীত হলেন, তৎকালীয়দের মধ্যে কে এ আলোচনা করল যে, তিনি জীবিতদের দেশ হতে উচ্ছিন্ন হলেন? আমার জাতির অধর্ম প্রযুক্তই তাঁর ওপরে আঘাত পড়ল। আর লোকে দুষ্টগণের সঙ্গে তাঁর কবর নিরূপণ করল এবং মৃত্যুতে তিনি ধনবানের সঙ্গী হলেন, যদিও তিনি দৌরাত্ম্য করেননি, আর তাঁর মুখে ছল ছিল না।”
ভ্যালেনটাইনের আত্মত্যাগ আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে আমরা প্রতিশোধ নেব না। ‘তোমরা দুষ্টের প্রতিরোধ করো না।’ এ দ্বারা যিশু প্রতিশোধ না নিতে বলেছেন। কারণ প্রতিশোধ নেওয়া ঈশ্বরেরই কাজ। কোনো উপদ্রুত ব্যক্তি নিজে প্রতিশোধ না নিয়ে ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দিলে ঈশ্বর তাঁর সময়ে ও উপযুক্ত ভাবে বিচার করেন। কেননা তিনি ন্যায্য বিচারক। মানুষের আদালত ঈশ্বর-নিরূপিত আদালত। এতে আস্থা রাখতে হবে। তবে মানুষের আদালতে বিচারে ভুল ও অন্যায় থাকলেও ঈশ্বরের বিচারে কোনো ভুল নেই। পবিত্র বাইবেলের নতুন নিয়ম রোমীয় ১২: ১৭-২১ অংশে রয়েছে, “মন্দের পরিশোধে কারো মন্দ করো না; সব মানুষের দৃষ্টিতে যা উত্তম, ভেবে চিন্তে তাই করো। যদি সাধ্য হয়, তোমাদের যত দূর হাত থাকে, মানুষ মাত্রের সঙ্গে শান্তিতে থাক। হে প্রিয়রা, তোমরা নিজেরা প্রতিশোধ নিও না, বরং ক্রোধের জন্য স্থান ছেড়ে দাও, কারণ লেখা আছে, ‘প্রতিশোধ নেওয়া আমারই কাজ, আমিই প্রতিফল দেব, এ প্রভু বলেন।’ বরং ‘তোমার শত্রু যদি ক্ষুধিত হয়, তাকে ভোজন করাও; যদি সে পিপাসিত হয়, তাকে পান করাও; কেননা তা করলে তুমি তার মস্তকে জ্বলন্ত অংগারের রাশি করে রাখবে।’ তুমি মন্দের দ্বারা পরাজিত হবে না, কিন্তু উত্তমের দ্বারা মন্দকে পরাজয় করো।”
উপদ্রবকারীদের শাস্তি হবে। তারা পার পাবে না। উপদ্রুত ব্যক্তিও চান তাদের শাস্তি হোক। তবে সে শাস্তি দেওয়ার জন্য নিজে দায়িত্ব না নিয়ে বা প্রতিশোধ না নিয়ে যিনি সর্বশ্রেষ্ট বিচারক, তাঁর ওপরে নির্ভর করতে হবে। মনে রাখা দরকার যে, ঈশ্বরের হাতে বিচার মানুষের আদালতের বিচারের চেয়ে বড় ও কঠিন। কেননা তাঁর ন্যায়বিচারের মানদণ্ড মানুষের মানদণ্ডের চেয়ে ভারী।
সন্ত ভ্যালেনটাইন বিশ্বাস করতেন, যেহেতু রাষ্ট্র ও সমাজের সব কর্তৃত্ব ঈশ্বর থেকে আসে এবং আমরা সামাজিক মানুষ; তাই পৃথিবীর আদালতে বিচার চাইতে পারি, তবে ঈশ্বরের মুখাপেক্ষী ক্ষমাশীল ব্যক্তিকে ঈশ্বর পছন্দ করেন ও সাহায্য করেন। উপদ্রবকারী ও মন্দ ব্যক্তিকে ক্ষমাও করতে হবে, তার পরিবর্তন ও অনুতাপের জন্য প্রার্থনা করা দরকার। আমরা উত্তমতা দিয়ে মন্দতাকে পরাজিত করব। মন্দের বদলে মন্দ ফিরিয়ে দেব না। আমাদের মধ্যে মেষের স্বভাব থাকতে হবে, যা কোনো প্রতিবাদ করে না, মুখ খুলে না; কিন্তু বিনম্রভাবে সবকিছু সহ্য করে। মানবীয় যুক্তি দিয়ে যিশুর শিক্ষাকে নেব না, এতে আমাদের মানবীয় যুক্তি যিশুর শিক্ষার সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বে। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে, অন্যায়, জুলুম ও অবিচারে পূর্ণ আমাদের সমাজের পরিবর্তন এ শিক্ষা দিয়েই সম্ভব। আমাদের উচিত যিশু খ্রিস্টের শিক্ষাকে আমাদের সমাজে প্রয়োগ করে এর কার্যকারিতা সৃষ্টি করতে সুযোগ করে দেওয়া।
রাষ্ট্র ও সমাজের অবনতির জন্য অন্য কেউ বা কোনো গোষ্ঠীকে দায়ী না করে, নিজেকে দায়ী করার সাহস থাকতে হবে যা ছিল সন্ত ভ্যালেনটাইনের। নিজে সৎ ও নীতিবান ছিলেন। এজন্য অন্যকে দায়ী করে নিজের দায়িত্বকে উপেক্ষা করেননি কখনো। নৈতিকতা-সম্পন্ন সমাজ গঠনে ব্যক্তির দায়-দায়িত্বকে আমরা এড়িয়ে চলতে পারি না। প্রতিরোধ না করে সহ্য করার পদক্ষেপ প্রথমে আমাকেই নিতে হবে। ভ্যালেনটাইনের শিক্ষা ছিল প্রেম দিয়ে মানুষের হিংসাকে জয় করার শিক্ষা। মানুষ অহংকারের কারণে কোনো আঘাত সহ্য করতে পারে না। আঘাতপ্রাপ্ত হলে মনে করে সে অপমানিত ও ছোট হয়েছে। কিন্তু বিনম্র ও প্রতিরোধ-বিমুখ ব্যক্তিরাই সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। দুষ্টু ও সবল লোক যদি ধার্মিক ও দুর্বলের ওপর অত্যাচার ও চাপ প্রয়োগ করে, তাহলে প্রতিরোধ না করে সহ্য করা সন্ত ভ্যালেনটাইনের শিক্ষা। কেননা দুষ্টুরা সাময়িক ও তাদের উন্নতি ক্ষণস্থায়ী। সেজন্য ধৈর্য দেখাতে হবে জীবনে। সেই ধৈর্যই ভ্যালেনটাইনকে অমরত্ব এনে দিয়েছে। তিনি আজ ‘ভালোবাসা দিবসে’র মতো সর্বজনীন উৎসবের প্রতিভূ হয়ে উঠেছেন।
লেখক : অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়