সাওম একটি অনন্য ইবাদত
সাওম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে গোটা মানবজাতির জন্য এক বিশেষ রহমত। ইসলামে এটি একটি অনন্য ইবাদত হিসেবে স্বীকৃত। কেননা হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবু উমামা (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর রাসুলের কাছে এসে জিজ্ঞেস করি, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে এমন একটি আমলের আদেশ করেন যা দ্বারা আল্লাহ আমাকে উপকৃত করবেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তুমি সাওম রাখো। তার সমতুল্য কিছু নেই। (নাসাঈ)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোনো ইবাদতের প্রতিদান নিজ হাতে না দিলেও সাওমের প্রতিদান নিজ হাতে দেবেন বলে হাদিস কুদসিতে উল্লেখ রয়েছে। যেমন- বোখারি ও মুসলিম শরিফে এসেছে, হজরত আবু হোরায়রা (রা.) প্রিয় নবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি (রাসুলুল্লাহ) বলেন, আদম সন্তানের প্রতিটি নেক কাজের জন্য দশ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত সাওয়াব রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, কিন্তু সাওম এর ব্যতিক্রম। কেননা সাওম শুধু আমারই জন্য, আর আমিই এর প্রতিদান দেব। সে আমার জন্য তার যৌন বাসনা ও পানাহার ত্যাগ করেছে। ‘সাওম’ পালনকারীর জন্য রয়েছে দুটি আনন্দঘন মুহূর্ত। একটি হচ্ছে ইফতারের সময় এবং অপরটি তার রবের সঙ্গে সাক্ষাৎ বা দিদার লাভের সময়। সুমহান আল্লাহর নিকট সাওম পালনকারীর মুখের গন্ধ মেশক আম্বরের সুঘ্রাণের চেয়েও উত্তম।
এখানে সাওমকে বিশেষভাবে খাস করার কারণ হলো, অন্য যে কোনো ইবাদতে রিয়া তথা লোক দেখানোর সম্ভাবনা থাকলেও সাওমের মধ্যে তা অনুপস্থিত। তাই তো সাওম পালনকারীর অতীতের সব ছোট অপরাধ মাফ করে দেওয়া হয়। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন-যে ব্যক্তি ইমানের সাথে ও সাওয়াবের আশায় রমজান মাসের ‘সাওম’ পালন করে, তার পূর্বের সমুদয় গুহান (সগিরা) মাফ হবে। (বোখারি ও মুসলিম)। তবে তাওবা করলে আল্লাহ তায়ালা কবিরা (বড় গুনাহ) গুনাহও ক্ষমা করে দেবেন।
সাওম পালনকারীদের জন্য জান্নাতের গেটে আলাদা নেমপ্লেট লাগানো থাকবে। তাতে লেখা থাকবে, বাবুর রাইইয়ান। হজরত সাহল বিল সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন- জান্নাতে ‘রাইইয়ান’ নামক একটি দরজা থাকবে। কিয়ামতের দিন সাওম পালনকারীরা সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। তারা ব্যতীত অন্য কেউ সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। যখন তারা প্রবেশ করবে, সাথে সাথে তা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আর কেউ তা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।
সাওম ও আল কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। সাওম বলবে, হে আমার রব! আমি তাকে খাদ্য গ্রহণ ও যৌন বাসনা থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল করো। আল কুরআন বলবে, হে (পরওয়ার দিগার) আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুম হতে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করো। তখন উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে। (মিশকাত ১৮৬৬)। হযরত আবুল আলিয়া (রা.) বলেন, ‘সাওম পালনকারী ইবাদতের মধ্যে থাকে, যতক্ষণ সে গিবত না করে যদিও সে তার বিছানায় ঘুমিয়ে থাকে।’
হাফছা বিনতে সিরিন বলেন, ‘কী আনন্দ! ইবাদত হচ্ছে অথবা আমি আমার বিছানায় ঘুমিয়ে আছি (কারণ, সে তখন সাওম পালনকারিণী)।’ তাই তো বলা যায় সাওমের তুলনা সাওমই, অন্য কোনো ইবাদত নয়।
সাওমের দুটি উপকারিতার কথা না বললেই নয়। আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে সমস্ত সৃষ্টির সেরা বানিয়েছেন। তাকে বুদ্ধিও দিয়েছেন আবার প্রবৃত্তির তাড়নাও দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে মানবজাতি দুটি ক্ষুধার সম্মুখীন হয়। তার একটি হলো দৈহিক ক্ষুধা অন্যটি হলো যৈবিক ক্ষুধা। এই দুটি ক্ষুধাই সাওম পালনের মধ্য দিয়ে পূর্ণ হয়। যেমন- আল্লাহতায়ালা সুরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ, তোমাদের ওপর সাওম ফরজ করে দেওয়া হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববতী নবীদের অনুসারীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।’ এই আয়াতে সাওমের মৌলিক হিকমত হলো, ইমানদারদের মুত্তাকি বানানো। আর মুত্তাকি হলে তার রিজিকের কোনো চিন্তা করা লাগে না। যেমন পবিত্র কুরআনের সুরা আত-তালাক-এর ৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে। অর্থ : ‘যে ব্যক্তিই আল্লাহকে ভয় (তাকওয়া) করে চলবে, আল্লাহ তার জন্য কঠিন অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সৃষ্টি করে দেবেন এবং এমন পন্থায় তাকে রিজিক দেবেন যা সে কল্পনাও করতে পারে না।’ এতে স্পষ্ট হলো যে সাওম বান্দাকে মুত্তাকি বানিয়ে দেয়, সেই সাওম তার দৈহিক চাহিদা পূরণের জন্য রিজিকের ব্যবস্থাও করে দেয়।
অন্যদিকে যৈবিক ক্ষুধা নিবারণের বিষয়টি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। রাসুল (সা.) বলেন, হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে সে যেন বিয়ে করে। কেননা, এটা দৃষ্টিকে অধিকতর অবনয়নকারী এবং যৌনাঙ্গকে অধিকতর হিফাজতকারী। আর যে বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে না, তার জন্য সাওম আবশ্যক। কেননা, এটা তার যৌন তাড়না ধ্বংসকারী।
সত্যিই তো সাওম পালনের মধ্য দিয়ে যুবকের যৈবিক চাহিদা হ্রাস পায়, যা তাকে আল্লাহ দ্রোহিতামূলক কাজ থেকে বাঁচিয়ে দেয়। এ ছাড়া সাওমের মাধ্যমে মানবদেহের কমপক্ষে ২১টি রোগের নিরাময় হয়ে থাকে। তাই তো বলা হয়, সাওম বিশ্ব প্রভুর এক অনন্য বিধান।
মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন : প্রভাষক, আরবি বিভাগ, উত্তর বাড্ডা ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা।